গোয়েন্দা জোট ‘ফাইভ আইসের’ কাজ কী?
বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত এবং সমালোচিত গোয়েন্দা জোট, যার জন্ম হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গর্ভে এবং যা লালিত হয়েছিল শীতল যুদ্ধের বক্ষে। বলছিলাম পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে জটিল এবং সুদূরপ্রসারী গোয়েন্দা ও গুপ্তচর সহযোগিতা সংস্থা, ফাইভ আইসের কথা।
বিশ্বের পাঁচ ইংরেজি ভাষাভাষী দেশের বাঘা বাঘা গোয়েন্দা সংস্থার মিলিত এক জোট এই ফাইভ আইস। ফাইভ আইস এমন একটি গোয়েন্দা জোট যার উদ্দেশ্য ও কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ তো বটেই, জোটভুক্ত দেশের কর্তাব্যক্তিরাও পর্যন্ত ভালোভাবে অবগত থাকেন না।
এই জোট এতই গোপনীয়তার সঙ্গে কাজ পরিচালনা করে থাকে যে এর অস্বিত্ব এবং অপারেশনগুলো সম্পর্কে কিছুই জানতেন না স্বয়ং গঘ হুইটলাম যিনি কি-না এই জোটভুক্ত এক দেশ-অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এত কঠোর আর শক্তিশালী নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে ফাইভ আইসের খুব অল্প সংখ্যক ডকুমেন্টই সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত।
এমনকি প্রায় ৮০ বছর ধরে পরিচালিত হওয়া এই জোটের ব্যাপারে ২০০৩ সালের আগেও সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ধারণাই ছিল না। ২০১৩ সালে যখন সাবেক এনএসএ কনট্রাক্টর এডওয়ার্ড স্নোডেন ফাইভ আইস গোয়েন্দা জোটের কিছু ডকুমেন্ট ফাঁস করলেন ঠিক তখন থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে এর সম্পর্কে আগ্রহ জন্মাতে থাকলো।
১৯৪১ সাল, পৃথিবীর ইতিহাসে তখন চলছে সবচেয়ে ভয়াবহ এবং রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ঠিক সে সময় দ্য আটলান্টিক চার্টার স্বাক্ষর করার আগে পারস্পরিক আস্থা এবং সহায়তা মজবুত করতে ব্রিটিশ এবং আমেরিকান গুপ্তচর এবং গোয়েন্দা সদস্যরা মিলিত হচ্ছিলেন বিভিন্ন গোপন মিটিংগুলোতে। এ সময় এই দুই দেশ মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবীকে ঘিরে নানান পরিকল্পনার ছক আটছিল।
সেই আলোকেই তারা ১৯৪১ সালের ১৪ আগস্ট দ্য আটলান্টিক চার্টার ইস্যু করে। আর সেই সনদের হাত ধরেই ১৯৪৬ সালের ৫ মার্চ অর্থাৎ শীতল যুদ্ধের সময়ে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরকার গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের আদান-প্রদানকে সমুন্নত রাখতেই জন্ম নেয় ইউকেএসএ বহুপাক্ষিক চুক্তিপত্র। যার বিস্তৃত রূপই আজকের ফাইভ আইস।
প্রথমদিকে যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্যের হাত ধরে চলতে শুরু করলেও ১৯৪৮ সালে কানাডা যুক্ত হয়ে এই ইউকেএসএ চুক্তিকে আরেক ধাপ সম্প্রসারিত করে। আবার এই চুক্তিটি ভিন্ন মাত্রা পায় আরও দুই ইংরেজি ভাষা-ভাষী দেশের যোগদানের মধ্য দিয়ে। স্বার্থ ও উদ্দেশ্যের অভিন্নতার কারণে ১৯৫৬ সালে নিউজিল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার যোগদানের মাধ্যমে এই জোট ফাইভ আইস গোয়েন্দা জোট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
শীতল যুদ্ধের সময়টাতে ব্রিটিশ এবং আমেরিকান সৈন্যদের কাছে ফাইভ আইসের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। কারণ এ্রর মাধ্যমেই সে সময় উত্তর আটলান্টিক মহাসাগর এবং উত্তর সাগরে সোভিয়েত ব্যালেস্টিক মিসাইলের সঙ্গে সাবমেরিনগুলোর গতিপথ অনুসরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ মিশনগুলো পরিচালিত হত। এমনকি এই দুইদেশের পারস্পারিক আস্থা, বিশ্বাস এবং বন্ধুত্ব আরও গভীর হওয়ার পেছনেও ছিল ফাইভ আইসের অবদান।
লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কার্যকলাপ
আগেই বলেছি কঠোর গোপনীয়তা ও শক্তিশালী নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে ফাইভ আইসের কর্মপরিকল্পনা বা কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য জানা যায় না। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ফলে ফাইভ আইসে কৌশলগত পরিবর্তন আসে।
জন্মলগ্ন থেকেই রাশিয়া এবং চীনকে ঝুঁকি হিসেবেই দেখে আসছে এই সংস্থাটি। ফাইভ আইসের পাঁচটি দেশের মধ্যে সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেমন তারা প্রত্যেকেই একই জাতীয় স্বার্থ ও সংস্কৃতি লালন করে এবং উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী। প্রকৃতপক্ষে এসব সাদৃশ্যতাই এই পাঁচ দেশকে একই সুতোয় গাঁথতে সমর্থ হয়েছে।
ফাইভ আইসের এই জোটে যুক্ত আছে এফবিআই, এনএসএ, এম ফিফটিন, এম সিক্সটিন, সিএইচকিউ, সিআইএয়ের মতো বড় বড় গোয়েন্দা ও গোপন সংস্থাগুলো।
ফাইভ আইস রাশিয়া, চীন এবং পৃথিবীর বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো থেকে তাদের জোটভুক্ত ইংরেজি ভাষাভাষী দেশগুলোর নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সব সময় বদ্ধপরিকর। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী জনসমষ্টির বিভিন্ন তথ্য পর্যবেক্ষণ ও যাচাইয়ের মধ্য দিয়ে এই জোটভুক্ত দেশগুলোর জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণই ফাইভ আইসের উদ্দেশ্য। এই গোয়েন্দা জোটের প্রতিটি দেশই বিশ্বের আলাদা আলাদা এবং সুনির্দিষ্ট অঞ্চলগুলোর ওপর পর্যালোচনা করে থাকে এবং তাদের সেসব সুনির্দিষ্ট অঞ্চলের গোয়েন্দা তৎপরতা সম্পর্কেও জবাবদিহি করতে হয়।
যেমন, আমেরিকার দায়িত্বে আছে রাশিয়া, চীন, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলগুলো। আবার ব্রিটেন নিয়ন্ত্রণ করে মধ্যপ্রাচ্য, পশ্চিম রাশিয়ার অঞ্চলসমূহ, হংকং এবং ইউরোপ। এভাবে ক্যানাডা নিয়ন্ত্রণ করে লাতিন আমেরিকার অংশ এবং চীন ও রাশিয়ার মধ্যভাগ। নিউজিল্যান্ড যেখানে দেখে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এবং দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর, অস্ট্রেলিয়ার দায়িত্বে আছে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়া।
তবে কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের ওপর নজর রাখার মানে এই নয় যে এই পাঁচটি দেশ নির্দিষ্ট করে রাখা অঞ্চলের বাইরে নজরদারী করতে পারবে না। বরং তারা সর্বদা একে অন্যকে সর্বাত্মক সাহায্য করতে সচেষ্ট থাকে। দায়িত্ব এ রকম ভাগ করা থাকলেও ফাইভ আইস একসঙ্গেই কাজ করে এবং যে কোনো সিদ্ধান্ত জোটভুক্ত সব দেশের সম্মতিতেই গ্রহণ করে থাকে।
ফাইভ আইস গোয়েন্দা জোটের কার্যপ্রণালী বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় বিভক্ত। এই জোটের মারিটাইম ডোমেইনের কাজ হলো কৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক অঞ্চলগুলোতে জাহাজ স্থানান্তর সংক্রান্ত কার্যকলাপ অনুসরণ করা। আবার যুদ্ধবিমান সংক্রান্ত কাজগুলো নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্বে আছে তাদের এরিয়েল ডোমেইন।
এরিয়েল ডোমেইনে তাদের যুদ্ধবিমান দুই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন পরিচালনা করে যার মধ্যে আছে বিভিন্ন গুপ্তচর স্যাটেলাইটের প্রতিস্থাপন করা আরেকটি হলো ব্যালেস্টিক মিসাইল পরীক্ষা করা। অস্ত্র ব্যবসাসহ সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে এই সংস্থাটি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখে তাই এসব বিষয়ে কোনো তথ্য পেলে তারা তাদের দেশগুলোর সরকার প্রধানদের অবহিত করে।
আবার ফাইভ আইস সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুবিধার্থে সংশ্লিষ্ট বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন প্রকার ডাটা সরবরাহকরণ ও পর্যালোচনার মতো কাজও করে থাকে। এই গোয়েন্দা জোটের আরেকটি প্রধান কাজ হলো সম্ভাব্য সন্ত্রাসী ও ঝুঁকিপূর্ণ সংগঠনগুলোকে চিহ্নিত করা এবং নজরদারির মাধ্যমে সেগুলোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
অনেকগুলো দেশ ফাইভ আইসের থার্ড পার্টি দেশ হয়ে কাজ করে থাকে। ফ্রান্স, ডেনমার্ক, নরওয়ে, নেদারল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত এবং এসব দেশের সম্মিলিত রূপ গড়ে উঠেছে নাইন আইস, ফোর্টিন আইস, ফোর্টি ওয়ান আইস হয়ে। এসব জোটগুলো একত্রিত হয়েছে একই লক্ষ্যে আর তা হলো বিশ্বের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের বিবিধ কাজের তথ্য পর্যবেক্ষণ এবং তা হস্তান্তরের মাধ্যমে নিজেদের জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।
অতীত কার্যকলাপ
ভিয়েতনাম যুদ্ধে, ফাইভ আইসের অন্যতম দুই সদস্য দেশ নিউজিল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়া আমেরিকাকে সাহায্য করে। তারা উত্তর ভিয়েতনামের বিমান প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের দিকে নজরদারির মাধ্যমে আমেরিকান সৈন্যদের বিভিন্ন তথ্য সরবরাহের কাজে যুক্ত থাকে।
গলফ যুদ্ধ শেষে অস্ট্রেলিয়ান গোয়েন্দা সংস্থা (এসআইএস) থেকে কুয়েতি সরকারি অফিসে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ ওঠে। আবার সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগী অঞ্চলসহ চীনের সামরিক এবং কূটনৈতিক যোগাযোগের তথ্যাদি ব্রিটেন ও আমেরিকা তাদের নিজেদের ভেতর হস্তান্তর করেছে বলে জানা যায়।
পরিধি সম্প্রসারণ
যেহেতু চীন ও রাশিয়া ক্রমেই বিশ্বে তাদের দাপট বাড়িয়েই চলেছে, এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করেই ফাইভ আইসের পরিধি সম্প্রসারণের কথা ভাবা হচ্ছে। শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষা-ভাষী দেশের ভেতরই নয়, বরং এই গন্ডির বাইরে গিয়ে জাপান, কোরিয়া, ভারত ও জার্মানিকে এই জোটভুক্ত করার প্রস্তাবনা উঠেছে। এই প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন হলে ফাইভ আইস পরিবর্তিত হয়ে নাইন আইস নামে কার্যপরিচালনা করবে।
সমালোচনা
২০১৩ সালে উইকিলিকস সাবেক এন এস এ কন্ট্রাক্টর এডওয়ার্ড স্নোডেন প্রকাশ করেন ফাইভ আইস তাদের জোটভুক্ত দেশের সাধারণ নাগরিকদের ওপর অবৈধ নজরদারি চালাচ্ছে। যাতে জাতীয় নিরাপত্তার নামে বিঘ্ন ঘটছে নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা। ফাইভ আইস বিভিন্নভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারকারিদের ব্যক্তিগত তথ্যাদিতে নজরদারি করে থাকে।
এমনকি বিশ্বের বেশিরভাগ ইন্টারনেট ব্যবহারকারিই এর আওতাধীন। নজরদারির মধ্যে থাকা ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের সার্চ হিস্ট্রি, তারা কখন কোন ওয়েবসাইটে যাচ্ছেন, কতক্ষণ ধরে থাকছেন সেসব ওয়েবসাইটে, তাদের ব্যক্তিগত তথ্যাদি, এমনকি আইপি অ্যাড্রেসও থাকে গোয়েন্দাদের নখদর্পণে। তাই ফাইভ আইসের জোটভুক্ত কোনো দেশে থাকা অবস্থায় যেকোনো সময় ইন্টারনেট ট্র্যাক হওয়া খুবই স্বাভাবিক বিষয়।
আপনি জেনে হয়তো অবাক হবেন, জাতিসংঘ, ইয়াহু, গুগল, আল-জাজিরা, মাস্টারকার্ড, হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বড় বড় ও নামকরা প্রতিষ্ঠাগুলোও ফাইভ আইসের নজরদারির বাইরে নেই। আবার যদি স্বতন্ত্র মানুষের কথা বলি তবে বলতে হবে চার্লি চ্যাপলিন, ন্যালসন ম্যান্ডেলা, প্রিন্সেস ডায়ানা, জন লেননের কথা যারা কি না ফাইভ আইসের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন।
সমাজতান্ত্রিকতার দিকে ঝোঁকেপড়া চার্লি চ্যাপলিনকে এফবিআইয়ের সহযোগী হয়ে এম ফিফটিন নজরদারিতে রেখেছিল। নেলসন ম্যান্ডেলা সন্ত্রাসী উপাধি পেয়ে এম সিক্সটিনের নজরদারিতে ছিলেন। প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যু যদিও এখনও ধোঁয়াশাই রয়ে গেছে, তবে জানা যায় তিনি জি সি এইচ কিউ ও এন এস এ’র নজরদারিতে ছিলেন।
এবার আসি সংগীত শিল্পী ও গীতিকার জন লেনিনের কাছে। তিনি ছিলেন একজন যুদ্ধ বিরোধী মানুষ এবং হ্যাপি এক্সমাসের মতো যুদ্ধকে ঘৃণা করে তার অনেক কালজয়ী গানও রচিত হয়েছে। জন লেনিন ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতাও করেছেন। সম্ভবত এ কারণে তিনি এফবিআই এবং এম ফিফটিনের নজরদারিতে ছিলেন।
এ সমস্ত বিষয়ের জন্য ফাইভ আইস সর্বদা সমালোচিত হয়ে এসেছে। তবে প্রায় ৮০ বছরের দীর্ঘ পদযাত্রায় ফাইভ আইস এতটাই প্রখর এবং শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে পৃথিবীর সবগুলো গোয়েন্দা জোটগুলোর মধ্যে একেই স্বর্ণমান হিসেবে ধরা হয়। প্রকৃতপক্ষে তথ্যপ্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে ফাইভ আইসের কর্মপরিধি ও শক্তি উভয়ই বৃদ্ধি পেয়েছে।
এমআরএম/কেএসকে/এএসএম