রক্তের প্রয়োজনে হাজির মেহেদী হাসান নিরব

আবু সালেহ মুসা
আবু সালেহ মুসা আবু সালেহ মুসা , ফিচার লেখক
প্রকাশিত: ০১:৩৫ পিএম, ১২ এপ্রিল ২০২২

বয়স মাত্র ১৭। হালকা-পাতলা গড়নের ছেলেটি মেহেদী হাসান নিরব। দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। জন্ম বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলায়। এ উপজেলার যে কোনো সময় যে কারো রক্তের প্রয়োজনে ছেলেটিই একমাত্র ভরসাস্থল। তার কাছে ফোন করে রক্ত পাননি এমন ঘটনাই হবে কাকতালীয়। বোকা লোকটাও এমন গুজব রটাবে না। যখন যেখানে রক্তের প্রয়োজন মেহেদী যেন সেখানেই অদৃশ্যভাবে হাজির। বলা যায়, সময়-অসময়ে রক্তের প্রয়োজন মানেই নিরবের শরণাপন্ন।

যেভাবে রক্ত সংগ্রহ করেন
রক্ত সংগ্রহের শুরুটা হয়েছিল স্কুল-কলেজের বন্ধুদের রক্তদানে উৎসাহিত করার মধ্যদিয়ে। এরপর সেসব বন্ধুদের নিয়ে নিজ উদ্যোগে লিফলেট লাগানো ও বিতরণসহ নানাভাবে মানুষকে রক্তদানে উৎসাহিত করার চেষ্টা চালান তারা। এ ছাড়াও নিরব বেশকিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন। যেখানে তিনি রক্ত বিভাগে কাজ করেন; সেখান থেকেও অনেককে ডোনার সংগ্রহ করে দিতেন। তবে যখনই কোনো নতুন ডোনার তারা পেতেন; তখনই ফোন নম্বরটি সংগ্রহ করে রাখতেন। যে কারণে তাদের কাজ করতে সুবিধা হতো।

নিরবের মাধ্যমে রক্ত দেওয়া ডোনারের সংখ্যা হাজার পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। প্রশ্ন জাগতে পারে, কীভাবে এত ডোনার তিনি সংগ্রহ করলেন? মূলত তারা রক্ত দিয়েই বসে থাকতেন না। রক্তদানের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করতেন, যাতে তা দেখে অন্যরা অনুপ্রাণিত হন। এতে বেশ কাজও হতো। অনেকেই রক্তদানে উৎসাহিত হয়েছেন।

রক্ত সংগ্রহ করার কারণ
একবার মেহেদীর নানি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে তার জরুরি রক্তের প্রয়োজন দেখা দেয়। সবাই রক্তের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু তারা রক্ত সংগ্রহে ব্যর্থ হন। কেউ তার নানিকে রক্তদানে এগিয়ে আসেননি। রক্তের জন্য তাদের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন জনের কাছে ঘুরতে হয়েছে। কিন্তু তবুও সারাদিনে তারা ১ ব্যাগ রক্তের সন্ধান পাননি। সেদিন মেহেদী খুবই কষ্ট পান। এরপরই তিনি চিন্তা করেন রক্তদান নিয়ে কাজ করার। অন্তত রক্তের অভাবে যাতে কাউকে কষ্ট পেতে না হয়।

রক্তদান করতে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যা ও মানসিক চাপের ভেতরেও পড়তে হয়েছে তাকে। অন্যের প্রয়োজনে এগিয়ে গিয়েও তেমন গুরুত্ব পেতেন না। প্রায় রক্তদান শেষে ফিরে এসেছেন একবুক অভিমান আর হতাশা নিয়ে। কিন্তু তাই বলে দমে যাননি। আরও বেশি আগ্রহ উদ্দীপনা নিয়ে সামনে আগানোর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।

একটি ঘটনা
আমার পরিচিত এক আত্মীয়ের দুই ব্যাগ ও নেগেটিভ রক্তের দরকার। কিন্তু কোথাও রক্ত পাওয়া যাচ্ছে না। এ গ্রুপের রক্ত পাওয়া একটু কঠিন। এদিকে রক্তও খুব জরুরি। হাতে মাত্র একদিন। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। সবাই অনেক চিন্তিত হয়ে পড়েন।

jagonews24

তখন নিরবের কথা মনে পড়ে। তার সঙ্গে কথা বললাম। সময় স্বল্পতার কথা শুনে তিনিও কিছুটা ঘাবড়ে গেছেন। তবুও বললেন, ‘আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। দুই ব্যাগ না পারলেও এক ব্যাগ সংগ্রহ করে দেবই।’ কিছুটা আশ্বস্ত হলেও অন্য ব্যাগ নিয়ে চিন্তিত। নিরব যদি সংগ্রহ করতে না পারে তাহলে অন্য কেউ পারবে না।

নিরবের সঙ্গে কথা বলার ঘণ্টাখানেক পার হয়। আমি তখনো অন্য ব্যাগ রক্ত নিয়ে চিন্তিত। তা ছাড়া নিরবও যে ১ ব্যাগ সংগ্রহ করতে পারবে, সে বিষয়েও নিশ্চিত নই। এসব চিন্তার ভেতরেই ফোন বেজে উঠল। দেখি তার ফোন। ঘণ্টাখানেকের মাথায় ফোন পেয়ে ঘাবড়ে গেলাম। তাহলে কি সংগ্রহ করতে পারেনি?

ফোন রিসিভ করলাম। নিরব বলে উঠলেন, ‘ভাই অন্য এক ব্যাগ রক্তের সন্ধান পেলেন?’ বললাম, ‘না। আপনি কিছু করতে পারলেন?’ বলল, ‘হ্যাঁ ভাই। তবে এক ব্যাগ নয়, দুই ব্যাগই।’ আমি তো পুরো স্তব্ধ হয়ে গেছি। রীতিমতো ঘামছি। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এত অল্প সময়ে কীভাবে সম্ভব?’ তিনি বললেন, ‘ভাই, পৃথিবীতে সবকিছুই অসম্ভব, তবে চেষ্টা করলে সবই সম্ভব।’

একটি অভাব
রক্তের প্রয়োজনে মেহেদী হাসান নিরব এখন সবারই ভরসার হাত। যখন যেখানে রক্তের প্রয়োজন, শোনামাত্রই সেখানে হাজির। রক্ত সংগ্রহ যেন তার নেশা থেকে পেশায় পরিণত হয়েছে। তারা প্রচারের স্বার্থে নয়, জনস্বার্থে কাজ করেন। তবে তাদেরও যে একটি অভাব আছে।

সব সময় সব কিছু পুরোপুরি ফ্রি-তে হয় না। স্বেচ্ছায় রক্ত সংগ্রহ করে দিলেও তাদের একটি অভাব থেকেই যায়। চক্ষুলজ্জায় তারা তা কখনোই প্রকাশ করেন না। আমরা চাইলে সে অভাব পূরণের অংশীদার হতে পারি। এতে তারাও তাদের সেবামূলক কাজে দ্বিগুণ উৎসাহ পাবেন। এমন সেবামূলক কাজকে উৎসাহিত করতে অংশীদার হওয়া উচিত।

লেখক: ফ্রিল্যান্স ফিচার রাইটার

কেএসকে/এসইউ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।