অন্তরালে রয়ে যায় নীলাদের ঈদ
সানজিদা জান্নাত পিংকি
ঈদ মানেই আনন্দের জোয়ার। চাকরিজীবীরা বোনাস পাবেন, শিক্ষার্থীরা দৈনন্দিন রুটিন থেকে কিছুদিনের জন্য মুক্তি পাবেন। ঈদের ছুটিতে সবাই বাড়ি ফিরবে নাড়ির টানে। এমনটাই তো হওয়া উচিত ঈদের গল্প?
তবে আমাদের সমাজে অনেকের বাড়ি ফেরা হয় না, করা হয় না তুমুল আনন্দ। সমাজের অন্য পাঁচ দশজন মানুষের মতো কাটে না তাদের ঈদ। মানবশিশু হয়েও তারা যেন মানবের সব অধিকার, আনন্দ থেকে বঞ্চিত। সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তাদেরকে মহিমাময় ঈদের নির্মল আনন্দে নিজেদের মতো করে অংশগ্রহণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
ঈদ মানে বৈষম্যহীন আনন্দের জোয়ার। জনজীবনে ‘জীবন’ যোগের নতুন একটি প্রয়াস। কিন্তু উপেক্ষিত এক অধ্যায় সমাজের গড়ে তোলা প্রাচীরের অন্তরালেই থেকে যায় গগনবিদারী আর্তনাদ নিয়ে। কারণ তারা তৃতীয় লিঙ্গের অধিকারী। তেমনি একজন নূর আলম নীলা। সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে (গবি) কাজ করছেন নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে।
শৈশবে সমাজের বাকি মানুষদের মতোই মহানন্দে ঈদ কাটতো নীলার। ছিলনা কোনো ধরাবাধা গন্ডি। সবার আদরে আবদারেই কাটতো ঈদগুলো। পরিবার থেকে পাওয়া উপহারের কথা ভাবলে এখনো মনের অজান্তেই একটা শিহরণ বয়ে যায় তার শরীরে। এখনো স্পষ্ট মনে আছে ঈদের দিনে হুট করে গিয়ে উপস্থিত হতেন ফুপু কিংবা খালার বাসায়। সে সময়ের ঈদগুলো ছিল রঙিন-প্রফুল্ল।
কিন্তু এই রঙিন দিনের স্থায়ীত্ব ছিল ক্ষণিকের। হঠাৎ করেই নীলার ‘মানুষ’ হিসেবে ঈদ উদযাপন ফুরিয়ে যায়। একটা সময় নিজেকে অন্যভাবে আবিষ্কার করেন। অন্যদের থেকে আলাদা অবয়বে নিজেকে পেতে শুরু করেন নীলা। মানুষ থেকে পরিচয় বদলে হয় ‘৩য় লিঙ্গের মানুষ’। বাধ্য হয়ে ছাড়তে হয় পরিবার, বাড়িঘর।
এভাবেই মিলিয়ে যায় নীলার জীবনের সব ঈদ। রঙিন ঈদগুলো হতে থাকে ধূসর। ঈদগুলো কাটতে থাকে ঘরের কোণে, সঙ্গী হয় টেলিভিশন। মায়ের হাতের খিচুড়ি আর পায়েস ছাড়া ঈদ যার কাছে অসম্ভব বিষয় ছিল, তাকে নিজে নিজেই সব করতে হয়। এখনকার ঈদে কেউ উপহার দেয় না। ঈদের বাজার থেকে শুরু করে রান্না সব নিজে একাই করেন তিনি। তবে মায়ের রান্নার কথা ঠিকই মনে পড়ে, কল্পনাতে আসে ভাইয়ের সঙ্গে খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ির মুহূর্তগুলো।
স্মৃতিচারণ করতে করতে কান্নায় ভেঙে পড়েন নীলা। আবার যেন নিজেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলতে শুরু করলেন। তিনি বলেন, ‘১৩ বছর ধরে আমি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। ঈদে কেউ ডাকে না আমাকে। প্রতিটি ঈদ পরিবার ছাড়া করেছি। মা যতদিন ছিলেন, কথা হতো। ভাইদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কথা বলতাম। ঈদে সবার জন্য জামাকাপড় পাঠাতাম। সবাই জানে আমি চাকরি করি। তবুও পরিচয় দিতে অস্বীকার করে,পরিচয় দেওয়াটাই যেন অনেক বড় বোঝা। আমি যোগাযোগ না করলে, তারা নিজে থেকে খোঁজ নেয় না’।
নীলা আরও বলেন, ‘পরিবারের একটা সন্তান যদি পঙ্গুও হয়, তাকে তো মা বাবা অস্বীকার করে, বিচ্ছিন্ন করে দেয় না। আমাদেরকেই কেন? বিধাতা আমাকেও তো মানুষ বানিয়েছেন। এই সমাজ কেন আমাকে আলাদা বিশেষণ দিয়ে আলাদা করে দিলো?’
ঈদ মানেই যেন নীলার কাছে আলাদা করে একটা শোকের পর্ব। তবে এতগুলো বছরে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন তিনি। এখন ঈদে নিজের জন্য সবকিছু করেন। সহকর্মীদের বাসায় ঘুরতে যান, সবাই মিলে বাইরে ঘুরে বেড়ান। আলাদা এক জগতে আলাদা এক ঈদ কাটে তাদের। এইতো উপেক্ষিত জীবনে বৃহন্নলাদের ঈদ!
লেখা: শিক্ষার্থী, গণ বিশ্ববিদ্যালয়।
কেএসকে/এএসএম