২০০ বছরের পুরোনো গফুর শাহ গায়েবি মসজিদ

এম মাঈন উদ্দিন
এম মাঈন উদ্দিন এম মাঈন উদ্দিন , উপজেলা প্রতিনিধি, মিরসরাই (চট্টগ্রাম)
প্রকাশিত: ১২:০২ পিএম, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বারৈয়াঢালা ইউনিয়নের কলাবাড়িয়া গ্রামে ৪ হাজার ফিট জায়গায় ৪০টি পিলারে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক ও দৃষ্টিনন্দন গফুর শাহ গায়েবি মসজিদ। ২০০ বছরের পুরোনো এই মসজিদ প্রতিষ্ঠার পেছনে আছে নানা গল্প।

কথিত আছে, আবদুল গফুর নামে এক কৃষক গায়েবি আদেশ পান। সেই অনুয়ায়ী প্রায় ২০০ বছর আগে নির্মিত হয় মসজিদটি। জনবসতি থেকে অন্তত দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এ মসজিদ থেকে এখনো মানুষ গায়েবি আজানের আওয়াজ শুনতে পান। দূর-দূরান্ত থেকে মুসলমান ছাড়াও হিন্দু-বৌদ্ধসহ নানান ধর্মের মানুষ এই মসজিদে আসেন তাদের মনোবাসনা পূরণের জন্য। মানুষের বিশ্বাস এখানে আসলে যে কোনো মনোবাসনা পূরণ হয়।

জনশ্রুতি আছে, আবদুল গফুর শাহ নামে এক কৃষক ছিলেন। কৃষিকাজ ও গরুপালন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তিনি। গফুর শাহ প্রতিদিন গরুগুলোকে নিয়ে যেতেন স্থানীয় পাহাড়ে। সেখানে একটি জায়গায় নিয়ে ছেড়ে দিতেন। পাহাড় ঘুরে ঘাস খেয়ে গরুগুলো আবারও সেখানে ফিরে আসত। কখনো এ নিয়মের ব্যতিক্রম হত না। কিন্তু একদিন ঘাস খেতে গিয়ে তার একটি গাভির বাছুর আর ফিরে আসেনি। পাগলের মতো সেটি খুঁজতে শুরু করলেও বাছুরটি আর পাওয়া যাচ্ছিল না। গফুর শাহ কিন্তু প্রতিদিনই বাছুরের সন্ধানে সেখানে যেতেন। এভাবে ১০ দিন পার হয়ে গেল। একদিন গভীর জঙ্গল থেকে ডেকে উঠল বাছুরটি।

আরও পড়ুন: প্রাচীন বাংলাসহ ১৩০ দেশের মুদ্রা সংগ্রহে তার

কিন্তু সেখানে যাওয়া ছিল অনেক কঠিন। কিন্তু বাছুরের জন্য জঙ্গল পরিষ্কার করতে শুরু করলেন গফুর শাহ। এভাবে দীর্ঘ সময়ের চেষ্টায় জঙ্গলের ভেতরে এক স্থানে গিয়ে বাছুরটির সন্ধান পেলেন। সেখানে বাছুরের সঙ্গে আরেকটি জায়গা দেখে বিস্মিত হলেন তিনি। অবাক হয়ে দেখলেন এত গভীর জঙ্গলেও একটি নামাজ পড়ার স্থান রয়েছে।

কেউ নিয়মিতই নামাজ পড়েন এখানে! সেখানে ঘাসের মধ্যে কপালের ও হাঁটুর জায়গার ছাপ রয়েছে। ছিল আরও নানা চিহ্ন। যা দেখে তিনি নিশ্চিত হন এখানে কেউ নিয়মিত নামাজ পড়তেন। কিন্তু এ জঙ্গলে কে নামাজ পড়তে আসবে তা ভেবেই অবাক হন তিনি।

শেষে তিনি ভাবলেন কোনো বুজুর্গ ব্যক্তিই এখানে নামাজ পড়েন নিশ্চয়। সাধারণ মানুষ এত গভীর জঙ্গলে ভয়ে আসবে না। পরে সেখানে একটি বাঁশের বেড়া দিয়ে মসজিদ স্থাপন করলেন তিনি। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো কেউ না থাকলেও এই মসজিদ থেকে গায়েবিভাবে আজানের সুর ভেসে আসত! এ পাহাড় থেকে তখন জনবসতি ছিল অনেক দূরে। কিন্তু আজানের শব্দ ভেসে যেত সেখানেও। ধীরে ধীরে এই গায়েবি আজানের কথা এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে গ্রামবাসীরাও কৌতূহলী হয়ে সেখানে যেতে শুরু করলো।

অবশেষে গ্রামবাসীরা মিলে বেড়ার পরিবর্তে একটি মাটির মসজিদ তৈরি করলেন সেখানে। ততদিনে কৃষক গফুর শাহ নিজেও হয়ে উঠলেন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব। দূর-দূরান্ত থেকে এ মসজিদে ছুটে আসতে থাকলেন ধর্মভীরু বহু নর-নারী। মসজিদটি পরিচিত হয়ে গেল গফুর শাহ গায়েবি মসজিদ নামে। যে যা আশা নিয়ে এখানে আসতেন তা পূরণ হতো। এমন বিশ্বাস তৈরি হলো সবার মাঝে।

আরও পড়ুন: যে গ্রামে সব শিশুরই যমজ আছে

এভাবে ছড়িয়ে পড়লো গফুর শাহ গায়েবি মসজিদের নাম। চারদিকে ব্যাপক নাম ছড়িয়ে পড়ার পর একদিন রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে গেলেন গফুর শাহ। বহু খুঁজেও তার সন্ধান আর পাওয়া যায়নি। অনেকে মনে করেন তিনি উধাও হয়ে গেলেও তার দোয়া এখানে সবসময় আছে।

মসজিদের খতিব মাওলানা বাকি বিল্লাহ সাদেকী বলেন, ‘আমি অনেক বছর ধরে এই মসজিদের দায়িত্বে আছি। এখানে দারুণ এক শান্তির পরিবেশ বিরাজ করে সবসময়। সেই বুজুর্গ ব্যক্তি গফুর শাহ গরু বাছুর খুঁজতে গিয়ে এ স্থানে গায়েবিভাবে তৈরি হওয়া মসজিদটির সন্ধান লাভ করেছিলেন। তিনি এখানে নামাজ পড়তে শুরু করার পর ধীরে ধীরে এলাকাবাসীও আসতে থাকেন।’

তবে তিনি জানান, গায়েবিভাবে আজান শোনার পরই মানুষ স্রোতের মতো আসতে থাকেন। এভাবেই গফুর শাহর তৈরি বেড়ার মসজিদ পরবর্তীতে মাটির মসজিদে রূপান্তর হয়ে এরও অন্তত ১০০ বছর পর এটি পাকা মসজিদে পরিণত হয়। তারও পরে এটি টাইলসসহ অত্যাধুনিক মসজিদ হয়ে ওঠে।

তিনি আরও বলেন, ‘এখানে বিশ্বাস নিয়ে যারা আসেন তাদের মনের আশা পূর্ণ হয়। এখানে প্রতিদিন অনেক মানুষ নামাজ পড়তে আসেন। তবে শুক্রবার সহস্রাধিক মুসল্লির সমাগম হয় এখানে। বর্তমানে এটি পরিচালনার জন্য ১৫ সদস্যের একটি কমিটি আছে। তাদের তত্ত্বাবধানে এটি পরিচালিত হচ্ছে।’

অবশ্য মসজিদ খতিবের কথা যে সত্যি তা স্বীকার করেন এলাকার সবাই। ছোট দারোগারহাটের বাসিন্দা বৃদ্ধ মো. রহমত আলী বলেন, ‘এ মসজিদ গায়েবি মসজিদ এটা সবাই জানে। আর গফুর শাহ গরু চরালেও আসলে তিনি ছিলেন বুজুর্গ ব্যক্তি। গরুটি ছিল একটি উছিলা। তিনি পবিত্র স্থানটি সবাইকে দেখিয়ে যান। বর্তমানে এখানে জঙ্গলের চিহ্নমাত্রও নেই। ঝকঝকে পরিবেশে সবাই ইবাদত-বন্দেগি সারেন।’

বারৈয়াঢালা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রেহান উদ্দিন বলেন, বাবা-দাদাদের কাছ থেকে আমরা গফুর শাহ (রহ.)’র কাহিনি শুনে আসছি। তিনি একজন বড় মাপের ওলি ছিলেন। মসজিদের জায়গা মানুষকে চিনিয়ে দিয়ে তিনি উধাও হয়ে যান। তার নামেই মসজিদটির নামকরণ করা হয়। দূর-দূরান্ত থেকে মুসলমান, হিন্দু-বৌদ্ধসহ নানা ধর্মের নানা জাতের মানুষ এখানে ছুঁটে আসেন।

তিনি আরও বলেন, আশপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষ মারা গেলে অছিয়ত অনুযায়ী এই মসজিদ প্রাঙ্গণে তাদের জানাজা পড়ানো হয়ে থাকে। তখন জানাজায় অংশ নেওয়া মুসল্লিদের স্থান সংকুলান হয়না। নির্দিষ্ট গণ্ডিতে বেঁধে না রেখে মানুষের বৃহত্তর স্বার্থে ওয়াকফ স্টেটের মাধ্যমে মসজিদটি পরিচালিত হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

কেএসকে/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।