পুতিনের গুপ্তচর থেকে রাষ্ট্রনায়ক হয়ে ওঠা যেভাবে

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩:৪১ পিএম, ২১ জানুয়ারি ২০২৪

আহসান হাবিব রাজা
পুতিন ছোটবেলা থেকেই খুব দুরন্তপনা ছিলেন। সহপাঠীদের সঙ্গে নিত্যদিন ঝগড়া, মারামারি লেগেই থাকতো তার। এমনকি অপরাধ জগতেও পা বাড়িয়ে ছিলেন। তৈরি করেছিলেন কিশোর ‘গ্যাং’। অপরাধ জগৎ থেকে বের করে আনতে পরিবার থেকে তাকে ব্যস্ত রাখা হয় বিভিন্ন খেলাধুলায়। ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয় জুডো ক্লাসে। এই কৌশল পরে খুব কাজে লেগেছিল। কে জানতো স্কুলে মারামারি করে বেড়ানো ছেলেটা একদিন বিশ্বনেতা হবে? ‘গ্যা’ পরিচালনা করা সেই কিশোর কীভাবে গুপ্তচর থেকে আজকের আলোচিত রাষ্ট্রনায়ক। বলছিলাম ভ্লাদিমির পুতিনের কথা। ভ্লাদিমির পুতিনের গুপ্তচর, রাজনৈতিক, শিক্ষা ও ব্যক্তিগত জীবনের সফলতা নিয়ে আজকের এই প্রতিবেদক। লিখেছেন আহসান হাবিব-

ভ্লাাদিমির পুতিন রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পুতিনের শৈশব কেটেছে এক কঠিন পরিবেশে। বর্তমানে সেন্ট পিটার্সবার্গ, যেটি এক সময় লেলিনগ্রাদ নামে পরিচিত ছিল। সেখানেই বেড়ে ওঠা পুতিনের। পুতিনের বাবা ছিলেন কারখানার শ্রমিক এবং তার দাদা ছিলেন বাবুর্চি। তিনি যেখানে বেড়ে উঠেছেন, সেখানে ছোটবেলায় পুতিনের সঙ্গে স্থানীয় ছেলেদের সংঘাত শুরু হয়। সে জন্যই পুতিন জুডো খেলা শেখেন। ‘সেভেনটিন মোমেন্টস অব স্প্রিং’ সিনেমাটি দেখার পর পুতিন গুপ্তচরবৃত্তি পেশায় অনুপ্রাণিত হন। মূলত ২য় বিশ্বযুদ্ধের ওপর নির্মিত ছবিগুলো তাকে বেশি অনুপ্রাণিত করেছিল।

আরও পড়ুন: ব্রুনাই সুলতানের ভাসমান প্রাসাদে যা যা আছে

ছোটবেলা থেকেই পুতিনের স্বপ্ন ছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবিতে কাজ করার। যে স্বপ্ন সেই কাজ। লেলিনগ্রাদ স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে আইন শাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জন করেন। আইন পেশায় মন ছিল না তার। পেশা হিসেবে বেছে নেন গুপ্তচরবৃত্তি। দুরন্ত কৌতূহলী মন এই পেশা বেছে নিতে উৎসাহ জোগায়। আইন শাস্ত্রে পড়াশোনা করা পুতিন বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করেই তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবিতে যোগ দেন। এই শিশুটিই বড় হয়ে পরিণত হলেন এক দুর্ধর্ষ কেজিবি এজেন্টে।

কেজিবি থেকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদবি নিয়ে অবসরে যান পুতিন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার কাজ ছিল বাইরের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ রক্ষা করা। এর কিছুদিন পরেই তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গের প্রথম নির্বাচিত মেয়র সবচেকের উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন এবং অল্পদিনেই সবচেকের মন জয় করে নেন।

১৯৯৬ সালে পুতিন মস্কো চলে আসেন। এখানে প্রেসিডেন্ট স্টাফ হিসেবে ১২ দিনের ডেপুটি হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯৮ সালে পুতিন তখনকার প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিনের নজরে আসেন। তিনি তাকে ন্যাশনাল সিকিউরিটি সার্ভিসের ডিরেক্টর পদে বসান। পুতিন ধীরে ধীরে প্রেসিডেন্টের আস্থাভাজন হন। স্নায়ুযুদ্ধের সময় তিনি তৎকালীন পূর্ব জার্মানিতে কেজিবির গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করেন এবং তিনি ছিলেন গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান। ১৯৯৭ সালে বরিস ইয়েলৎসিন যখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট তখন ভ্লাদিমির পুতিন ক্রেমলিনে আসেন এবং তাকে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা সার্ভিসের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কেজিবিতে তিনি চাকরি করেন ১৫ বছর, যার মধ্যে ৬ বছর কাটিয়ে দেন জার্মানির ড্রেসিডেনে। যুক্তরাষ্ট্রেও অংশ নিয়েছেন কভার্ট অপারেশনে। ১৫ বছর চাকরি করার পর কেজিবি থেকে অবসর নিয়ে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নেন।

আরও পড়ুন: বিশ্বের সবচেয়ে ধনী পরিবার চেনেন কি?

পুতিন বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার শেষে যুক্ত হলেন রুশ ক্ষমতার কেন্দ্রস্থল ক্রেমলিনে। তিনি চতুর্থবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি আলোচিত, সমালোচিত ভ্লাদিমির পুতিন। তার লড়াকু মনোভাব বিভিন্ন সময় নিজের কথাবার্তায় ফুটে উঠেছে।

১৯৯৯ সালে ইয়েলৎসিন পুতিনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। ২ বারের বেশি প্রেসিডেন্ট না থাকার বিধান থাকলেও পুতিন প্রথমে ২ বার প্রেসিডেন্ট এবং পরে একবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে আরও দুবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসিন হন।

একজন গোয়েন্দা বা গুপ্তচর হিসেবে পুতিনের জীবন বর্ণাঢ্য বললেও কম বলা হবে। কারণ বিয়ে করতে গিয়েও তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন গুপ্তচরবৃত্তির। নিজের বন্ধুকে পাঠিয়ে যাচাই করে দেখেছিলেন তার প্রেমিকা আসলেই তাকে ভালোবাসে কি না! লুদমিলা পুতিন সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। কিন্তু কজন পারেন এমন এক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে? অর্থাৎ যাচাই বাছাই ছাড়া পুতিন জীবনের কোনো সিদ্ধান্তই নেন না।

রাশিয়ার তরুণ প্রজন্মের কাছে পুতিন খুবই জনপ্রিয়। তবে ইউক্রেনে ক্রিমিয়া দখল ও আগ্রাসন এবং সিরিয়াতে রুশ সেনা পাঠিয়ে আসাদ সরকারকে সহায়তার জন্য অনেকেই পুতিনকে সমর্থন করছেন না। তাই বলে পুতিনের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি। এর প্রমাণ রাশিয়াতে ২০১৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন।

সোভিয়েত ইউনিয়নের মূল বুনিয়াদই ছিল সমাজতন্ত্রের। পুতিন প্রেসিডেন্টে যখন ততদিনে সোভিয়েতের পতনের এক দশক কেটে গিয়েছে। নতুন রুশ প্রেসিডেন্ট সেই সমাজতন্ত্রকে ছেঁটে ফেলেন বটে। কিন্তু উসকে দেন সোভিয়েত আবেগকেও। পাশাপাশি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা লঙ্ঘন করে বিকেন্দ্রীকরণের বিপরীত পথে হেঁটে নতুন রাস্তা তৈরি করে ফেলেন তিনি। গ্যালিমভের কথায়, ‘তিনি যতই কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছিলেন, ততই তার জনপ্রিয়তা বাড়ছিল।’

পুতিন ছিলেন রাশিয়ার একজন ব্র্যান্ড। ধীরে ধীরে তা গড়ে তুলেছেন ক্ষুরধার এই রাষ্ট্রনেতা। নিয়মিত রুশ খবরের কাগজে শিরোনাম হয়েছে, ‘পুতিনের বদলা’, ‘পুতিনের গোপন লড়াই’ কিংবা ‘১০টি কারণ কেন পুতিন একজন অসাধারণ মানুষ’ এমনই সব শিরোনাম। সারাক্ষণ নিজেকে ভাসিয়ে রাখা। অদ্ভুত সব গুজব। পুতিন নাকি ১৯২০ সালেও ছিলেন। নিঃসন্দেহে এই সব গল্পকথা তাকে আরও বেশি করে কুয়াশামাখা মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে। সেই সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে তার ক্যারিশমা। সব মিলিয়ে অপ্রতিরোধ্য এক ইমেজ।

আরও পড়ুন: বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ দেশ কোনটি জানেন?

ভ্লাদিমির পুতিনের জীবন সাফল্যে ভরপুর ক্ষমতায় আসার পর তিনিই প্রথম রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে এনেছেন। দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধের মাধ্যমে রাশিয়ার অঙ্গরাজ্যগুলোর অখণ্ডতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি সর্বপ্রথম ৯ বছরের মধ্যেই জিডিপি ৭২ পার্সেন্ট বৃদ্ধি করতে সক্ষম হন। রাশিয়া অর্থনীতি মজবুত হওয়ার পেছনে তার অবদান অনেক বেশি। দারিদ্র্যের হার কমে আসে ৫০ শতাংশ। মাসিক বেতন ৮০ ডলার থেকে ৬৪০ ডলারে বৃদ্ধি পায়। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি বেশকিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যেমন ১৩ শতাংশ আয়কর নির্ধারণের বিষয়ে আইন পাস, জ্বালানি রপ্তানির আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা ইত্যাদি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর রাশিয়া তাদের জ্বালানি রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার পর বিশ্বব্যাপী কতটা অস্থিরতা তৈরি হয়েছে সেটা আমরা এরই মধ্যে গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পেরেছি। ২০১৩ সালে পুতিনের সঙ্গে তার স্ত্রীর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। তাদের ৩০ বছরের দাম্পত্য জীবন।

ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় কি সেই ব্র্যান্ডের ক্ষতি হয়েছে? পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলোর দাবি, ২০১৪ সালে যখন পুতিন ক্রিমিয়া দখল করলেন, তখন তার জনপ্রিয়তা বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ‘ডেভিড’ ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ দেড় মাসেও জিততে পারেনি ‘গোলিয়াথ’ রাশিয়া। মনে করা হচ্ছে, হয়তো এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত রাশিয়া সুবিধা না করতে পারলে এতদিনের ব্র্যান্ড পুতিন ধূলিসাৎ হবেই। তখন হয়তো নতুন কেউ উঠে আসবেন। অন্য কোনো রাষ্ট্রনায়কের গল্প লেখা হবে রাশিয়ার জনমানসে। আর যদি তা না হয়? সেক্ষেত্রে আরও নতুন করে মজবুত হতে থাকবে ব্র্যান্ড পুতিন। ঠিক কী ঘটতে চলেছে, তা জানতে আপাতত অবশ্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

কেএসকে/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।