অমীমাংসিত মুহুরীর চরে ক্রিকেটের জয়গান
বখতিয়ার আবিদ চৌধুরী
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সীমান্ত সংঘাত-উত্তেজনার খবর বেশ পুরোনো। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত প্রায়শই এমন বিভিন্ন সংবাদের শিরোনামে উঠে আসে, কখনো কখনো এপারের শ্যামা ওপারে কিংবা ওপারের শ্যামা এপারে আসতেও শঙ্কায় থাকে! তবে পরশুরামের বিলোনীয়া সীমান্ত ঘেঁষা অমীমাংসিত মুহুরী নদীর চর কিছুটা হলেও ভিন্ন কথা বলছে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এ চর নিয়ে সীমান্ত জটিলতা থাকায় বহু বছর ধরে এখানে কোনো চাষাবাদ হয় না। অনাবাদি থাকার ফলে এটি বিস্তীর্ণ সমতল ভূমিতে রূপ নিয়েছে, সরলভাবে বলতে গেলে ক্রিকেট বা ফুটবল খেলার জন্য যে-ধরনের আদর্শ মাঠের প্রয়োজন পড়ে এটি ঠিক তেমনই! এলাকার ক্রীড়াপ্রেমী কিশোর-তরুণরা তাই মৌসুম ভেদে ক্রিকেট ও ফুটবল খেলায় মেতে থাকে প্রায় সারা বছর।
বর্ষার পুরো সময়জুড়ে এটি ক্রিকেট খেলার অনুপযুক্ত থাকে। সে সময়টায় আবার গ্রামের ছেলেরা ফুটবল খেলায় বুঁদ হয়ে থাকে। তবে বর্ষায় মাঝে মাঝে মুহুরী নদী প্রমত্তা রূপধারণ করে। তখন চর কিছুটা প্লাবিত হয়ে যায়, ফলশ্রুতিতে নিরুপায় হয়ে কিছুদিন খেলা বন্ধ রাখতে হয় ক্রীড়াপ্রেমী কিশোর-তরুণদের। এরপর শীত এলেই শুরু হয় ক্রিকেট খেলার তোড়জোড়, তখন চরে গেলেই চোখে পড়বে একঝাঁক প্রাণোচ্ছল কিশোর-তরুণ মিলে ক্রিকেট খেলায় মেতে আছে। পুরো মৌসুমের প্রায় প্রতিদিনই তারা ক্রিকেট খেলে, তবে সীমান্ত নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোনো সংকটের সৃষ্টি হলে বিজিবি কর্তৃক কিছুদিন চরে না খেলার পরামর্শ দেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে খেলা আবার বন্ধ থাকে।
একসময় ভারতীয় ভূখন্ড থেকেও বহু তরুণ চরে খেলতে আসতো বলে শোনা যায়। স্থানীয়দের কর্তৃক আয়োজিত বিভিন্ন টুর্নামেন্টে তাদের সরব উপস্থিতি ছিল প্রত্যাশিত। অমীমাংসিত এ ছোট্ট সীমান্তজুড়ে দু-দেশের মানুষের মাঝে জাতিগত সম্প্রীতির বন্ধন ছিল অটুট। কিন্তু ভারত নিজের পাশটুকু কাঁটাতার দিয়ে বেষ্টনী দেওয়ার পর দৃশ্যপট বদলে যায়। ভারত থেকে ক্রীড়াপ্রেমী তরুণদের আসা বন্ধ হয়ে যায়। তাদের সরব উপস্থিতি বাংলাদেশর তরুণদের কাছে কেবল স্মৃতি হয়ে রয়।
আজহার মাহমুদের বাড়ি চর থেকে প্রায় চারশ মিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে। আজহার স্নাতক শেষ বর্ষের ছাত্র, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত একটি কলেজে পড়াশোনা করছেন তিনি। চরের খেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আজহার বলেন, ‘পাঁচ-ছয় বছর হলো আমি এখানে খেলছি, এর আগে গ্রামের ছেলেদের দেখতাম প্রবল উৎসাহ নিয়ে এখানে খেলছে, চরের এতটা কাছে বেড়ে উঠলেও খেলার সাহস পেতাম না, না জানি কখন কি হয়! একটা শঙ্কা কাজ করত। কিন্তু পাঁচ-ছয় বছর আগে সাহস করে খেলতে নামি, তারপর থেকে নিয়মিত খেলছি। ছোটবেলা থেকে শুনে এসছি কাঁটাতারের বেষ্টনী দেওয়ার আগে ভারত থেকেও বহু মানুষ দলবদ্ধ হয়ে এখানে খেলতে আসত’।
আরও পড়ুন: রিকশা চালানোর ফাঁকে ফুটপাতে বসে তাদের দাবার আসর
আজহারে সঙ্গে চরে দেখা করতে এসেছেন তার মাধ্যমিকের সহপাঠী ও বন্ধু রেজোয়ান আহম্মদ পিয়াস, আজহার তখন ক্রিকেট খেলছিলেন। রেজোয়ান বলেন, আমার বাড়ি পরশুরাম উপজেলার কোলাপাড়া গ্রামে, এখান থেকে বেশ অনেকটা দূরের পথ। আমারও সম্প্রতি আজহারের সঙ্গে এ চরে খেলার অভিজ্ঞতা হয়েছে, আমি বেশ উপভোগ করছি।
অমীমাংসিত সীমান্তে ক্রিকেটের এ জয়গানের কৃতিত্বটা ক্রিকেট নামের খেলাটিরই বটে! কি চমৎকার ভাবে ভুলিয়ে দিলো সীমান্ত দ্বৈরথের সে পুরোনো গল্প। ক্রিকেট তো এমনই, আবেগে সম্মোহিত করে রাখে পুরো দেশকে। আর সে আবেগ ছড়িয়ে যায় মাঠ -পাথার, অলিগলি, রাজপথ আর অনিকেতপ্রান্তরে, মুহুরীর চর তারই একটি ছোট্ট উদাহরণ হয়ে থাকবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ, হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজ।
কেএসকে/জেআইএম