রঙের ক্যানভাসে জিয়াউরের স্বপ্নের সংগ্রাম

তারিফুল ইসলাম
তারিফুল ইসলাম তারিফুল ইসলাম , ফিচার লেখক
প্রকাশিত: ১২:৪৯ পিএম, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

প্রতিভা কখনোই কোনো সীমাবদ্ধতায় আটকে থাকে না। একাগ্রতা, সাধনা আর ভালোবাসাই পারে একজন শিল্পীকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিতে। ঠিক তেমনই এক উদাহরণ জিয়াউর রহমান। যিনি কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই হয়ে উঠেছেন এক জনশ্রুতিমান চিত্রশিল্পী। তার তুলির ছোঁয়ায় সৃষ্টি হওয়া শিল্পকর্মগুলো দেশ-বিদেশের শিল্পপ্রেমীদের মুগ্ধ করছে।

জিয়াউর তার ক্যানভাসে গ্রাম বাংলার প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য এবং সমাজের বাস্তব চিত্রকে ফুটিয়ে তোলেন। তার আঁকায় গ্রামীণ জীবনের সরল সৌন্দর্যের পাশাপাশি সমাজের অন্যায়, বৈষম্য এবং অসংগতিও প্রতিফলিত হয়। বাগেরহাটে জন্ম নেওয়া এই চিত্রশিল্পী সম্প্রতি জাগো নিউজের মুখোমুখি হন। তিনি বলেন তার কাজ সম্পর্কে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন তারিফুল ইসলাম-

বিজ্ঞাপন

জাগো নিউজ: আপনার ছোটবেলা কেমন কেটেছে? শিল্পের প্রতি ভালোবাসা কীভাবে তৈরি হলো?
জিয়াউর: জাগো নিউজকে ধন্যবাদ। আমি জন্মেছি গ্রামে। নদী-মাঠ চষে, মাছ ধরে, নৌকা-ভেলা-ঘুড়ি উড়িয়ে শৈশব কৈশোর কেটেছে আমার। চক স্লেট এ লেখার সময় আঁকাআকি শুরু। ছোটবেলায় বেশিরভাগ সময় খেলাধুলার চেয়ে ছবি আঁকা ছিল আমার প্রধান কাজ।

রঙের ক্যানভাসে জিয়াউরের স্বপ্নের সংগ্রাম

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

জাগো নিউজ: ছোটবেলায় কখনো ভাবতেন যে একজন পেশাদার আর্টিস্ট হবেন?
জিয়াউর: অদ্ভুত এক সংকেত বাজতো মনে সারাক্ষণ। সেই আনন্দ এবং নেশায় আজ অব্দি এঁকে চলেছি। যখন বুঝতে শুরু করলাম তখনই বুঝে গিয়েছিলাম আমাকে যে কোনো উপায়ে শিল্পী হতেই হবে এবং অন্য কিছু হব না।

জাগো নিউজ: আপনার আঁকার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে কী কী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে?
জিয়াউর: নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় যুদ্ধ আজন্মকাল, তারপর আবার ছবি আঁকার নেশা। কখনো পজিটিভ সাপোর্ট পাইনি কারো কাছ থেকে। অনেক মার খেয়েছি কথা শুনেছি। খুব ছোট থেকে আয় করে পড়ার খরচ চালিয়েছি। এমনকি আঁকার জন্য যা যা লাগে সব কিনতে হয়েছে নিজে আয় করে।

শুরুর দিকে আমার উপকরণ ছিল ইটের টুকরো, কয়লা,পুইশাক এর পাকা বিচি, গাছের পাতা। আর ক্যানভাস ছিল মাটির দেয়াল, অংকের খাতা, বইয়ের নতুন মলাট। বড় হতে হতে রং কাগজের সঙ্গে পরিচয় এবং নানান মাধ্যমে আঁকার প্রাক্টিস করতাম নিজের স্টাইলে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

জাগো নিউজ: প্রথমবার যখন আপনার আঁকা বিক্রি হয় কিংবা প্রশংসা পেয়েছিলেন তখনকার অনুভূতি কেমন ছিল?
জিয়াউর: প্রথম যখন পেইন্টিং বিক্রি হলো ভালো লাগেনি খুব। কারণ টাকা যা পেয়েছিলাম তার থেকে পেইন্টিং হাত ছাড়া হওয়ার বেদনা অনেক দিন ছিল। এছাড়া কাজের প্রশংসা নিশ্চয়ই আনন্দের। মানুষ মাত্রই তা পেতে চায়, আমিও চাই।

জাগো নিউজ: আপনি কোন মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
জিয়াউর: আমি পেন্সিল স্কেচ, কলম, কালি, কয়লা, জল রং, তেল রং, এক্রেলিক রং দিয়ে এঁকে থাকি কাগজ অথবা ক্যানভাসে।

জাগো নিউজ: আপনার আঁকা সবচেয়ে প্রিয় বা গুরুত্বপূর্ণ আর্টওয়ার্ক কোনটি এবং কেন?
জিয়াউর: আমার অজস্র কাজ আমার অসম্ভব প্রিয় এবং অনেক সাবজেক্ট এ একটা দুইটা বলা মুশকিল। যেমন পাখি নিয়ে সিরিজ আছে বেশ কয়েকটি যা আনন্দের।

বিজ্ঞাপন

রঙের ক্যানভাসে জিয়াউরের স্বপ্নের সংগ্রাম

জাগো নিউজ: আজকের জায়গায় আসতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি জিনিস কী ছিল?
জিয়াউর: আজকের এই পর্যন্ত শেষ কথা নয় যদিও তবু গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিষয় হচ্ছে: ধৈর্য, সততা এবং অনুশীলন।

জাগো নিউজ: ডিজিটাল মাধ্যমের প্রসারকে আপনি কীভাবে দেখছেন? এটি কি চিত্রশিল্পের জন্য হুমকি নাকি নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে?
জিয়াউর: প্রযুক্তির এই যুগে মানুষ দ্বীধাগ্রস্ত অশান্ত বলে মনে হয়। এখন অনেকে ডিজিটাল মিডিয়ায় ঝুঁকছেন এবং বেশ ভালো করছেন। তবে পরিশ্রম করে পেইন্টিং করাটা কমে যাচ্ছে বোধহয়। তবে আশাবাদী কেউ কেউ সত্যিই শিল্পের দায়ে শিল্প করবেন আদিম আনন্দে।

বিজ্ঞাপন

জাগো নিউজ: আপনার মতে, বাংলাদেশের চিত্রশিল্পের বর্তমান অবস্থা কেমন? নবীন শিল্পীদের জন্য কী পরামর্শ দেবেন?
জিয়াউর: বাংলাদেশের চিত্রশিল্পের অবস্থা অন্যান্য বিজনেসের মধ্যে ধীর গতি। শিল্পের মানদণ্ডে অসামান্য কাজ করছেন নবীন, প্রবীন শিল্পীরা। নিজের ধারা বা স্টাইল আছে সবার কাজে এক্সপেরিমেন্ট করছেন নানান মাধ্যমে শিল্পীরা। প্রদর্শনীগুলো দেখলে আপনি অবাক হবেন, জল রং এক্রেলিক স্কেচ ছাপচিত্র টেরাকোটা ভাস্কর্য সহ নানান মাধ্যমে।

নবীনদের জন্য পরামর্শ দেওয়ার যোগ্যতা হয়নি আমার। যা শেয়ার করতে পারি তাহলো কাজ ভালোবেসে লেগে থাকা। সারা দুনিয়ার শিল্পীদের কাজ দেখা, প্রদর্শনী দেখা বেসিক বিষয়ে পড়াশোনা করে নিজের মতো এক্সপেরিমেন্ট করা আর প্রতিমুহূর্তে নিজের কাজকে চ্যালেঞ্জ করে ছাড়িয়ে যাওয়া। এক জায়গায় আটকে না থেকে সময়, শ্রম এবং প্রেম নিয়ে ভেতরের অনুভব প্রকাশ করে যেতে হবে।

জাগো নিউজ: একটি শিল্পকর্ম কীভাবে সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে?
জিয়াউর: শিল্প মূলত সময়ের ছাপ। হয়তো অতীত, ভবিষ্যত এবং বর্তমান শিল্পী সমাজে দায়বদ্ধ হলে কাউকে খুশি করার চেয়ে সত্য কথাটা পেইন্টিং দিয়ে বলেন কিছু পরোয়া না করে। পেইন্টিং শুধু আনন্দের খোরাক নয় প্রতিবাদও বটে এবং আদিমকাল থেকেই দুনিয়ায় একমাত্র শক্তিশালী ভাষা পেইন্টিং। তাই শিল্পীর মন্দ লাগা সমাজের নানান ব্যাধি নিয়ে শিল্প সমাজকে নাড়া দেয় অতীতে দেখেছেন কিছুদিন আগেও দেখেছেন।

বিজ্ঞাপন

রঙের ক্যানভাসে জিয়াউরের স্বপ্নের সংগ্রাম

জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? আর্ট নিয়ে নতুন কোনো প্রকল্প বা উদ্যোগ রয়েছে?
জিয়াউর: আমি পরিকল্পিত জীবন কিংবা কাজ নিয়ে সময় নষ্ট করিনা। সময়ের প্রয়োজনে কাজ করি আনন্দ যতক্ষণ। ভাগ্য ভালো হলে আর বেঁচে থাকলে অনেক কাল নিশ্চয়ই অনেক কাজ করবো আরও শিখবো। মাঝেমধ্যে প্রদর্শনী করবো, সুযোগ পেলে দুনিয়াকে আমার চিন্তা দেখাবো অথবা কিছুই করবো না।

জাগো নিউজ: যদি সময়কে পিছিয়ে নেওয়া যেত, তাহলে ক্যারিয়ারের শুরুতে কোন জিনিসটা ভিন্নভাবে করতেন?
জিয়াউর: সময় পিছিয়ে নেওয়া গেলে নিজের অনেক সরলপনা ও বোকামি শুধরে নিয়ে আরেকবার উপভোগ করতাম ৯০ দশকের বাংলাদেশ কিংবা দুনিয়া।

বিজ্ঞাপন

কেএসকে/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।