বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে তিন সেমিস্টার কেন?
সাইফুল ইসলাম
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জ্ঞান বিতরণ করা, শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা। ব্রিটিশ আমলের এ অঞ্চলের বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে তাকালেই একটি পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ তৎকালীন বড় স্কুল বা কলেজগুলো বেশিরভাগই জমিদারসহ সাধারণ মানুষের দান করা সম্পদ, অর্থ কিংবা পরিশ্রমেরই ফসল। যারা তখন এসব সহায়তা করেছিলেন, নিশ্চয়ই তাদের এ খাত থেকে ব্যবসা করা মূল উদ্দেশ্য ছিল না। এ কথার সঙ্গে অন্তত কেউ দ্বিমত পোষণ করবেন না। যুগের হাওয়া বদলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ধরন বদলেছে। সরকারি-বেসরকারি-আধাসরকারিসহ কয়েক প্রকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে আছে।
ইউজিসির তথ্যমতে, বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা মোট ১১৪টি। এর মধ্যে কার্যক্রম চালু আছে ১০০টির মতো। অন্যদিকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৫২টি। সংখ্যার হিসেবে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বেসকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে অর্ধেকেরও কম। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত আসন সংখ্যা না থাকায় প্রতি বছরই উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা বড় একটি অংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা নেহায়েত কম নয়, প্রায় সাড়ে ৩ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে।
গত ৩১ জুলাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন থেকে বছরে তিন সেমিস্টারে পরিচালনায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি তাদের সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়। শুধু তা-ই নয়, যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই সেমিস্টার পরিচালিত হচ্ছে; সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার পরিচালনার বিষয়ে সমাধানে আসতে কারিগরি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যেখানে পুরাতন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো অনেক বিভাগ ইয়ার সিস্টেমে আর নতুন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বছরে দুই সেমিস্টার সিস্টেমে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনেরও স্পষ্ট নির্দেশনা আছে বছরে দুই সেমিস্টার পরিচালনা করার।
আরও পড়ুন: পারিবারিক শিক্ষা কি ক্ষয়িষ্ণুতার পথে?
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সিদ্ধান্ত আপতদৃষ্টিতে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীবান্ধব মনে হয়নি। কেননা এর আগেও কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কিছু বিভাগে চালু থাকলেও এর প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপর খুব বেশি একটা পড়েনি। কিন্তু এবার জোট বেঁধে মাঠে নেমেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। মনে হচ্ছে, যারা দুই সেমিস্টার পরিচালনা করবে; তাদেরও বছরে তিন সেমিস্টার করার জন্য বাধ্য করা হবে। বছরে তিন সেমিস্টারের উপকারিতা আমার চোখে খুব একটা পড়ে না। তবে নিশ্চয়ই বেসকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্তাকর্তাদের কাছে এর সুফল আছে। বাংলাদেশে নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সংখ্যাই বেশি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব অল্প সংখ্যক উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়ে আছে। বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত পরিবারের। বছরে তিন সেমিস্টারে নিশ্চয়ই শিক্ষার্থীরা খুশি হবেন না।
খুশি হওয়ার মতো কোনো কারণও নেই। কেননা এটি তাদেরও বোঝার ক্ষমতা হয়েছে যে, বছরে তিন সেমিস্টার মানে বাড়তি খরচ। এমনিতে সাধারণত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাধারণ একটি বিষয়ের ওপর স্মাতক সম্পন্ন করতে প্রায় ৮-১০ লাখ টাকা লাগে। অনেক সময় ১৫-২০ লাখ টাকাও লেগে যায়। তিন সেমিস্টার করার ফলে শিক্ষার মান কতটুকু বাড়বে, তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও খরচ আগের চেয়ে ৪-৫ লাখ টাকা বাড়বে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ নতুন সেমিস্টার মানেই নতুন করে ভর্তি, নতুন করে সেমিস্টার ফিসহ নানান ফি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সিদ্ধান্তকে পাশ কাটিয়ে এরকম সিদ্ধান্ত কখনোই শিক্ষাবান্ধব নয়।
অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বছরে দুই সেমিস্টার পরিচালনায় এমনিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়কেই হিমশিম খেতে হয়। যেখানে ৩৬৫ দিনের মধ্যে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ দিন দুই ঈদ ও শীতকালীন ছুটিসহ সরকারি ছুটি থাকে। এছাড়া শুক্র ও শনিবার বন্ধ থাকলে আরও ৫০-৬০ দিন বন্ধ থাকে। আবার প্রতি সেমিস্টার পরে সেমিস্টার ব্রেকে সব মিলিয়ে প্রায় অর্ধবছরই বন্ধ থাকে। এছাড়া প্রতি সেমিস্টারের প্রতি কোর্সে ইউজিসির নিয়ম অনুযায়ী প্রায় ৩০টি ক্লাস নিতে হবে। প্রতিটি কোর্সে পাঠদানের মাঝামাঝি নিতে হবে মিড সেমিস্টার পরীক্ষা। আবার অ্যাসাইনমেন্ট ও প্রেজেন্টেশন তো আছেই। তারপর চূড়ান্ত পরীক্ষা নিতে হবে।
আরও পড়ুন: প্রশাসন পররাষ্ট্র ও পুলিশে এত ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার কেন?
একটি সেমিস্টারে নিশ্চয়ই একটি কোর্স থাকে না। কমপক্ষে চারটি বা পাঁচটি কোর্স তো থাকবেই। যেখানে ছয় মাসে একটি সেমিস্টার শেষ করতে হিমশিম খেতে হয়; সেখানে চার মাসে কীভাবে এতগুলো কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব? আবার শিক্ষকরা তো শুধু ক্লাস নেওয়া ছাড়াও পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন, গবেষণাসহ নানা কাজ করতে হয়। তাহলে চার মাসে শেষ করলে একটি কোর্সে কতটুকু শেখা হবে, সে ব্যাপারে প্রশ্ন থেকে যায়। শুধু কিছু অর্থের জন্য শিক্ষার্থীদের এত বড় ক্ষতি কোনোভাবেই হতে দেওয়া ঠিক হবে না। এমনিতেই কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকিগুলোর পড়াশোনার মান নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। সেখানে তিন সেমিস্টার করলে মান কতটুকু রক্ষা হবে?
এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মতামত নেওয়া প্রয়োজন ছিল। কেননা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরাই একটি প্রতিষ্ঠানের প্রাণ। তাদের সঙ্গে কোনোরকম আলোচনা ছাড়াই এরকম সিদ্ধান্ত আশা করি ইউজিসি বাস্তবায়ন হতে দেবে না। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের এ ব্যাপারে কথা বলতে হবে। না হলে শিক্ষার মান ও টাকা দুটোই নষ্ট হবে।
লেখক: প্রভাষক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
এসইউ/এমএস