কেমন আছে চা বাগানের শিশুরা?

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:০৮ পিএম, ২৫ আগস্ট ২০২২

বেনজীর আহমেদ সিদ্দিকী

শ্রীমঙ্গলের মনোরম চা বাগানের পাশ দিয়ে হাঁটতে গিয়ে দেখা হয় মায়াবী এক শিশুর। গল্পের এক ফাঁকে সে বলে ফেলল জীবনের চরম বাস্তবতার কথা, পেটে তীব্র ক্ষুধার কামড় বিষধর সাপের কামড়ের চেয়েও ভয়ংকর। আসলে কেমন আছে বাংলাদেশের চিরসবুজ চা বাগানের শিশুরা?

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চা শিল্পের অবদান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও পঞ্চগড়ে প্রায় ১৬৭টি চা বাগান আছে। এখানে প্রায় ১৩ লাখ শ্রমিক তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে চা শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে। মালিকরা এখানে সব কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার আছে সীমিত প্রবেশাধিকার। ফলে চা শিল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিক ও তাদের শিশুরা সরকারি-বেসরকারি অধিকাংশ সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। আধুনিকতা ও তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে চা বাগানের বাইরের বিশ্ব চা শিল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের অজানা। তারা এখনো মৌলিক ও মানবাধিকারের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে।

চা বাগানের শ্রমিক ও তাদের শিশুরা স্বাস্থ্যসম্মত আশ্রয়, নিরাপদ পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, চিকিৎসা সেবা, পুষ্টিকর খাদ্য, শিক্ষা, পর্যাপ্ত মজুরি, আত্ম-উন্নয়ন এবং সামাজিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত। যেহেতু তাদের কর্মস্থলে বসবাস করা বাধ্যতামূলক, তাই তারা মালিক বা কোম্পানির ১০/১২ ফিটের ঘরে কোনোমতে বসবাস করছে। এমনকি তাদের নিজস্ব কোনো চাষের জমিও নেই। তারা সর্বদা দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করছে এবং প্রতিনিয়ত অনাহারে থাকে।

যেহেতু মজুরি অনেক কম। একজনের মজুরিতে পরিবার চালানো অসম্ভব এজন্য নারীরাও স্বামী এবং সন্তানদের সঙ্গে এ কাজ করেন। বর্তমানে তাদের আয়ের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি। এছাড়া বেকার ও ছাঁটাই শ্রমিকদের অবস্থা আরও কঠিন। কাজের সুযোগের অভাব, গৃহহীনতা, সঞ্চয় করতে না পারা, পুষ্টিকর খাবার দিতে না পারা, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব-এমন পরিবার থেকে শিশুরা কীভাবে শিক্ষা নেবে তা ভাবার বিষয়। তাই স্বাধীনতার ৫০ বছরের মাঝে বাংলাদেশের এক কোটি চা-বাগানের শ্রমিকদের মধ্যে মাত্র একজন উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছেন।

দেশে অনেক সাংবিধানিক সুরক্ষা এবং শ্রম আইন রয়েছে যা মানবাধিকার এবং মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১৫ (ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্বগুলোর মধ্যে একটি হলো পরিকল্পিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা এবং খাদ্যসহ মানুষের জীবনযাত্রার উপাদান ও সাংস্কৃতিক মান উন্নত করা। নাগরিকদের জন্য পোশাক, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা। জীবনের মৌলিক প্রয়োজনীয়তা অর্জন নিশ্চিত করা যেতে পারে।

উপরন্তু ২৮ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে রাষ্ট্র কেবল ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য করবে না। সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে মৌলিক অধিকারের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, সব নাগরিক আইনের সামনে সমান এবং আইনের সমান সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারী। চা বাগানের সঙ্গে জড়িত সম্প্রদায়ে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করে। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি ভিন্ন। নাগরিক হিসেবে সকল শ্রমিক, নারী-পুরুষ, যে কোনো ধর্মের শিশুর মৌলিক অধিকার সংবিধানে স্বীকৃত। কিন্তু অধিকাংশ শ্রমিক ও তাদের সন্তানরা নিরক্ষর তাই তারা আইন, অধিকার ও ন্যায়বিচার সম্পর্কে সচেতন নয়।

jagonews24

শ্রম আইন ২০০৬ এর ৯৫ ধারা চা বাগান শ্রমিক এবং তাদের সন্তানদের জন্য বিনোদনমূলক এবং শিক্ষাগত সুবিধা প্রদান করে। প্রতিটি চা বাগান বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে শ্রমিক এবং তাদের সন্তানদের জন্য উপযুক্ত চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপন করবে। চা শ্রমিক ও তাদের সন্তানদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার জন্য সার্ক সামাজিক সনদ এবং আইএলও সনদ রয়েছে। যা মৌলিক শিক্ষার সুযোগ, নিশ্চিত আবাসন, নিরাপদ পানি এবং স্যানিটেশন সুবিধা এবং মৌলিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে – এগুলো আইন, প্রবিধান এবং প্রশাসনিক নিয়ম দ্বারা নিশ্চিত হওয়া উচিত।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, চা বাগানের শ্রমিকদের শিক্ষিতদের সংস্পর্শে আসতে দেওয়া হয় না, শিক্ষার সুযোগ পায় না। অন্যদিকে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের শিক্ষায় কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন না কারণ তাদের অধিকাংশই নিরক্ষর। এছাড়া বাবা-মায়ের সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ বহন করার সামর্থ্য না থাকায় শিশুদের বিদ্যালয়ের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। বাড়িতে সাহায্য না পাওয়ায় অনেক শিশু স্কুল ছেড়ে দেয়। ফলে চা শিল্পের সঙ্গে জড়িত সম্প্রদায়ের শিশুরা শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়।

চা শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকায় প্রায় ৫০ হাজার শিশু প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। বিদ্যালয়ের চা বাগানগুলোতে শিক্ষকের অভাব ও শিক্ষা কারিকুলাম যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় না। অনেক সময় সাধারণ শিক্ষার্থীরা চা সম্প্রদায়ের শিশুদের সহজে নেয় না, তাদের সঙ্গে মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করে না। এসব বিদ্যালয়ের কার্যক্রম তদারকির কোনো ব্যবস্থা নেই। পর্যাপ্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কারিগরি শিক্ষা কেন্দ্র নেই। এমনকি শিক্ষকদের মান উন্নয়নের কোনো ব্যবস্থা নেই।

মান উন্নয়ন ও শিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি, আধুনিক শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ, পাঠদান পরিকল্পনা অনুসরণ এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। শিশুদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর উদ্দেশ্যে, শিক্ষা ব্যবস্থা এবং পদ্ধতি যেমন ভর্তি, পাঠদান এবং পরীক্ষার মতো পদ্ধতিগুলো সঠিকভাবে বোঝা এবং সচেতনতা অর্জনের জন্য অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষা দিতে হবে। মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে সভা, সমাবেশ, সংলাপ, আলোচনা, মিডিয়া সম্প্রচারের মতো বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। চা শ্রমিকদের শিশুদের মধ্যে সমবায় কাজ, টেকসই প্রযুক্তির মতো মানব উন্নয়ন কর্মসূচি চালু করা দরকার। শ্রম আইনের সংশোধন এবং মালিকদের আইন অনুযায়ী আবাদ নিয়ন্ত্রণ করতে ইচ্ছুক হতে হবে। রাষ্ট্রকে আইনের ব্যবহারিক জটিলতা দূর করে শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় আইন বাস্তবায়ন করতে হবে।

চা শ্রমিক ও তাদের সন্তানরা এদেশের নাগরিক। তাদের দেশে ভোট দেওয়ার অধিকার আছে। তারা অন্যান্য নাগরিক অধিকারেরও অধিকারী। তাই উন্নত জীবন ও মৌলিক অধিকার সুরক্ষা তাদের সাংবিধানিক ও মানবাধিকার। এই ভূমিহীন চা শ্রমিক ও তাদের সন্তানদের জীবিকা নির্বাহের আর কোনো উপায় নেই। তাদের বেশিরভাগই অশিক্ষিত এবং তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য চা বাগান মালিকদের উপর নির্ভরশীল। চা শিল্পে শিশু শ্রমিক, তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করতে বাধ্য করা, পর্যাপ্ত মজুরি বঞ্চিত, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সমস্যা ইত্যাদির কারণে তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক স্বার্থ অরক্ষিত। তারা এখন পরিবর্তন চায়, সুযোগ চায়। সকল চা শ্রমিক আশা করে তাদের সন্তানরা শিক্ষা ও অন্যান্য মৌলিক অধিকার মর্যাদার সঙ্গে পাবে।

লেখক: সমাজকর্মী ও ফার্মাসিস্ট

কেএসকে/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।