আতশবাজির শব্দে আতঙ্কিত নীড়হারা পাখিরা
নীল আকাশের বুকে ডানা মেলে উড়তে থাকা পাখিদের দেখে যে কারো মন আনন্দে ভরে ওঠে। গাছের ডালে তাদের কূজন কিংবা নীরব সকাল ভেঙে তাদের মিষ্টি গান যেন প্রকৃতির এক অনন্য উপহার। কিন্তু উৎসবের নামে মানুষের কর্মকাণ্ডে আজ সেই পাখিরাই অসহায় হয়ে পড়ছে।
নতুন বছরের রঙিন আলো আর আতশবাজির শব্দ মানুষের আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। তবে এই আনন্দ কতটা নিরীহ? প্রকৃতির অন্যান্য বাসিন্দার জন্য এই উদযাপন যে ভয় ও বিপদের কারণ হতে পারে, তা নিয়ে কি আমরা একবারও ভেবেছি! ফ্রন্টিয়ারস ইন ইকোলজি অ্যান্ড দ্য এনভায়রনমেন্ট জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্র বলছে, নববর্ষে আতশবাজিতে আক্রান্ত হয় লাখ লাখ পাখি।
মার্কিন গণমাধ্যম স্যালন প্রতিবেদনের শুরুতেই প্রশ্ন তুলেছে, আতশবাজি ফোটানোর বাইরে নতুন বছর উদযাপনের কি আর কোনো বিকল্প পথ নেই?
সাধারণত মানুষের তুলনায় পাখি ও অন্যান্য প্রাণীর শ্রবণশক্তি অনেক উন্নত। নববর্ষ উদযাপনের সময় আকাশজুড়ে আলোর ঝলকানি ও বিকট শব্দ পাখিদের জন্য দুঃস্বপ্নের মতো। রাতে যখন পাখিরা নিরাপদ আশ্রয়ে থাকে, তখন আতশবাজির হঠাৎ শব্দ তাদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয়। বৈদ্যুতিক তার, জানালা বা বিল্ডিংয়ে বাড়ি খেয়ে মৃত্যু হয় অনেক পাখির। আবার ফানুসের আগুনে ঝলসে যায় অনেকের দেহ।
তীব্র শব্দ তাদের মানসিক চাপের কারণ হয়। রঙিন আলোর ঝলকানিতে তারা দিক হারায়। আতশবাজি থেকে সৃষ্ট ধোঁয়া তাদের শ্বাসপ্রশ্বাসে বাধা সৃষ্টি করে।
ফ্রন্টিয়ারস ইন ইকোলজি অ্যান্ড দ্য এনভায়রনমেন্ট জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আতশবাজির তীব্র শব্দ ও ঝলমলে আলো পাখিদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করে। এ কারণে বছরের অন্য রাতগুলোর তুলনায় এই রাতে পাখিদের তাদের বাসস্থান ত্যাগ করে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার আশঙ্কা এক হাজার গুণ বেশি।
উৎসব আমাদের আনন্দ দেয়, কিন্তু সেই আনন্দের মূল্য যদি পাখিদের দিতে হয়, তবে তা কতটা ন্যায়সঙ্গত? আতশবাজির শব্দ ও আলো শুধু পাখি নয়, শিশু, বৃদ্ধ এবং অসুস্থ মানুষের জন্যও কষ্টদায়ক। তীব্র শব্দে ছোট শিশুদের কান এবং হৃদযন্ত্রের ওপর চাপ পড়ে। বৃদ্ধ মানুষ ও রোগীদের ক্ষেত্রে শব্দ দূষণ শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ করে তোলে।
নেদারল্যান্ডসের একটি দল গবেষক আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের রাডার এবং পাখির সংখ্যা সম্পর্কিত বিশ্লেষণ ব্যবহার করে আতশবাজি ব্যবহৃত অঞ্চলের পাশাপাশি শান্ত এলাকায় পাখিদের গতিবিধি নিয়ে গবেষণা করেছেন। এতে তারা দেখতে পান, আতশবাজির শব্দ পাখিদের ওপর একটি বিরূপ প্রভাব ফেলে, যা কয়েকদিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
রাতে প্রকৃতি কিংবা প্রাণীকুলকে কষ্ট দিয়ে নয়, দিনেও হতে পারে ব্যতিক্রমী আয়োজন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও পরিবেশবান্ধব কার্যক্রম আয়োজন করা যেতে পারে, যা পাখি কিংবা অন্যান্য প্রাণের জন্য কোনো সমস্যা সৃষ্টি করবে না। ফুল, পাতা বা প্রাকৃতিক উপকরণ দিয়ে সজ্জিত করা, গাছ লাগানোর মতো উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং সামাজিক কার্যক্রমের মাধ্যমে উদযাপন যেমন পরিচ্ছন্নতা অভিযান বা সাহায্য কার্যক্রম এসব উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
এছাড়াও গ্রামীণ লোকসংস্কৃতির চর্চা যেমন গান, নৃত্য, কবিতা পাঠ এবং নাটক আয়োজন করা যেতে পারে। উদযাপনকে শিক্ষামূলক করে তুলতে শিশু ও বড়দের জন্য প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ে কর্মশালা আয়োজন করা যেতে পারে। অর্থাৎ আমরা চাইলেই শব্দ ও আলোর ব্যবহার সীমিত রেখে পরিবেশবান্ধব ও সৃজনশীল উদযাপন বেছে নিতে পারি।
আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ বার্ত হুকস্ত্রা এক বিবৃতিতে বলেন, উড়তে গিয়ে পাখির অনেক শক্তি খরচ হয়। তাই শীতকালে পাখিদের যতটা সম্ভব কম বিরক্ত করা উচিত। তিনি ও গবেষণাটির সহ-লেখকরা উল্লেখ করেন, আতশবাজিমুক্ত বিস্তৃত অঞ্চল তৈরি করা বা আতশবাজি ফোটানো হলেও সেটি নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ রাখার মাধ্যমে পাখিদের ওপর এই নেতিবাচক প্রভাব এড়ানো সম্ভব।
কেননা পাখিদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলা আমাদের দায়িত্ব। নতুন বছর হোক নতুন ভাবনার। এমন একটি পৃথিবীর স্বপ্ন দেখা যাক, যেখানে মানুষের আনন্দে পাখি, মানুষ কিংবা প্রকৃতি কেউই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। ‘উৎসব হোক আনন্দের, কিন্তু তা যেন না হয় কারো দুঃখের কারণ’, নতুন বছরে এই প্রত্যাশা নিয়েই শুরু হোক আমাদের পথচলা।
কেএসকে/এএসএম