বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণায় ড. ওয়াজেদ মিয়ার অবদান

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:১০ পিএম, ০৯ মে ২০২২

মো.হাবিবুর রহমান
বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী হিসেবে ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সুখ্যাতি রয়েছে। এদেশে পদার্থবিজ্ঞান ও পরমাণুবিজ্ঞানের গবেষণায় তিনি আলোর দুত্যি ছড়িয়েছেন। শুধু বিজ্ঞানেই নয়, বহুগুণে গুণান্বিত ছিলেন তিনি।

ছাত্র জীবনে রাজনীতিতে সক্রিয়তা, একাডেমিক ক্ষেত্রে পাণ্ডিত্যের পরিচয়, দেশে বিদেশে গবেষণা সেমিনারে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে গবেষণায় অবদান, কর্মক্ষেত্রে একজন সুদক্ষ প্রশাসক ও ভালো গবেষক, পরামাণুবিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞানের উন্নয়ন এবং বই ও জার্নাল প্রকাশনা ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন।

ছাত্র জীবনে ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে পিএইচ.ডি ডিগ্রি পর্যন্ত সব ডিগ্রি কৃতিত্বের সঙ্গে অর্জন করেছেন। তিনি বৃহত্তর রংপুর থেকে প্রাথমিক ও আইএসসি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। এরপর ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৬২ সালে তিনি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৬৩-১৯৬৪ সেশনে ইম্পারিয়েল কলেজ লন্ডন থেকে ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করেন। যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকে ডারহাম ইউনিভার্সিটি থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে পিএইচ.ডি অর্জন করেন।

ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার পিএইচ.ডি গবেষণার বিষয় ছিল ‘দ্য বুটস্ট্রেপ হাইপোথেসিস ইন থিউরিটিক্যাল পার্টিকল ফিসিক্স’। তার গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বিখ্যাত প্রফেসর অধ্যাপক ই. জে স্কয়ার। তার শিক্ষা জীবনের কৃতিত্ব ও পাণ্ডিত্য পরবর্তীতে কর্মক্ষেত্রে তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে প্রতিফলিত হয়েছে।

শুধু একাডেমিক ক্ষেত্রেই ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া তার পাণ্ডিত্যের প্রখরতা প্রকাশি করেননি। তিনি ১৯৬০ সাল থেকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের ভিপি থাকাবস্থায় তিনি বঙ্গবন্ধুর সাহচর্যে এসেছিলেন। ১৯৬১ সালে ছাত্রলীগে যোগদান করেন তিনি।

১৯৬২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। পাকিস্তানের প্রথম সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও মিছিল পরিচালনা করার কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে তিনি একনিষ্ঠ ছিলেন না, তিনি রাজনীতিতে একজন একনিষ্ঠ কর্মীর পরিচয় দিয়েছেন।

বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার উন্নতি ও বিকাশের ক্ষেত্রে ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার অবদান অনন্য। নিজ দেশ এবং দেশের বাইরে তার গবেষণার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে অল্প সময়েই। তিনি বাংলাদেশে এবং বিদেশে বিভিন্ন সভা ও সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছেন। তার চিন্তা ও গবেষণা বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণায় ব্যাপক অবদান রেখেছিল।

১৯৬৯ সালে ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়াকে ইতালির ট্রি-স্টেটের ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিউরিটিক্যাল ফিসিক্স’ এ একজন অ্যাসোসিয়েটশীপ হিসেবে মনোনয়ন প্রদান করা হয়। ফলশ্রুতিতে, তিনি যথাক্রমে ১৯৬৯, ১৯৭৩, এবং ১৯৮৩ সালে প্রতি ৬ মাস অন্তর সক্রিয়ভাবে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলেন।

এছাড়াও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি-এর ডারেসবোরি নিউক্লিয়ার ল্যাবরেটরিতে একজন পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে ১৯৬৯ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৭০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। উপযুক্ত প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করার কারণে তিনি বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার উন্নতি সাধন করেন।

পাকিস্তান শাসনামলে ছাত্র রাজনৈতিক আন্দোলন, বাংলাদেশের অভূদ্যয়ের ইতিহাস এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয় ইত্যাদি ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া বিভিন্ন লেখায় তুলে ধরেছেন। সামাজিক বিজ্ঞান, রাজনীতি, বিজ্ঞান, বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমসাময়িক পরিস্থিতি নিয়ে তার আটটি গবেষণা প্রবন্ধ ও প্রকাশনা রয়েছে। তার এ সকল প্রকাশনা এবং লেখা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিখ্যাত গবেষণা জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ, বাংলাদেশের রাজনীতি, বাংলাদেশ সরকার ও রাজনীতি নিয়ে তার দুইটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বই দুইটি হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ (ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা-১০০০, এপ্রিল, ২০০০) এবং বাংলাদেশের রাজনীতি ও সরকারের চালচিত্র। একাডেমিক ক্ষেত্রে তার দুইটি বই গবেষক, লেখক, শিক্ষার্থীদের জন্যে মূল প্রবন্ধ হিসেবে স্বীকৃত।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ফান্ডামেন্টালস অব ইলেকট্রোম্যাগনেট্সিক (১৯৮২), ফান্ডামেন্টালস অব থার্মোডাইনামিক্স (১৯৮৮) পদার্থবিজ্ঞান, এ্যাপ্লাইড ফিসিক্স, রসায়ন এবং প্রকৌশলী শিক্ষার্থীদের জন্য তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক বই হিসেবে স্বীকৃত।

ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ১৯৪২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রংপুরের পীরগঞ্জের ফতেহপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাক নাম ছিল সুধা মিয়া। ড. ওয়াজেদ মিয়ার পিতা আব্দুল কাদের মিয়া ও মাতা ময়েজুন্নেসা। তার পরিবারের সদস্যগণ বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনবদ্য অবদান রেখে চলেছেন।

১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন তিনি। তাদের এক পুত্র ও এক কন্যা বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সামাজিক ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে অবদান রাখছেন। পুত্র সজিব ওয়াজেদ জয় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা। অন্যদিকে মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল অটিজম বিশেষজ্ঞ এবং দ্য সেন্টার ফর রিসার্চ এন্ড ইনফরমেশন এর ভাইস-চেয়ারপার্সন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর তিনি বঙ্গবন্ধুর পরিবারের পাশে ছিলেন এবং সুষ্ঠুভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন। তিনি ২০০৯ সালে আজকের এই দিনে ঢাকায় ইহলোক ত্যাগ করেন। তাকে নিজ গ্রামে ফতেহপুরে সমাহিত করা হয়।

ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া সব ক্ষেত্রেই অবসান রেখেছন। তার অবদান রয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণেও। এই প্রকল্পটি বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পাবনা জেলার পদ্মা নদীর সন্নিকটে ঈশ্বরদীর পাশে রূপপুরে এ প্রকল্পটি নির্মিত হচ্ছে। প্রকল্পটি ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে পুরাদমে শুরু হয়েছে। গত দশক থেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশও পরমাণুশক্তি অর্জনের জন্যে ক্রমান্বয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রূপপুর নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।

এছাড়াও সরকার পাবনাতে রূপপুর নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট প্রকল্পটি দ্রুত গতিতে ত্বরান্বিত করার জন্যে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে। মূলত এ প্রকল্পটি ১৯৬১ সালে উদ্বোধন করা হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্যে ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি এ প্রকল্পের গ্রাউন্ডওয়ার্ক করেছিলেন। তার স্বপ্ন আজ বাস্তবায়নের পথে। বর্তমানে এ প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এ প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হলে বাংলাদেশ পরমাণুশক্তিতে উদীয়মান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে।

ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার স্বপ্ন তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হলে তার দর্শন ও গ্রন্থের অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। তার সমসমায়িক ব্যক্তি, মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষকদের মতে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের নাম তার নামে নামকরণ করা প্রয়োজন। তার নামে এরই মধ্যে দেশের মধ্যে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ইন্সটিটিউট নামকরণ করা হয়েছে।

তার মৃত্যুর পর এ প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠা হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববদ্যিালয় ২০০৯ সালের ৩০ মে ‘ওয়াজেদ মিয়া সায়েন্স রিসার্চ সেন্টার’ নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববদ্যিালয়, রংপুর ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে ড. ওয়াজেদ রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং ইন্সটিটিউট নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে। এসব প্রতিষ্ঠানে দেশি ও বিদেশি গবেষকেরা সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়াবলী নিয়ে গবেষণাকার্যক্রম পরিচালনা করছেন।

পদার্থবিজ্ঞান ও পরমাণুবিজ্ঞান ভিত্তিক গবেষণায় ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার অবদান অনস্বীকার্য। পরমাণুবিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞান ভিত্তিক গবেষণায় আরও জোরদার করা প্রয়োজন। এছাড়াও তার নামে যে সব গবেষণা ও ইন্সটিটিউট রয়েছে, সে সব প্রতিষ্ঠানে ফেলোশীপের ফান্ড বৃদ্ধি ও মেধাবৃত্তি বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এতে দেশের সামাজিক অবস্থা উন্নয়নের পাশাপাশি বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার উন্নয়ন সাধিত হবে।

৪র্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার উপর জোর দিতে হবে। এছাড়াও বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণায় গতিশীলতা আনয়নের জন্যে পর্যাপ্ত ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। দেশে কিছু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো পর্যাপ্ত পরিমাণে বিজ্ঞানভিত্তিক ল্যাব না থাকায় গবেষকরা যে কোনো বিষয়ে গবেষণা করতে পারছেন না।

গবেষণা প্রস্তাবনার সময় গবেষকের চিন্তা থাকে, তিনি যে বিষয়ে গবেষণা করতে মনস্থ করছেন তা সম্পন্ন করতে পারবেন কি না! সুতরাং প্রয়োজনীয় সংখ্যক ল্যাব প্রতিষ্ঠা করে এ সমস্যা সমাধান সম্ভব। তাহলেই ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে এবং পরমাণুবিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় নিত্য নতুন বিষয় উদ্ভাবন হবে।

লেখক: কলামিস্ট, কবি

কেএসকে/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।