সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা: সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ
শিবু দাশ সুমিত
দেশের সব সাধারণ মানুষকে পেনশন ব্যবস্থার আওতায় আনতে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি চালু করেছে সরকার। মূলত সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান, বেকারত্ব, ব্যাধি, পঙ্গুত্ব বা বার্ধক্যজনিত কারণে নাগরিকদের সরকারি সাহায্য দেওয়া, বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে এই সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।
দেশের সর্বস্তরের জনগণকে টেকসই পেনশন কাঠামোর আওতায় নিয়ে আসার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যেমন-শেষ বয়সে যেন কেউ অনিশ্চয়তার মধ্যে না পড়ে সেটি নিশ্চিত করা। অর্থাৎ ভবিষ্যতে কর্মক্ষম জনসংখ্যা হ্রাসের কারণে নির্ভরশীলতার হার বৃদ্ধি পাবে। এ সমস্যা থেকে উত্তরণে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, দেশে মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। মোট জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ তরুণ যাদের সংখ্যা ৪ কোটি ৭৪ লাখ। অপরদিকে কর্মক্ষম জনসংখ্যা ৬২ শতাংশ যাদের বয়স ১৫-৫৯ বছরের মধ্যে, সংখ্যায় যা ১০ কোটি ৫০ লাখ। বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের মধ্যবর্তী পর্যায়ে আছে। একটি দেশ ৩০-৪০ বছর পর্যন্ত এ সুবিধা ভোগ করে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সুবিধা ২০৪০ সালের পর থেকে কমতে থাকবে। কোনো দেশের মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশের বয়স যদি ৬৫ বা তার বেশি হয়, তাহলে সেই দেশকে ‘প্রবীণের দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত বলছে ২০৪৭ সালে বাংলাদেশ ‘প্রবীণের সমাজ’ বা ‘প্রবীণ দেশ’-এ রূপান্তরিত হবে। যার ফলশ্রুতিতে সিনিয়র সিটিজেনদের পুনর্বাসন ও দেখভালের জন্য সরকার ও সমর্থদের ওপর বাড়বে চাপ। তাই এটি বলা যায় ভবিষ্যতে নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
আরও পড়ুন: সর্বজনীন পেনশন স্কিমে চাঁদার হার কত?
সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩ ও সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা, ২০২৩-এ বলা হয়েছে সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালায় চার ধরনের স্কিম আছে। জেনে নিন সেগুলো-
প্রবাস স্কিম (প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য)
বিদেশে অবস্থানরত কোনো বাংলাদেশি নাগরিক তফসিলে বর্ণিত চাঁদার সমপরিমাণ অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় প্রদানপূর্বক এ স্কিমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। পরবর্তীতে তিনি দেশে আসলে দেশীয় মুদ্রায় সমুদয় অর্থ পরিশোধ করতে হবে এবং তিনি চাইলে স্কিমও পরিবর্তন করতে পারবেন। পেনশন স্কিমের মেয়াদ পূর্তিতে পেনশনার দেশীয় মুদ্রায় পেনশন প্রাপ্ত হবেন। এক্ষেত্রে মাসিক চাঁদার পরিমাণ হবে ৫ হাজার/৭ হাজার ৫০০/১০ হাজার টাকা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় কেউ যদি ৫ হাজার টাকা টানা ৪২ বছর চাঁদা প্রদান করেন তবে তিনি ৬০ বছর পূর্ণ হবার পর প্রতি মাসে ১ লাখ ৭২ হাজার৩২৭ টাকা করে পেনশন পাবেন।
প্রগতি স্কিম (বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীগণের জন্য)
আমাদের দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। দেশে অবস্থানরত বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য স্বতন্ত্র একটি প্যাকেজ আছে মূল স্কিমের অধীনে। ‘প্রগতি’ নামের এই স্কিমটিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটিরও স্বাধীনভাবে অংশগ্রহণের সুবিধা রয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীগণের এ স্কিমে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে চাঁদার ৫০ শতাংশ দেবে কর্মচারী এবং বাকি ৫০ শতাংশ দেবে প্রতিষ্ঠান। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ না করলে উক্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী নিজ উদ্যোগে এককভাবে এ স্কিমে অংশ নিতে পারবেন। প্রগতি স্কিমে মাসিক চাঁদার হার যথাক্রমে ২ হাজার/৩ হাজার/৫ হাজার টাকা। এখানে কেউ যদি ৫ হাজার টাকা টানা ৪২ বছর চাঁদা প্রদান করেন তবে তিনি ৬০ বছর পূর্ণ হবার পর প্রতি মাসে ১লাখ ৭২ হাজার ৩২৭ টাকা করে পেনশন পাবেন।
আরও পড়ুন: সর্বজনীন পেনশনের জন্য আবেদন করবেন যেভাবে
সুরক্ষা স্কিম (স্বকর্মে নিয়োজিত নাগরিকগণের জন্য)
এখানে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারী ব্যতীত অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত বা স্বকর্মে নিয়োজিত যে কেউ যেমন কামার, কুমার, শ্রমিক, জেলে, তাঁতি, কৃষক, ড্রাইভার, রিক্সাচালক বা গৃহিণী ইত্যাদি মাসিক ১ হাজার/২ হাজার/৩ হাজার/৫ হাজার টাকা হারে চাঁদা প্রদানপূর্বক এ স্কিমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। তফসিল অনুযায়ী একজন পেনশনার ৬০ বছর পূর্ণ হবার পর প্রতি মাসে ১ লাখ ৭২ হাজার ৩২৭ টাকা করে পেনশন পাবেন যদি তিনি ৫ হাজার করে টানা ৪২ বছর চাঁদা প্রদান করেন।
সমতা স্কিম (স্বকর্মে নিয়োজিত স্বল্প আয়ের নাগরিকদের জন্য অংশ প্রদায়ক পেনশন)
এটি মূলত যারা দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করেন তাদের জন্য। যাদের বাৎসরিক আয় ৬০ হাজার টাকা বা এর নিচে তারাই এ স্কিমের আওতাভুক্ত হবেন। এখানে চাঁদাদাতা মাসিক দেবে ৫০০ টাকা আর সরকার দেবে ৫০০ টাকা। কেউ যদি টানা ৪২ বছর ৫০০ টাকা করে চাঁদা প্রদান করেন তবে তিনি ৬০ বছর পূর্ণ হবার পর প্রতি মাসে ৩৪ হাজার ৪৬৫ টাকা করে পেনশন পাবেন।
স্কিমে অংশগ্রহণের যোগ্যতা ও যেসব কাগজপত্র লাগবে
এক্ষেত্রে বয়স হতে হবে ন্যূনতম ১৮ বছর বা তদূর্ধ্ব ৫০ বছর। বিশেষ বিবেচনায় ৫০ বছর ঊর্ধ্ব বয়সের নাগরিকগণও স্কিমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। এক্ষেত্রে স্কিমে অংশ নেবার তারিখ হতে নিরবচ্ছিন্ন ১০ বছর চাঁদা প্রদান শেষে তিনি যে বয়সে উপনীত হবেন সে বয়স হতে আজীবন পেনশন প্রাপ্ত হবেন। যেসব প্রবাসী বাংলাদেশির জাতীয় পরিচয়পত্র নেই তারা পাসপোর্ট ব্যবহার করে নিবন্ধন করতে পারবেন, তবে স্বল্প সময়ের মধ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট জমা প্রদান করতে হবে। আবেদনকারীর মোবাইল নম্বরে এবং অনিবাসী আবেদনকারীর ক্ষেত্রে স্বংয়ক্রিয় ই-মেইলের মাধ্যমে আইডি নম্বর, চাঁদার হার এবং মাসিক চাঁদা প্রদানের হার অবহিত করা হবে।
যেভাবে চাঁদা প্রদান করা যাবে
মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস, অনলাইন ব্যাংকি, ক্রেডিট/ডেবিট কার্ড বা তফসিলি ব্যাংকের যে কোনো শাখায় ওটিসি (ওভার দ্য কাউন্টার) পদ্ধতিতে কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত ব্যাংক হিসাবে মাসিক চাঁদা জমা দেওয়া যাবে। এখন চারটি স্কিমের জন্য আলাদা চারটি হিসাব খোলা হয়েছে সোনালী ব্যাংকে। এ হিসাবগুলোতে চাঁদা জমা হবে। সোনালী ব্যাংক দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও পরবর্তীতে অন্য ব্যাংকও যুক্ত হবে।
নির্ধারিত তারিখের মধ্যে চাঁদা প্রদান করতে ব্যর্থ হলে
নির্ধারিত তারিখের মধ্যে চাঁদা প্রদান করতে ব্যর্থ হলে পরবর্তী এক মাস পর্যন্ত জরিমানা ছাড়া চাঁদা প্রদান করা যাবে এবং এক মাস অতিবাহিত হবার পর প্রতি দিনের জন্য ১ শতাংশ হারে বিলম্ব ফি জমা প্রদান সাপেক্ষে হিসাবটি সচল রাখা যাবে। যদি চাঁদাদাতা ধারাবাহিকভাবে তিন কিস্তি চাঁদা জমাদানে ব্যর্থ হন তবে তার হিসাবটি স্থগিত হবে এবং জরিমানাসহ বকেয়া কিস্তি পরিশোধ করলেই কেবল হিসাবটি সচল হবে। চাঁদা মাসিক, ত্রৈমাসিক ও বার্ষিক ভিত্তিতে পরিশোধের সুযোগ রয়েছে।
স্কিম থেকে অগ্রিম লোন গ্রহণ করা যাবে কি না
পেনশন কর্মসূচিতে জমা করা অর্থ কোনো পর্যায়ে এককালীন উত্তোলনের সুযোগ থাকবে না। চাঁদাদাতা নিজের ও তার পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা, গৃহ নির্মাণ, গৃহ মেরামত এবং সন্তানের বিবাহের ব্যয় নির্বাহসহ অন্যান্য যে কোনো প্রয়োজনে তহবিলে জমাকৃত অর্থের ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে উত্তোলন করতে পারবেন। পরবর্তীতে যা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ধার্যকৃত ফিসহ সর্বোচ্চ ২৪ কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে।
নমিনী নির্বাচন
চাঁদাদাতা চাইলে এক বা একাধিক নমিনী নির্বাচন করতে পারবেন। যদি একক নমিনী বা একাধিক নমিনীর ক্ষেত্রে সব নমিনী মৃত্যুবরণ করে তবে চাঁদাদাতাকে পুনরায় নমিনী নির্বাচন করতে হবে।
চাঁদাদাতা বা পেনশনারের মৃত্যুর পর স্কিমের অর্থ যেভাবে বণ্টন হবে
চাঁদাদাতার মৃত্যুর পর তার নির্বাচন করা নমিনী স্কিমের অর্থ পাবেন। যদি একাধিক নমিনী দেওয়া থাকে সেক্ষেত্রে স্কিমের অর্থ সমভাবে বণ্টন হবে। কোনো নমিনী মারা গেলে জীবিত নমিনী বা নমিনীগণ স্কিমের অর্থ সমহারে পাবেন। পেনশনে থাকাকালীন কোনো পেনশনার যদি ৭৫ বছর পূর্ণ হবার পূর্বে মারা যান তবে নমিনী বা নমিনীগণ মূল পেনশনারের বয়স ৭৫ বছর পূর্ণ হতে যতদিন অবশিষ্ট থাকবে ততদিন পর্যন্ত মাসিক পেনশন পাবেন।
যদি চাঁদাদাতা ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেন সেক্ষেত্রে যা হবেঃ
কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগে নিবন্ধিত চাঁদাদাতা মারা গেলে জমা করা অর্থ মুনাফাসহ তার নমিনীকে ফেরত দেওয়া হবে। বিশ্বজুড়ে সাধারণত ডিফাইন্ড বেনিফিটস (ডিবি), ডিফাইন্ড কন্ট্রিবিউশন (ডিসি) ,আনফান্ডেড, ফান্ডেড এ চার ধরনের পেনশন ব্যবস্থা চালু আছে। ডিবি পদ্ধতি সরকারি কর্মচারীদের জন্য। ডিসি পদ্ধতিতে কর্মী বা প্রতিষ্ঠান থেকে একটি তহবিলে অর্থ জমা হয় এবং সেখান থেকেই ব্যয় নির্বাহ করা হয়। আনফান্ডেড পেনশনে কোনো কর্মীকে চাঁদা দিতে হয় না বলে এটির জন্য কোনো তহবিলও সৃষ্টি হয় না। ফান্ডেড পেনশনে কর্মী/প্রতিষ্ঠান বা উভয়কেই চাঁদা দিতে হয়। আবার বিভিন্ন দেশে বিমা কোম্পানির মাধ্যমেও পেনশন ব্যবস্থা চালু আছে। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই প্রবীণ নাগরিকদের আর্থিক নিরাপত্তার লক্ষ্যে পেনশন কর্মসূচী পরিচালনা করা হয়। সম্প্রতি চালু হওয়া সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্যও তাই। ধারণা করা হচ্ছে চার ধরনের পেনশন স্কিমের মাধ্যমে দেশের প্রায় ১০ কোটি মানুষকে এর আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হবে। বিশাল জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান করার মাধ্যমে বাংলাদেশ কল্যাণকামী রাষ্ট্র হবার পথে আরও একধাপ এগিয়ে গেল।
লেখক: সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, নড়াইল।
কেএসকে/এএসএম