পুরান ঢাকায় সাকরাইনের আমেজ
মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ
পুরান ঢাকার ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে প্রতি বছর পৌষ মাসের শেষদিন আর মাঘের প্রথম প্রহরে পালিত হয় সাকরাইন উৎসব। রং-বেরঙের ঘুড়ি উড়ানো থেকে শুরু করে আগুন নিয়ে খেলা, আঁতশবাজি ও ফানুস ওড়ানোর মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয় সাকরাইন। এদিন পুরান ঢাকার আকাশে নানা রঙের ঘুড়ি ওড়ানো হয়।
পুরান ঢাকার মানুষ একে ‘সাকরাইন’ বললেও তা মূলত ‘পৌষসংক্রান্তি’। অনেকের কাছে সাকরাইন ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব নামেও পরিচিত। সাকরাইনকে ঘিরে পুরান ঢাকার অলিগলিতে বেড়েছে ঘুড়ি বেচাকেনা। শিশু, তরুণ, বৃদ্ধরা কিনছেন নাটাই-ঘুড়ি। চলছে সুতায় মাঞ্জা দেওয়ার কাজ। এরই মাঝে পুরান ঢাকার অলিগলিতে চলছে সাকরাইন উৎসবের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি।
পৌষের শেষদিন ১৪ জানুয়ারি পালন করা হবে সাকরাইন উৎসব। এ উপলক্ষে সাজতে শুরু করেছে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা। সাকরাইনে ঘুড়ি উড়ানোর পাশাপাশি সন্ধ্যায় বর্ণিল আতশবাজি ও রং-বেরঙের ফানুসে ছেয়ে যায় বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী শহরের আকাশ।
সাকরাইন উপলক্ষে সূত্রাপুর, নবাবপুর, শ্যামবাজার, ধূপখোলা, শাঁখারি বাজার, তাঁতীবাজার, লক্ষ্মীবাজার, ফরাশগঞ্জ, সদরঘাট, গেন্ডারিয়া, নারিন্দা, লালবাগ, চকবাজার, মুরগিটোলা, ধোলাইখালসহ বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয়েছে সাকরাইনের আমেজ। বিভিন্ন স্থানে শুরু হয়েছে ঘুড়ি বিক্রি এবং বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয়েছে ছাদ সাজানোর কাজ।
ধূপখোলার ঘুড়ির দোকানগুলোয় পাওয়া যাচ্ছে চোখদার, রকদার, গরুদার, ভোমাদার, কাউঠাদার, মাছলেঞ্জা, ফিতালেঞ্জা, একরঙা, চানতারা, সাপঘুড়ি, প্রজাপতি ঘুড়ি, পেঁচা ঘুড়ি, বাক্স ঘুড়ি প্রভৃতি। আঁতশবাজির মধ্যে আছে পাঁচ শট, বারো শট, একুশ শট, বত্রিশ শট, আশি শট, একশ বিশ শট, দেড়শ শট, কদম ফুল, তাঁরা শট, ঝরনা, ব্যাটারি বোম, চকলেট বোম, শলতা বোম, রকেট বোম, পাতা বোম বা ২৮ বোম, ফ্লেম টর্চ। ফানুসেরও আছে হরেক পদ। তবে আঁতশবাজি ও ফানুষে নিষেধাজ্ঞা থাকায় পুলিশের ভয়ে হাতে হাতে বিক্রি করা হচ্ছে এসব।
প্রতিবছর সাকরাইনে লক্ষাধিক ঘুড়ি বিক্রি করেন শাঁখারি বাজারের ব্যবসায়ীরা। সাকরাইন উপলক্ষে লাখ লাখ টাকার ঘুড়ি, নাটাই, সুতা বিক্রি হয় এ বাজারে। চশমাদার, কাউটাদার, পঙ্ক্ষিরাজ, প্রজাপতি, চক্ষুদার, ঈগল, সাদা ঘুড়ি, চারবোয়া, দুই বোয়া, টেক্কা, লাভ ঘুড়ি, ৩ টেক্কা, মালাদার, দাবা ঘুড়ি, বাদুর, চিল, অ্যাংগ্রি বার্ডসসহ নানা আকৃতির ঘুড়ি বিক্রি হয় শাঁখারি বাজারে। ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য আছে বিভিন্ন ধরনের সুতা আর নাটাই। নাটাই সাধারণত দুই ইঞ্চি থেকে সর্বোচ্চ ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়।
শাঁখারি বাজারের ব্যবসায়ী শঙ্খ শ্রী ভান্ডারের মালিক তারক রায় বলেন, ‘ভালোই বেচাকেনা চলছে আমাদের। পাইকারি কাস্টমার বেশি। ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে ক্রেতারা এসে ঘুড়ি নিয়ে যান। দোকানে ৮-১০ রকমের ঘুড়ি আছে। নাটাই, সুতাও ভালো বিক্রি হচ্ছে।’
রাধামাধব ভান্ডারের শ্রী কাক্কেশ্বর বলেন, ‘অর্ডার কমে গেছে, তারপরও মোটামুটি চলছে। আমরা বছরজুড়েই ঘুড়ি-নাটাইয়ের ব্যবসা করি। সাকরাইন উপলক্ষে অন্যরকম আমেজ সৃষ্টি হয়। মূল ক্রেতা তরুণ-তরুণী। এবার অর্থনৈতিক মন্দার কারণে পরিবার থেকে শিশুদের হাতে সেভাবে টাকা দেওয়া হচ্ছে না।’
শাঁখারি বাজারে গেন্ডারিয়া থেকে ঘুড়ি কিনতে এসেছে রাসেল ও তার বন্ধু আল-আমীন। দুজনই ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। তারা বলেন, ‘আমাদের কাছে এই উৎসব অনেক ভালো লাগে। প্রতিবছর জানুয়ারি মাস এলে আনন্দ লাগে। ঘুড়ি উড়াই, বন্ধুদের সঙ্গে কাটাকাটি করে ভালোই লাগে।’
ধোলাইখাল থেকে মোস্তাকিন আহমেদ তার সন্তানকে নিয়ে বাংলাবাজার এসেছেন ঘুড়ি কিনতে। তিনি বলেন, ‘এক সময় আমরা ঘুড়ি উড়িয়েছি। এখন আমাদের বাচ্চাদের সময়। তাই তাদের জন্য প্রতিবছর ঘুড়ি কিনে দিতে হয়।’
আবু জাফর নামের এক বাসিন্দা বলেন, ‘পুরান ঢাকায় সাকরাইন সবচেয়ে বড় উৎসব। ঘুড়ি উড়ানোর পাশাপাশি পৌষসংক্রান্তির পিঠা উৎসব করা হয়ে থাকে। এ উৎসবে স্থানীয়রা নিজেদের আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত দিয়ে থাকেন।’
সূত্রাপুরের স্থায়ী বাসিন্দা বাদল মুন্সি বলেন, ‘পুরান ঢাকার সাকরাইন একটি ঐতিহ্য, যা ১৭০০ সালের পর থেকে প্রচলিত। ১৪ জানুয়ারি উৎসবটি পালন করা হয়ে থাকে। আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি, এটি আমাদের কাছে আনন্দের দিন। আমরা ঢাকাইয়ারা সব সময় এ ঐতিহ্যকে আগামী প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দিতে চাই।’
তবে পুরান ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা রইছউদ্দীন বলেন, ‘উড়ন্ত আগুন তথা ফানুস, ডিজে, লাউড স্পিকারে গান, আঁতশবাজি ও শব্দদূষণমুক্ত সাকরাইন চাই।’
পুরান ঢাকার বাবুবাজার-আরমানিটোলা সমাজ কল্যাণ সংসদের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বলেন, ‘পুরান ঢাকায় ঘুড়ি উড়িয়ে সাকরাইন উৎসব পালন করা ঐতিহ্যবাহী রেওয়াজ। এর মধ্যে ফানুস উড়ানোর কারণে অনেক সময় অগ্নিকাণ্ডের মাধ্যমে মুহূর্তেই আনন্দ বিষাদে পরিণত হতে পারে। এজন্য ফানুস উড়ানো ও আঁতশবাজি নিষিদ্ধ করা উচিত। এ ছাড়া অপসংস্কৃতির চর্চাও উদ্বেগজনক।’
মহাভারতে সাকরাইন উৎসবকে মকরক্রান্তি বলা হয়। এখন পুরান ঢাকা ছাড়াও ঢাকার অন্য এলাকায় এ উৎসব পালন করা হয়। এদিকে সাকরাইন উৎসবে ফানুস বিক্রি, ওড়ানো বন্ধে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার। সাকরাইন উৎসবে রাজধানীবাসী যাতে ফানুস ওড়াতে না পারেন এবং দোকানিরা ফানুস বিক্রি করতে না পারেন, সে বিষয়ে থানায় থানায় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ‘থানায় থানায় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পুরান ঢাকাসহ বেশ কয়েকটি বড় মার্কেটের ব্যবসায়ীদের আমরা বুঝিয়েছি, কেউ যাতে ফানুস বিক্রি করতে না পারে।’
তিনি বলেন, ‘সাকরাইন উৎসব উদযাপনের কয়েক দিন আগে থেকেই কাজ শুরু করে দিয়েছে সংস্থাটি। বিশেষ এ রাতে সব ধরনের বিস্ফোরক দ্রব্য, আঁতশবাজি, পটকা ফোটানো বা ফানুস ওড়ানো বন্ধ করতে এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে ঢাকা মহানগরীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীটি।’
লেখক: শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী।
এসইউ/এমএস