ছোট এসব জলাভূমি যেন একেকটি সোনার খনি

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২:৩৭ পিএম, ২৯ জানুয়ারি ২০২৫

ড. ফোরকান আলী

বাংলাদেশ অমিত সম্ভাবনার দেশ। জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত দেশের সংখ্যা অনেক। এর মধ্যে আমাদের প্রিয় দেশটি অনন্য। এদেশ সম্ভাবনাময়, তার কারণ এখানকার জনগোষ্ঠী একই ভাষায় কথা বলে, ভূ-প্রকৃতি একইরকম, ব্যক্তি মানুষের মাঝে সম্প্রীতি ঈর্ষণীয়। ন্যূনতম চাহিদা পূরণ হলেই সাধারণ মানুষ খুবই খুশি ও সব মানুষই পরিশ্রমী। পরিতাপের বিষয়, কিছু বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি বা সামাজিকভাবে নজর না দেওয়ায় নীরবে বাংলাদেশের উর্বর ভূমি মরুভূমিতে পরিণত হতে যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

সারাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মরুকরণ শুরু হয়ে গেছে। আমাদের লক্ষ্যে ও অলক্ষ্যে ছোট ডোবা, পুকুর, দীঘি, জলাশয়, খাল, বিল, হাওর ইত্যাদি ভরাটের উৎসব চলছে। বাংলাদেশের হৃৎপিণ্ড গড়াই নদীতে পানি নেই, ধুধু বালি আর বালি। খরার দুপুরে গড়াই নদীর পানি রক্ষা করতে পারত আবহাওয়ার ভারসাম্য। উষ্ণতা শুষে দাবদাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। কুষ্টিয়া শহরে ভর খরার দুপুরে বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণ জায়গা। ঠিক একইভাবে কুষ্টিয়া শহরসহ সারাদেশের আশপাশে পুকুর, ডোবা, জলাভূমি যেন ভরাট প্রতিযোগিতার কেন্দ্র। সাধারণত ছোট একটি পুকুর তার তরল সোনা বিকিরণ প্রক্রিয়ায় পতিত সূর্যের তাপ শুষে নিয়ে পুকুরের আশপাশে উষ্ণতার ভারসাম্য রক্ষা করে।

বাংলাদেশের বিখ্যাত বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তি আব্দুল্লাহ আল মুতী শরফউদ্দীন তার জীবদ্দশায় সেমিনার/সিম্পোজিয়ামে একাধিকবার বলেছেন এবং বইয়ে লিখেছেন ‘সমূহ সম্ভাবনার বাংলাদেশ টিকে থাকবে যতদিন ছোট ছোট জলাভূমি যা ছোট ছোট সোনারখনি তার অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকবে’। কারণ এদেশের মানুষের জীবনের সঙ্গে নদী, জলাশয় এবং অরণ্যের একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটেও এর গুরুত্ব বা ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিশেষ করে খাল, জলাশয়গুলো ভালোভাবে সংরক্ষণ করা হলে তাতে পরিবেশকে নির্মল রাখবে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

শহরাঞ্চল ও গ্রামের শোভা বর্ধন করতে পারে এবং বাতাসকে রাখতে পারে স্বাভাবিক ও গতিময়। গ্রাম কিংবা শহর সর্বত্রই জলাভূমির অস্তিত্ব মানবজীবনের জন্যই প্রয়োজন। কিন্তু দিন দিন যেভাবে ঝিল-জলাশয় ভরাট ও বেদখল হয়ে যাচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। আমাদের দেশে জলাধার সংরক্ষণ আইন ছাড়াও পরিবেশ বিভাগ ও স্থানীয় সরকার বিভাগ রয়েছে। আছে রাজধানী, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ বিভিন্ন শহর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। তবু জলাধারগুলো হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। সেইগুলো ভরাট করে গড়ে উঠছে বড় বড় বিল্ডিং। এখানে সংগত কারণে জলাভূমি সংরক্ষণে জনসম্পৃক্ততার কথাও এসে যায়।

‘মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী জলাভূমি ও নিম্নাঞ্চল সংরক্ষণে’ বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বার বার সংরক্ষণের তাগিদ দিয়ে আসছে। তারা বলছেন, বিশেষ করে রাজধানীর বেশিরভাগ জলাভূমি ধ্বংস হয়ে গেছে। এখনই বাকিগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ না করলে সর্বনাশের কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, তখন মাটির নিচে আর পানির পুনর্ভরণ হবে না। এতে কৃষি ও মৎস্য খামার একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ধ্বংস হবে জীব-বৈচিত্র্য এবং নানা দিক দিয়ে জনগণ হবে সুবিধাবঞ্চিত। এসব বিচেনা করে, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য সরকার কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল।

দেশের ৬৪টি জেলার অভ্যন্তরস্থ ছোট নদী, খাল এবং জলাশয় পুনঃখনন প্রকল্প (১ম পর্যায়) শীর্ষক একটি কর্মসূচির আওতায় এ কার্যক্রম পরিচালিত হবে। সরকারি সূত্র মতে, ৩৭৫ উপজেলা ও দুটি সিটি করপোরেশনে ৫৬১টি প্যাকেজের আওতায় প্রায় ৪০৮৬ দশমিক ৬২২ কিলোমিটার দীর্ঘ ৮৮টি ছোট নদী, ৩৫২টি খাল এবং আটটি জলাভ‚মি পুনরায় খনন করা হবে। খনন করা মাটির পরিমাণ হবে ১৫ দশমিক ১৫ কোটি ঘনমিটার। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে, ৫ দশমিক ২০ হেক্টর এলাকার জলাবদ্ধতা সরিয়ে বন্যা ও জলবায়ু-পরিবর্তন থেকে রক্ষা করা, ১ দশমিক ৩০ লাখ হেক্টর জমিতে সেচের মাধ্যমে ৩ দশমিক ৫০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, ১৫ হাজার জেলের মাছ চাষ, ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে জৈববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, ৩ দশমিক ৬৫ লাখ হেক্টর জমির বন্যা নিয়ন্ত্রণ, ৪ হাজার ১০০ কিলোমিটার রাস্তা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি এবং ১ হাজার ৮০০ কিলোমিটার নৌপথ দিয়ে নদী যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও সহজ করা।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর থেকে ছোট নদী, খাল এবং জলাভূমির তীর থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু করে। ওই সময় পর্যন্ত ৫ হাজার ৫৭৪টি অবৈধ স্থাপনা অপসারণ এবং অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে ৫৯৩ দশমিক ১২ একর জমি উদ্ধার করা হয়েছিল। নথিতে উল্লেখ করা হয়, ‘প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে পানি সংরক্ষণের পাশাপাশি ছোট নদী ও খালগুলোতে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বজায় রাখা সম্ভব হবে’। এতে আরও উল্লেখ করা হয়, ৬৪টি জেলার অভ্যন্তরস্থ ছোট নদী, খাল এবং জলাশয় পুনঃখনন প্রকল্প (২য় পর্যায়) শীর্ষক আরও একটি প্রকল্প প্রণয়নের কাজ চলছে। নথির তথ্য অনুসারে, এ প্রকল্পের আওতায় সরকার প্রতিটি উপজেলায় পাঁচটি নদী, খাল ও জলাভূমি পুনঃখনন করবে। প্রকল্পের মাধ্যমে ১৩ হাজার ৮৮৫ দশমিক ৩৬৩ কিলোমিটার নদী, খাল এবং জলাভূমি পুনঃখনন সম্ভব হবে। তবে শেষ পর্যন্ত সে প্রকল্প পরিকল্পণার কোন সুখবর দেখা যায়নি।

অন্যদিকে রাজউকের মাস্টার প্ল্যানে ও খুব শক্তভাবে জলাভূমি সংরক্ষরণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু রাজউক নিজেই তা মানছে না। রাজউকের বিভিন্ন আবাসন প্রকল্পে প্রায় ৪৫ শতাংশ জমি নেওয়া হয়েছে জোর করে। প্রায় ২৬ শতাংশ দখল করা হয়েছে অতর্কিতে বালি ফেলে। ১৮ শতাংশ নেওয়া হয়েছে নামমাত্র দামে। এমনকি প্রকল্প এলাকায় ৯২ শতাংশ মানুষই জমি বিক্রি করতে ইচ্ছুক ছিল না। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, রাজধানী ও আশেপাশের ৪৯টি আবাসন প্রকল্প রয়েছে বন্যাপ্রবণ এলাকায়। এছাড়া বেসরকারি আবাসন প্রকল্পগুলোর মধ্যে অনুমোদিত ৩৪টি। আর অননুমোদিত ৮৭টি।

অননুমোদিত প্রকল্পগুলো যেন দেখার কেউ নেই। এভাবে রাজধানীর লেকের সঙ্গে অন্যান্য জলাশয়ের যে সংযোগ ছিল তা ভূমিদস্যুদের দখলে চলে গেছে। যা দিয়ে মহানগরীর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা হতো। ফলে বর্ষা মৌসুমে সংশ্লিষ্ট এলাকায় জলাবদ্ধতাজনিত যে দুর্ভোগ দেখা যায় তা আর নতুন করে বলার অবকাশ নেই। জলাবদ্ধতায় সীমাহীন কষ্ট করার অভিজ্ঞতা সারোদেশের নগরবাসীর এরই মধ্যে সয়ে গেছে। জলাশয়গুলো সংরক্ষণ ও উন্নয়নের পদক্ষেপ গৃহীত না হলে ভবিষ্যতে এর পরিণাম হবে আরও ভয়াবহ। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু ও ধলেশ্বরী- এই পাঁচটি নদী ঢাকাকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত রাখে। কিন্তু নদী ও নদীসংলগ্ন খালগুলো ক্রমান্বয়ে ভরাট হয়ে যাবার ফলে ঢাকা বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে। ঢাকা ছাড়াও সারাদেশে ছিল অসংখ্য খাল-বিল-হাওর-পুকুর-ডোবা ইত্যাদি। কিন্তু তার অধিকাংশই এখন বিলীন হয়ে গেছে।

বিজ্ঞাপন

বর্তমানে ঢাকায় ২৫/২৬টি খালের অস্তিত্ব পাওয়া যায় কিন্তু এইগুলোও স্থানে স্থানে ভরাট কাজ চলছে। কিন্তু সরকারের ঘোষণা ছিল, কোনো অবস্থাতেই খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুর ও প্রাকৃতিক জলাশয়ের স্বাভাবিক গতি ও প্রকৃতি পরিবর্তন করা যাবে না। এমনকি সড়ক, মহাসড়ক, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণকালেও প্রাকৃতিক জলাশয়, জলাধার, খাল, নদী ইত্যাদির স্বাভাবিকতা নষ্ট করা যাবে না। জনস্বার্থে সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য একান্তই যদি তা করতে হয়, তবে অবশ্যই সরকারের অনুমতি গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু সরকারের আদেশের কেউ তোয়াক্কা করছে না বলেই জলাশয়গুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বাস্তবে এর পশ্চাতে রয়েছে আরও কয়েকটি কারণ। বিশেষ করে জনসংখ্যার চাপ ও অন্যান্য কারণে শহর ও মহানগরের জমির দাম দিন দিন বাড়ছে।

জলাভূমি রক্ষার স্বার্থে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর করা প্রয়োজন। তবে এ কাজে সরকারের পাশাপাশি জনগণের সম্পৃক্ততা কাজে দিতে পারে। দেশের বর্তমান জলবায়ুর প্রেক্ষাপটে এর গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের বাঁচতে আমাদেরই একত্রিত হয়ে আন্দোলন গড়ে তুলে জলাভূমিগুলো অচিরেই রক্ষা করতে হবে। এজন্য মহল্লায় মহল্লায় ‘জলাভূমি সংরক্ষণ’ কমিটি গড়ে তোলা প্রয়োজন। আইনগত ও নিরাপত্তাজনিত ব্যবস্থাদিও গ্রহণ করা দরকার। সর্বোপরি জলাভূমি রক্ষায় সরকারি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয়েরও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাহলেই কেবল আমরা দেশের ছোট ছোট জলাভূমিকে ছোট ছোট স্বর্ণের খনিতে পরিণত করতে পারব।

লেখক: গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ

বিজ্ঞাপন

কেএসকে/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।