ডিজিটাল যুদ্ধ শিগগিরই দেখবে বিশ্ব!
যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কালো, হলদে, বেগুনি মেঘে মেঘে ছেয়ে গেলো আকাশ! কোনো বিমানই এই মেঘমণ্ডলী পার হতে পারছে না। ইঞ্জিন অকেজো হয়ে যাচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত অবস্থা দাঁড়ালো এই- অদ্ভূত রংঙের মেঘ দেখলেই আক্রমণের কথা ভুলে যায় শত্রুর বিমান বাহিনী। ডানা গুটিয়ে মাটিতে বসে রইলো বিমান বহর। বিপত্তি আরও বাঁধলো। অদ্ভূত আঁঠায় আটকে গেলো ট্যাংক, সাঁজোয়া বহর। এক চুলও নড়ছে না।
কারও সাধ্য নেই, টেনে নাড়াবে। ডিজিটাল গেজেট অ্যান্ড্রয়েড, জিপিআরএস, ওয়াইফাই কোনো কিছুই আর কাজ করছে না। রাডারসহ সব রকমের সেন্সর কানা হয়ে গেলো। সেই সঙ্গে রাস্তাঘাট হয়ে গেলো অসম্ভব পিচ্ছিল। অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক কোনোরূপ যানবাহনের পক্ষেই ওইসব পথ পাড়ি দেয়া সম্ভব না।
কিংবা যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদের একযোগে অদ্ভূত রোগে ধরলো। মাথাব্যথা, বমি ও মানসিক বিকার ইত্যাদি। তারপর একে একে সবাই ঘুমিয়ে পড়তে শুরু করলো। একটি গুলিও আঘাত হানলো না। একজন সৈন্যও মরলো না। সবাই কেবল ঘুমিয়ে পড়লো, যুদ্ধ শেষ। হেরে গেলো সুশিক্ষিত ও সুসজ্জিত আধুনিক পরাশক্তিধর বিশাল বাহিনী। তাদের বিরুদ্ধে অর্জিত হলো রক্তপাতহীন জয়।
এটা কোনো ‘বিজ্ঞান কল্পকাহিনী’ বা সায়েন্স ফিকশন নয়। অদূর ভবিষ্যতের বাস্তব যুদ্ধক্ষেত্রের বর্ণনা দিয়েছে লন্ডনের বিখ্যাত দৈনিক ‘দ্য গার্ডিয়ান’। চলতি শতাব্দীতেই এমন রক্তপাতহীন যুদ্ধ দেখবে বিশ্ব। রক্তপাতহীন যুদ্ধের কথা প্রথম বলেছিলেন, চীনা যুদ্ধ বিশারদ সুনজু।
তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের জন্য মানুষ মারার কোনো দরকারই নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগন এমন অস্ত্রের সন্ধানেই এখন মেতে উঠেছে। প্রাণে মারবে না। কিন্তু শত্রু পক্ষকে কাবু করবে। বর্তমানে এমন কিছু অস্ত্র নিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষা চালাচ্ছে মার্কিন সেনাবাহিনী। ইংরেজিতে এসব অস্ত্রকে বলা হয় নন লিথ্যাল ওয়েপন।
শব্দ অস্ত্র
আগামী দিনের যুদ্ধে নীঁচু কম্পাংকের শব্দ তরঙ্গ দিয়ে দুশমন বাহিনীর মানসিক বিকার ঘটিয়ে দেয়া যাবে। সেই একই শব্দ তরঙ্গের মাত্রার হেরফের ঘটলে অবস্থা আরও গুরুতর হয়ে উঠবে। মাথা ব্যথা, বমি বমি ভাব আর পেট ব্যথায় শত্রু সৈন্য কাহিল হয়ে পড়বে। কাঁদানে গ্যাসের নাম জানে না এমন নেতা বোধ হয় বাংলাদেশে একজনও নেই।
তবে একটা কথা বোধ হয় অনেকের মনে নেই যে, কাঁদানে গ্যাস কিন্তু পুলিশের ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়নি। তৈরি করা হয়েছিলো যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য। যুদ্ধ বাঁধলে যুদ্ধক্ষেত্রের সৈন্যের জমায়েত ভাঙানো হবে এই শব্দ তরঙ্গ দিয়ে। শব্দ উৎপাদনকারী জেনারেটর বন্ধ করে দিলে সব আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে। পরিবেশের কোনো ক্ষতি করবে না এই অস্ত্র। মারা পড়বে না মানুষ।
লেজার বন্ধুক
গেম খেলতেও আজকাল শিশুদের হাতে ব্যবহৃত হয় লেজার লাইট। এই লেজার ব্যবহৃত হবে আগামী যুদ্ধের মাঠে। উচ্চ মাত্রার লেজার বন্দুক শত্রুর চোখ অন্ধ করে দেবে। সৈন্যদের অস্ত্রের অপটিক্যাল সেন্সরের কাজে বিঘ্ন ঘটাবে।
আধুনিক ডিজিটাল অ্যান্ড্রয়েড গেজেট ওয়াই ফাই, জিপিআরএস সেন্সর সবকিছু অচল হয়ে যাবে। হ-য-ব-র-ল বাঁধিয়ে দেবে হাল আমলের নানান নামের বৈচিত্র্যময় যন্ত্রপাতিতে। একই অস্ত্র প্রয়োগ করা যাবে মানুষের বিরুদ্ধেও। এই বন্দুক দিয়ে সেনাবহিনীকে সাময়িকভাবে অন্ধ করে দেওয়া যাবে।
চাইলে চিরদিনের জন্য অন্ধ করেও দেওয়া সম্ভব হবে। অবশ্য তখন আর সে অস্ত্র অহিংস থাকবে না। তবে গবেষকরা বলছেন, ব্যাপক সামাজিক সমস্যার জন্ম দেবে ওই লেজার বন্দুক। কারণ জঙ্গিরাই আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের উপর পাল্টা লেজার হামলা করতে পারে। দুষ্টুরা হীন স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে এই লেজার বন্দুক।
ঘুমের ওষুধ
ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো, বর্গী এলো দেশে- এই ছড়ায় দুরদর্শিতা ছিলো বলে হয়তো ভুল হবে না। আগামী দিনের বর্গীরা ঘুম পাড়িয়ে তবেই ঢুকবে দেশ দখল করতে। তারা ঘুম পাড়ানি ওষুধ ছড়িয়ে দেবে দু’ভাবে।
গুঁড়া গুঁড়া মিহি ওষুধ বিমান থেকে ছিটাবে। নয়তো শত্রু অবস্থানের দিকে ওষুধের ঘন কুয়াশা পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। সঙ্গে সঙ্গে লাখ লাখ মানুষ, অপরাধী, বা সৈন্য ঘুমের জগতে চলে যাবে।
পলিমার বাতাস
আগামী দিনের যুদ্ধ বিমানকে অকেজো করা হবে পলিমার বাতাস দিয়ে। এই পলিমারযুক্ত বাতাস বিমানে প্রবেশ করলে তাপে পলিমার গলে লেপটে যাবে। ফলে বিমানের জেট বন্ধ হয়ে যাবে। শত্রু বিমান কাবু হয়ে ঝরে পড়বে আকাশ থেকে।
সাইবার হ্যাকিং
হ্যাকিং কি জিনিস, বাংলাদেশের মানুষ জানে রিজার্ভ হ্যাকিংয়ের পর। এ নিয়ে বাংলাদেশে যত কথা হয়েছে, স্বাধীনতার পর সব মিলিয়ে হয়তো অতো কথা হয়নি। কারণ? এই হ্যাকিং মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে বাংলাদেশের মতোই চীন, রাশিয়া, আমেরিকাসহ নানান দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে।
অনলাইন অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা চুরি, কোনো ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ, ভাইরাস বা ক্ষতিকর প্রোগ্রামের মাধ্যমে আক্রমণ, অন্য কোন ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে বা নেটওয়ার্কে বা কম্পিউটারে ঢুকে সেখান থেকে জরুরি দরকারি তথ্য গ্রহণ, মুছে ফেলা, কোনোভাবে পরিবর্তন করা যা ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষতিকারক ইত্যাদি সব কাজই হ্যাকিং।
আগামী যুদ্ধে এই হ্যাকিং বেড়ে যাবে। হ্যাকিং ছাড়াও আগামী দিনে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় স্পন্দন বা ইলেক্ট্রো মেগনেটিক পালসও মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। এই স্পন্দন দিয়ে ইলেক্ট্রনিক্স সরঞ্জাম ও অনলাইন অফ লাইন কম্পিউটার ব্যবস্থাকে ঘায়েল করা সম্ভব হবে।
তাই নিজস্ব ইলেক্ট্রনিক্স ও কম্পিউটার ব্যবস্থাকে এ ধরণের হামলা থেকে বাঁচানোর জন্য এখনই মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করছে মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমে সাধারণত কড়া নিরাপত্তা বজায় রাখা হয়।
কসটিক কেমিক্যাল
ক্ষয়কারী রাসায়নিক পদার্থ বা কসটিক কেমিক্যাল দিয়ে ট্যাঙ্ক বা সাঁজোয়া বহর ঠেকানো হবে। পুল, ব্রিজ বা রেল সড়কের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো অতি দ্রুত ক্ষয় করে ফেলবে এসব রাসায়নিক পদার্থ। সাঁজোয়া বহর বা ট্যাঙ্ক এতটুকুও এগিয়ে যেতে পারবে না।
এই জাতের অন্যান্য রাসায়নিক ভাণ্ডারে আছে আঁঠালো, পিচ্ছিল ও দ্রুত জমাট বাঁধতে পারে এমন সামগ্রী। অতি কড়া এই আঠা ছড়িয়ে দেয়া হলে সৈন্য বা ট্যাঙ্ক কেউ সে পথ অতিক্রম করতে পারবে না। অন্যদিকে এই কেমিক্যালের বিকট দুর্গন্ধ সহ্য করা অসহ্য। মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। ওত পেতে থাকা শত্রুসেনা সে গন্ধে পালাই পালাই করে পালানোর পথ পাবে না।
জাদুটোনা
জাদুটোনা, কোয়ান্টাম, হিপনোটাইজেশন, তুকতাক দিয়ে কি ১০০ ভেড়া মারা যাবে? ফরাসি চিন্তাবিদ ভলতেয়ারকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো। অবশ্যই যাবে, যদি সঙ্গে প্রয়োজনীয় মাত্রায় সেঁকো বিষ মিশিয়ে দেওয়া হয়। ভলতেয়ার জবাব দিয়েছিলেন। আধুনিক কোয়ান্টাম, জাদু টোনা, বাণ, তুকতাক যতই হাস্যকর মনে হোক না কেন, তার প্রয়োগ ঘটবে আগামী দিনের যুদ্ধে।
কেবল সেসবের নাম বদলানো হবে। বলা হবে অতিন্দ্রীয় ক্ষমতা। সৈন্যরা ইচ্ছে করলেই নিজেদের চেতনা দিয়ে শত্রু সৈন্যের সদর দফতরের ভেতরের খবর সংগ্রহ করতে পারবে। এমনকি যুদ্ধের পরিকল্পনাও মানসচক্ষে দেখতে পারবে। কোনো সিসি ক্যামেরা, হাইড ক্যামেরা, গুপ্তচর নিয়োগের দরকার হবে না।
আড়ি পাততেও হবে না। শুধু মনের জোরেই এমনটা করা যাবে। শুধু তাই নয়। এই মনের জোরে অর্থাৎ বাণ মেরে শত্রুবাহিনীকে রোগ-শোকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলা যাবে। প্রয়োজনে প্রাণে নিকেশ করে দেওয়া যাবে পর্যন্ত। এই মারণাস্ত্রের নাম রাখা হয়েছে সাইকোট্রনিক।
কোনো রকম মানবিক আবেগে তাড়িত হয়ে এ ধরণের গবেষণায় নামেনি পেন্টাগন। প্রচলিত অস্ত্র রক্ষণাবেক্ষণ কষ্টসাধ্য ও ব্যয় বহুল। তাছাড়া রাশিয়া- ইউক্রেন, ভিয়েতনাম, সোমালিয়া, আফগানিস্থান ও ইরাক থেকে শিক্ষা নিয়েছে মার্কিন বাহিনী।
রক্তপাত এড়ানো গেলে যুদ্ধের ঝাঁজ কমে যায়। খুনি নাম ঘুঁচে যায়। আর তাই যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, গবেষক ও বিজ্ঞানীরা সবাই মিলে এই ব্যাপক আয়োজনে ব্যস্ত।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
জেএমএস/এএসএম