শ্রদ্ধাঞ্জলি
তাজউদ্দীন আহমদ: বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী
নান্টু রায়
১৯৭১ সালে কলকাতায় এক কিশোরের চোখে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর যে ছবি ধরা পড়েছিল, সে অভিজ্ঞতার বর্ণনা করে এ লেখার সূত্রপাত করা যাক। কিশোরটি তার বাবার সঙ্গে গিয়েছে পার্ক সার্কাস রোডে প্রধানমন্ত্রীর অস্থায়ী কার্যালয়ে এক সন্ধ্যাবেলা। সময়টা সেপ্টেম্বরের প্রথমদিক। কেউ নেই। সদর দরজা খোলা পেয়ে কিশোরটি তার বাবার হাত ধরে হাজির ভেতরবাড়িতে। প্রধানমন্ত্রী তখন কলঘরে। সাড়া পেয়ে বেরিয়ে এসেছেন—পরনে হাফ প্যান্ট, পাজামা-পাঞ্জাবিতে সাবান দিচ্ছেন। ভাবুন একবার! প্রবাসী সরকারের কার্যালয়ে পাহারা নেই, নিজের কাপড় নিজে পরিষ্কার করছেন প্রধানমন্ত্রী! এই ছোট্ট ঘটনা থেকে তাজউদ্দীন সাহেবের সরলতা, সততা, নিষ্ঠা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আনুগত্য ও আন্তরিকতা ধরা পড়ে। সেই মহাপ্রাণ নেতার প্রতি তাঁর জন্মদিনে (২৩ জুলাই ১৯২৫) আন্তরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সময়কাল ১৯৯২। বাংলার বাণী দৈনিকে রাতের পালায় চাকরি, দিনের বেলায় ভারত বিচিত্রার অবৈতনিক পাহারাদার। সেই সুবাদেই ঢাকা-কলকাতার প্রথিতযশা সব কবি-লেখকদের সঙ্গে চেনাজানা। সেই তালিকায় শামসুর রাহমান, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থেকে গুন্টার গ্রাস—কে নেই! বেলাল ভাই একদিন নিয়ে গেলেন তাজউদ্দিন সাহেবের ধানমন্ডির দ্বিতল বাসভবনে, পরিচয় করিয়ে দিলেন সিমিন হোসেন রিমির সঙ্গে। বিষয় কী? তাজউদ্দিন সাহেবের ডায়রির অনুবাদ করতে হবে। রিমি আপা প্রথমে একটা ডায়রি দিলেন ১৯৪৭ সালের। দোতলার একটা রুমে বসার জায়গা করে দিলেন। প্রতিদিন এগারোটার দিকে গিয়ে চারটা নাগাদ বাসায় ফিরে স্নান, খাওয়া-দাওয়া করে ছ’টা-সাড়ে ছ’টায় মতিঝিলে বাংলার বাণী অফিসে ঢুকে পড়া। কিছুদিন পরে বেলাল ভাইয়ের উৎসাহে ভাটা পড়ে, আমারও অনুবাদ ১৯৫১-য় এসে থেমে যায়। পরে যখন তাজউদ্দিনের ডায়রি ছাপা হয়, কোথাও এমনকি রিমি আপার লেখা ভূমিকাতেও আমার নাম না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকে টেলিফোন করি—তিনি সদুত্তর দিতে পারেননি। পরবর্তীকালের কুতুবরা আমার নাম বেমালুম চেপে গেছেন, সে-দলে আমার খুলনার এক সাংবাদিকও ছিলেন।
সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি ও রাজনীতি
১৯৪৩ সালে তাজউদ্দীন মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। ছিলেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত তিনি ঢাকা জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে লাহোরে সর্বদলীয় সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা দাবি উত্থাপনকালে তিনি তাঁর সঙ্গে ছিলেন। এ বছরের ৮ মে দেশরক্ষা আইনে তিনি গ্রেফতার হন। ১৯৬৮ সালে জেলে থাকা অবস্থাতেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে পুনঃনির্বাচিত হন। ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে তিনি জেল থেকে মুক্তিলাভ করেন। ১৯৭০ সালে তৃতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পরও ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করায় বঙ্গবন্ধুর ডাকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। তাজউদ্দীন আহমদ সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বার্থে একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার সংকল্প গ্রহণ করেন।
৩০ মার্চ সন্ধ্যায় তাজউদ্দীন ফরিদপুর কুষ্টিয়া পথে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তে পৌঁছান। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ৩১ মার্চ মেহেরপুর সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পদার্পণ করেন। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মহাপরিদর্শক গোলক মজুমদার তাঁদের ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক কেএফ রুস্তামজীর কাছে নিয়ে যান। বিএসএফ প্রধানের পরামর্শে তিনি দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে তাজউদ্দীন নিজেকে প্রধানমন্ত্রী রূপে তুলে ধরেন। ওই বৈঠকে তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য অনুরোধ জানালে ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে যথাসময়ে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিদানের আশ্বাস দেন।
৪ এপ্রিল দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দীনের আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়। ১০ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ ঘোষণা করা হয়। ১১ এপ্রিল তাজউদ্দীন বেতারে ভাষণ দেন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। তাজউদ্দীন হন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
অস্থায়ী সরকার গঠনের পর তাজউদ্দিন আহমেদ ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে সীমান্তে গেলে ভারতীয় বাহিনী তাঁকে গার্ড অব অনার দিয়ে ভারতে নিয়ে যায়।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর ২৭ ডিসেম্বর তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দ ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে এলে তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান। তিনি অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি সাবেক ঢাকা-২০ আসন বর্তমান গাজীপুর-৪ (কাপাসিয়া) আসন থেকে নির্বাচিত হন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় বাজেট প্রণয়ন করেন।
পরবর্তীকালে ১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর রাজনৈতিক মতদ্বৈততায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ ৩০ বছরের বিশ্বস্ত সহকর্মী তাজউদ্দীন আহমদ মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর তাঁকে প্রথমে গৃহবন্দি ও পরে ২৩ আগস্ট কারান্তরীণ করা হয়। এ বছরেরই ৭ নভেম্বর তাঁকে অন্য তিন জাতীয় নেতা—সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানের সঙ্গে কারাগারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতিক।
এসইউ/জেআইএম