বাঁশ চটায় চলে বেদ সম্প্রদায়ের জীবন-জীবিকা

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি ঝিনাইদহ
প্রকাশিত: ০১:১১ পিএম, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

গৃহবধু শাপলা বেদ। একমনে বাঁশ কঞ্চি আর বাঁশ থেকে ছোট ছোট সরু চটা প্রস্তুত করছেন। এরপর তা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তৈরি করছেন ছোট ছোট ঝুড়ি, শর্পেস (ঢাকনা)সহ প্রয়োজনীয় নানা ধরনের তৈজসপত্র। সাংসারিক কাজের পাশাপাশি সপ্তাহে তিনি ৫০ থেকে ৬০টি ঝুড়ি ও শর্পেস তৈরি করেন। তৈরি এসব সামগ্রী বিক্রি করা হয় পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন হাটে। এর থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশে চলে সংসার। শাপলা বেদে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কয়েরগাছী আবাসন ও আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা।

ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কয়েরগাছী আবাসন ও আশ্রয়ণ প্রকল্পে বেদ বংশের অন্তত ২০ পরিবারের প্রায় ৩০ জন সদস্য এই কুটির শিল্পের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তারা খেলনা কুলা, মুড়ি খাওয়ার ডোল, হাতপাখা, ঝুড়ি, ভাত ও তরকারি ঢাকার কাজে ব্যবহৃত শর্পেস, মাছ ধরার খালোই সহ অন্যান্য সামগ্রী তৈরি করেন। নারীদের তুলনায় পুরুষেরা প্রায় দ্বিগুণ কাজ তুলতে পারেন।

সপ্তাহের শুরুতেই আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে বিশেষ ধরনের তল্লা বাঁশ আকার ভেদে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা কখনো তারও বেশি দরে প্রতিজন গড়ে ১০ থেকে ১৫টি বাঁশ কিনে আনেন। অবশ্য কয়েক বছর আগে বাঁশের দাম ছিল গড়ে ৬০ টাকা। এই বাঁশ পরে সাইজ করে কেটে মসৃণ চটা তৈরি ও চিকোন কঞ্চি তোলা হয়। সেগুলো কিছু সময় রোদে শুকানো হয়। এরপর বাজার থেকে পছন্দমতো হাজার পাওয়ারের রং কিনে তাতে দেওয়া হয়। রং করা শেষে আবার রোদে শুকানো হয়। শুকানো শেষে তা কাজ করার উপযুক্ত হয়। এই হস্ত শিল্পের চাহিদাও নেহাত কম নয়। তবে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে লভ্যাংশ এখন কিছুটা কম বলে জানালেন তারা।

বাঁশ চটায় চলে বেদ সম্প্রদায়ের জীবন-জীবিকা

একটা কুলা তৈরিতে খরচ গড়ে ১৫ থেকে ২৫ টাকা, ডালা ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, ছোট খেলনা ডোল ১০ টাকা, ঝুড়ি ২০ থেকে ৩০ টাকা, পাখা ৩০ টাকা। খরচের তুলনায় স্থান ভেদে ৫ থেকে ৩০ টাকা লাভে বিক্রি করেন তারা। তাদের তৈরি এই বাঁশের সামগ্রী চট্রগ্রাম ও ঢাকায় পাটানো হয়। এছাড়া পরিবারের সদস্যরা সপ্তাহ ধরে তৈরির পর মাল নিয়ে বিভিন্ন গ্রামে, শহরে, চর এলাকায় ফেরি করে বিক্রি করেন। তবে প্রতি শুক্রবার জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার হাটেও বিক্রি করেন তারা।

তারা জানান, ‘বছরের অন্যান্য সময় বিক্রি ভালো হলেও চৈত্র, বৈশাখ ও জৈষ্ঠ্য মাসে চাহিদা থাকে অনেক বেশি। তখন অনেকেই প্রতিটা জিনিসে খরচের তুলনায় দ্বিগুণের বেশিও লাভ করেন।’ এক সময় জেলা সদরের তেতুলতলা সহ আশপাশের এলাকায় বেদে সম্প্রদায়ের মতো তাবু করে বসবাস করতো বেদ বংশের মানুষ। পরবর্তিতে ২০০৩ সালে কয়েরগাছী এলাকায় আবাসন প্রকল্প হলে সেখানে আশ্রয় হয় তাদের। সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরেও নিরাপদ বসতি হয়েছে তাদের অনেকেরই। এই সম্প্রদায়ের আদি পেশা হচ্ছে বাঁশের সামগ্রী তৈরি করা।

কয়েরগাছী আশ্রয়নের বাসিন্দা শাপলা বেদ বলেন, ১২ বছর ধরে এই কাজ করছি। ডালা, শরপেস, কুলা বিভিন্ন স্থানে বেচা বিক্রি হয়। ঢাকার পার্টিও পাইকারী কিনে নিয়ে যায়। এগুলো বিক্রি করে যে লাভ হয় তা দিয়েই সংসার চলে। এই লাভের টাকা দিয়েই তিনি বড় মেয়ে অপর্ণা বেদকে পড়াচ্ছেন স্থানীয় একটি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে। ছোট মেয়ে অন্নপুর্ণা এখনো স্কুলে যাওয়ার মতো হয়নি।

বাঁশ চটায় চলে বেদ সম্প্রদায়ের জীবন-জীবিকা

অপর নারী ঝিলিক জানায়, প্রথমে চটা দিয়ে ঝুড়ির তলা তৈরি করা হয়। এরপর তা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বানানো হয় পুর্ণাঙ্গ ঝুড়ি। তৈরি শেষে সেগুলো পুরুষেরা বিভিন্ন হাটে বিক্রি করেন।

রাজু কুমার ও আনন্দ কুমার জানায়, চাহিদা ভালো থাকলেও আগের তুলনায় লাভ হয় না। প্লাস্টিক পণ্য ও পুজি সংকটে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে আদি এ পেশার মানুষ। এক্ষেত্রে আর্থিকভাবে সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন বলেও মত তাদের।

স্থানীয় মহারাজপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান খুরশিদ আলম বলেন, আবাসন ও আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের যাযাবর জীবনের অবসান হয়েছে। এখানে থেকেই তারা কুলা, ডালাসহ বাঁশের সামগ্রী তৈরি করছেন। কিন্তু প্লাস্টিকের কারণে এই পেশা কিছুটা হলেও সংকুচিত হয়েছে। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তাদের এই জীবিকার উৎস বৃদ্ধির পাশাপাশি কুটির শিল্পের ঐতিহ্য ধরে রাখা সম্ভব হবে বলে যোগ করেন।

আরও পড়ুন
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ কোনটি জানেন?
শীতলপাটিতে সুদিন ফিরছে তাদের
আইয়ুব বাচ্চু থেকে জেমস, সবার গিটারের ভরসা আব্দুল রফিক

এএএলএম/কেএসকে/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।