জৌলুস হারাচ্ছে নৌকা বাইচ
মিনহাজুর রহমান
‘আল্লাহ-রসুলের নাম লইয়া নাও খোলোরে/ সোনার নায়ে পবনের বৈঠা ধর রে/ হেইয়্যাবোল-হেইয়্যাবোল।’ গানের তালে তালে নৌকা বাইচ করছেন মাঝি-মাল্লারা। বাংলার অতি পরিচিত একটি দৃশ্য। একবিংশ শতাব্দীতে খুব বেশি চোখে না পড়লেও নব্বই দশকের এক উৎসবের নাম ছিল নৌকা বাইচ।
বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য নৌকা বাইচ। বর্তমানে এই ঐতিহ্য হাতে লাঠি ভর দিয়ে চলছে। একসময় নদীমাতৃক এ দেশের নৌকা বাইচ ছিল নদীপাড়ের মানুষের প্রধান উৎসব। বছরের শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে এ উৎসব পালিত হতো।
নৌকা বাইচের বিশেষ একটি আকর্ষণ ছিল সারি গান। নৌকা যখন চলতো মাঝি-মাল্লারা সমস্বরে সারি গান গাইতেন। আর গানের তালে তালে বৈঠা চালাতেন। নৌকার মধ্যে ঢোল, তবলা নিয়ে গায়েনরা থাকতেন। তাদের গানগুলো মাঝিদের উৎসাহ আর শক্তি জোগায়। গায়েন কাসির শব্দে বৈঠা এবং গানের গতি বজায় রাখতে সজাগ থাকেন। অন্য সব নৌকাকে পেছনে ফেলতে গানের সুর আর কাসির শব্দে বৈঠার গতি বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন: বাংলার ঐতিহ্য বায়োস্কোপ নতুন প্রজন্মের কাছে অজানা
শিশু-কিশোর থেকে বয়োবৃদ্ধ হাজার হাজার মানুষের আবেগ-উত্তেজনার মুহুর্মুহু কলধ্বনি। সে ছিল মনোমুগ্ধকর নির্মল আনন্দের খোরাক। যান্ত্রিক এই আধুনিকতায় বাঙালির এই লোকসংস্কৃতি হারাতে বসেছে। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে কোথাও আর এই উৎসবের আয়োজন করা হয় না। দেশের কোথাও দু-একবার নৌকা বাইচ দেখা যায় কিন্তু পুরোনো সেই আনন্দ-আমেজ আর ঐতিহ্য নিয়ে আয়োজিত হয় না। বাংলাদেশের নদীগুলো নাব্যতা হারাচ্ছে। নদী দখল, নদী দূষণ, নাব্যতা কমে যাওয়া ইত্যাদি প্রতিবন্ধকতার কারণে নৌকা বাইচ তার জৌলুস হারাচ্ছে। বর্তমানে শিশুদের কাছে নৌকা বাইচ যেন রূপকথার গল্প। এভাবেই প্রায় বিলুপ্তির পথে নৌকা বাইচ।
নৌকা বাইচের নৌকাগুলো সাধারণ নৌকা থেকে অনেক বেশি লম্বা ও প্রস্থে অনেকটা সরু হয়। নৌকার গায়ে বাহারি রঙের বিভিন্ন ডিজাইনের চিত্রাঙ্কন থাকতো। নৌকার মাথা ময়ূরমুখা, বাঘমুখা, কুমিরমুখা, রাজহংসিমুখা আকৃতির সুনিপুণ কারুকার্যে মণ্ডিত থাকে। বজরা, ময়ূরপঙ্খী, গয়না, পানসি, কোষা, ডিঙি, পাতাম, কাচারি, সাম্পান ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একেকটি নৌকা প্রায় ১০০ থেকে ২০০ ফুট লম্বা হতো।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, নৌকা বাইচের ইতিহাস সভ্যতা জন্মের ঊষালগ্ন থেকেই। সর্বপ্রথম মেসোপটেমিয়া সভ্যতায় ইউফ্রেতিস নদীতে নৌকা বাইচ খেলার ইতিহাস পাওয়া যায়। পরে মিশরীয় সভ্যতায় নীল নদে নৌকা চালনার প্রতিযোগিতা প্রচলনের ইতিহাস পাওয়া যায়। এভাবে ধীরে ধীরে নৌকা বাইচ প্রসার লাভ করে। অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় নৌকা বাইচ অন্তর্ভুক্ত করা হয় ১৯০০ সালে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ সংস্কৃতি এখনো চালু আছে।
আরও পড়ুন: সেই হাঁক-ডাক নেই কটকটি বিক্রেতাদের
বাংলার ইতিহাসেও নৌকা বাইচের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। বাঙালির ইতিহাসে প্রাচীন রাজা-বাদশাহর রাজত্বকাল থেকেই নৌকা বাইচের প্রচলন ছিল। বর্ষাকালের অন্যতম প্রধান উৎসব ছিল নৌকা বাইচ। জনশ্রুতি আছে, জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রার সময় অনুসারীদের নিয়ে অনেক নৌকার ছড়াছড়ি ও দৌড়াদৌড়ি পড়ে যায়। এতেই মাঝি-মাল্লারা প্রতিযোগিতায় আনন্দ পান। এ থেকেই শুরু হয় নৌকা বাইচ।
অন্য এক জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, আঠারো শতকের শুরুর দিকে কোনো এক গাজী মেঘনা নদীর এক পাড়ে দাঁড়িয়ে থেকে আরেক পাড়ে থাকা ভক্তদের আসার আহ্বান করেন। তখন আশেপাশে যত নৌকা ছিল খবর পেয়ে ছুটে আসে। সারি সারি অজস্র নৌকা একে অন্যের সঙ্গে পালা দিয়ে চলতে থাকে। এ থেকেই নৌকা বাইচের প্রচলন হয়।
গাজীপুরের বংশী নদী পাড়ের ঐতিহ্যবাহী ‘বাংলার বাঘ’ নৌকার মালিক ওহিদুল ইসলাম মাইজভাণ্ডারী তার আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, ‘একসময় এই অঞ্চলে অনেক নৌকা বাইচ হইতো। আমার পিতা ‘বাংলার বাঘ’ নৌকা বানছিল। অনেক বিজয়ের সাক্ষী এ নৌকা। এখন আর এই এলাকায় বা আশেপাশের এলাকায় নৌকা বাইচ হয় না। নৌকা পানিতে না চলতে চলতে নষ্ট হইয়া গেছে। যারা মাঝি-মাল্লারা আছিল; তারা আর নাই এখন। এই শখের নৌকা আর নাই, বেইচ্চা দিছি। নতুন নৌকা আর বান্ধা হইবো না। বাংলার বাঘের জয়ের গল্প শুধু চোখে কল্পনা হইয়া ভাসে আর গল্প শোনাই মাইনষেরে। আমরা আমাগো ঐতিহ্য ধইরা রাখতে পারলাম না।’
বাংলার লোকজ সংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য আজ নানা প্রতিকূলতায় বিলুপ্তপ্রায়। প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে নদী পাড়ের মানুষের ব্যাপক আনন্দ উৎসাহ উদ্দীপনার উৎসব নৌকা বাইচ। নৌকার মালিকসহ মাঝি-মাল্লারা ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন এই হাজার বছরের ঐতিহ্য থেকে। এভাবে বাঙালির ঐতিহ্যগুলো ধ্বংস হতে থাকলে আগামী প্রজন্মের কাছে বাঙালি জাতির অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়ে যাবে। তাই সরকার এবং সচেতন মহলের প্রচেষ্টায় যেসব ঐতিহ্য হুমকির মুখে, সেগুলোকে পুনরুদ্ধার করতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা।
কেএসকে/এসইউ/এএসএম