শিশুর মানসিক বিকাশে অভিভাবকের ভূমিকা
আনিস ফারদীন
সুইজারল্যান্ডের মনোবিজ্ঞানী ‘জিন পাইগেট’ তার ‘সাইকোলজি অব দ্য চাইল্ড’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘মানুষের মন একটি শক্তিশালী একক। এটি সবার মধ্যে সমানভাবে থাকে। শিশু অবস্থায় মনেরভাব প্রকাশ একরকম, আবার প্রাপ্ত বয়সে অন্যরকম। শিশুরা সাধারণত আত্মকেন্দ্রিক হয়ে থাকে এবং তা ৭ বছর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে’।
এক্ষেত্রে পরিবারের অভিভাবকগণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সবকিছু মূল্যায়ন করে থাকেন। পরিবারের বড়দের একটা প্রকট ভূমিকা থাকে শিশুদের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে। তাই আমাদের শিশুদের প্রতি যত্নবান হতে হবে। আমাদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি শিশুদের জন্য রচনা করতে পারে তাদের সুন্দর ও আলোকিত ভবিষ্যৎ। চলার পথকে করে তুলতে পারে মসৃণ এবং আত্মবিশ্বাসের পারদে করে তুলতে পারে পরিপূর্ণ। শিশুদের জন্য পরিবারের অভিভাবকগণ নিম্নের কাজগুলো করার মাধ্যমে তাদের সর্বোচ্চ কল্যাণ সাধনের কাজটি করতে পারেন।
১. পরিবারের ছোটরা ভুল বা অন্যায় কিছু করে থাকলে সরাসরি অভিযুক্ত না করে ভুলের অপকারিতা তার সামনে তুলে ধরুন।
২. শিশুকে উৎসাহ দিন, যেন তার ক্ষমতার সর্বোচ্চটা সে করতে পারে, তবে কখনো নিখুঁত হতে নয়। কারণ নিখুঁত হওয়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়, এমনকি আপনার জন্যও তা অসম্ভব।
৩. শুধু একাডেমিক রেজাল্ট দিয়ে মানুষকে মূল্যায়ণ না করে সার্বিকভাবে তার ভালো দিক মূল্যায়ন করুন। কারণ কে কোন দিকে ভালো করবে তা এখনো আপনার অজানা। শুধু ভালো শিক্ষার্থী হলে চলেনা, ভালো জিপিএ হলে হবে না। ভালো মানুষ হওয়া আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মনুষ্যত্ববোধ সম্পন্ন মানুষ আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য।
৪. স্কুল থেকে ফিরলে শিশুকে জিজ্ঞাসা করুন সে তার স্কুলে আজ কী শিখেছে। নির্ভয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সবকিছু যেন শেয়ার করতে পারে তেমন পরিবেশ সৃষ্টি করুন। এটি করতে পারলে তার সার্বিক মঙ্গলসাধন এবং অযথাচিত বিপদ থেকে তাকে রক্ষা করা সম্ভব।
৫. সব শিশুর অবশ্যই কিছু শক্তিশালী দিক রয়েছে। তবে তা একই সঙ্গে প্রদর্শিত নাও হতে পারে। প্রয়োজন সময়ের এবং আপনার যত্ন। আপনার যত্ন তার আত্মবিশ্বাসের পারদকে উর্ধ্বমুখী করে তুলবে।
৬. উপহাস পেয়ে যারা বড় হয়, তারা বড় হয়ে ভীতু হয়। সমালোচনার মধ্যে দিয়ে বড় হলে সে অপরের নিন্দা করতে শেখে। আপনার সন্দেহের তীর তাকে প্রতারণা করতে পারদর্শী করে তোলে। বিরোধের পরিবেশ শিশুদের মধ্যে জিঘাংসার জন্ম দেয় এবং শত্রুতা শেখায়।
৭. উৎসাহ পেলে শিশুরা আত্মবিশ্বাসী হয়। শিশুর প্রশংসা তাকে অন্যের ভালো গুণগুলো ধারণ করতে সহায়তা করে এবং সুখী পরিবেশ তার মধ্যে ভালোবাসা ও সৌন্দর্যের মাহাত্ম্য তুলে ধরে।
৮. ধর্মীয় শিক্ষা, নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ শিক্ষা একজন শিশু পরিবারের বড়দের থেকে পেয়ে থাকে। তাই শিশুদের এ সময়টাতে সঠিক শিক্ষা প্রদান অভিভাবক হিসেবে আপনার কর্তব্য।
৯. আপনার শিশুকে ভালো কাজের জন্য পুরস্কার দিন। এক্ষেত্রে ভালো বই উপহার দিতে পারেন। একটি ভালো বই একজন শিশুর ভাবনাকে বদলাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন একজন শিশুর মাঝে এক অসাধারণ উপলব্ধির সমাবেশ ঘটাতে পারে, যা তাকে নতুন দিগন্ত উন্মোচনে অণুপ্রাণিত করবে। তাই সুযোগ পেলে শিশুকে নিয়ে বাহিরে কোথাও ঘুরে আসুন।
১০. সর্বোপরি একজন শিশুকে অন্যকে সাহায্য করার জন্য সুযোগ করে দিন। তাকে সরি বলতে শেখান। অন্যকে ক্ষমা করার মাহাত্ম্য তার সামনে তুলে ধরুন। একটি সহযোগিতা মূলক কাজের ক্ষেত্র গড়ে তুলুন যা একজন শিশুকে নেতৃত্ব দিতে সাহায্য করবে। পাশাপাশি নিজের দেশের কল্যাণে যাতে সে একজন আদর্শবান এবং ভালো নাগরিক হয়ে গড়ে উঠে সে দিক্ষা দিন।
আমাদের অভিভাবকদের সার্বিক সহযোগিতা আমাদের ছোটদের/ শিশুদের জন্য রচনা করতে পারে তাদের জন্য সর্বোচ্চ কাঙ্ক্ষিত কল্যাণ। তাই শিশুদের জন্য যত্নবান ও মনোযোগী হওয়া আমাদের বড়দের অপরিহার্য ও নৈতিক দায়িত্ব।
লেখক: প্রভাষক, দর্শন বিভাগ, চাঁদপুর সরকারি কলেজ, চাঁদপুর।
কেএসকে/এএসএম