কর্মক্ষেত্রে নিজেকে কখনো নারী হিসেবে চিন্তা করিনি
অঞ্জনা খান মজলিসের জন্ম সাভার উপজেলার আনন্দপুরে। তিনি ২০০৩ সালে ২২তম বিসিএস প্রশাসনের মাধ্যমে চাকরিতে যোগদান করেন। এরপর দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এবং পরবর্তীতে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের উপসচিব দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পান।
নারী দিবস উপলক্ষে সফল এ জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম-
জাগো নিউজ: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারী দিবস সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি?
অঞ্জনা খান মজলিস: আমাদের দেশের সংবিধানে নারী এবং শিশুদের আলাদা কিছু করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক হচ্ছে নারী। কিন্তু নানা প্রেক্ষাপটের কারনে আমাদের দেশের নারীরা এতদিন পিছিয়ে ছিল।
তবে এখন নারীরা সমাজে কাজ করছে, শিক্ষিত হচ্ছে এবং বিভিন্ন পেশায় আসছে। নারীদের সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে অংশগ্রহণ আগের তুলনায় বাড়ছে। তবে এখনো কিছু নারীরা কর্মক্ষেত্রে আসছেনা। অনেক নারী আছেন যারা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, কর্মক্ষেত্রে আসতে বিভিন্ন পারিবারিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। নারীদের অনেক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে আসতে হয়। সে সব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে যাওয়া অনুপ্রেরণা জোগাতে কিংবা নারী নির্যাতন অবহেলা লাঞ্ছনা ও বৈষম্য বন্ধের দাবিতে নারীরা সোচ্চার হতে নারী দিবস রাখা হয়েছে।
এছাড়াও, যাতে নারীরা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়। তাছাড়া অফিসে যেসব নারী কমকর্তা আছেন তারা যেন তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়। তারাও যে মানুষ, তাদের মানুষ হিসেবে অধিকার পাওয়ার যোগ্যতা ও ক্ষমতা আছে। এই বিষয়গুলো সমাজের মাঝে সচেতনতা তৈরিতে নারী দিবস পালন করা হয়।
জাগো নিউজ: আপনি চাঁদপুরে প্রথম নারী জেলা প্রশাসক। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
অঞ্জনা খান মজলিস: আসলে যখন কর্মক্ষেত্রে থাকি তখন নিজেকে কখনও নারী হিসেবে চিন্তা করিনি। সবসময় চিন্তা করেছি, আমি একজন সরকারি ও প্রশাসনের কর্মকর্তা। এখন একটি জেলার দ্বায়িত্ব আছি। জেলা প্রশাসক হিসেবে আমার যে দ্বায়িত্ব তা পালন করার চেষ্টা করছি। তাছাড়া আমার দ্বারা যেন এই জেলার জন মানুষের উপকার হয় ও তারা যেন আমার কাছ থেকে সেবা পায় এটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি।
জাগো নিউজ: বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে নারী ক্ষমতায়নের বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?
অঞ্জনা খান মজলিস: নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টা হচ্ছে,নারীকে মূল ধারার সাথে নিয়ে আসা এবং নারীরা যাতে সমাজে পিছিয়ে না পড়েন। কারণ দেশে মোট জনশক্তির অর্ধেক নারী। যদি সমাজে এই অর্ধেক সংখ্যক নারী পিছিয়ে থাকে এবং পুরুষের সমানতালে কর্মক্ষেত্রে নারীর অবদান না থাকে তাহলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। দেশ তথা বিশ্বের উন্নয়ন হবেনা। নারীর ক্ষমতায়ন বলতে, নারীকে সমাজে মূলধারায় নিয়ে আসতে হবে। তাদের নিজস্ব মেধা ও যোগ্যতা প্রমানের সুযোগ করে দিতে হবে।
জাগো নিউজ: আপনি কর্মক্ষেত্রে কোন বাঁধা বা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছিলেন কি?
অঞ্জনা খান মজলিস: আমি খুবই সৌভাগ্যবান। আমি এমন একটা পরিবার থেকে উঠে এসেছি, যেখানে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়নি। বরং পরিবার থেকে সবসময় আমাকে এগিয়ে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে পরিবার থেকে যথেষ্ট সহযোগিতা করা হয়েছে। আমার বিয়ের পরও আমি ভালো পরিবেশ পেয়েছি। আমার স্বামী, শ্বশুর ও শ্বাশুড়ি সবাই আমাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। ফলে আমাকে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা পোহাতে হয়নি।
জাগো নিউজ: বর্তমানে কর্মপরিবেশ কতটা নারীবান্ধব বলে আপনি মনে করেন?
অঞ্জনা খান মজলিস: আমার মতে, এই বিষয়টা বিভিন্ন সেক্টরে বিভিন্ন রকম। সরকারি, বেসরকারি ও ব্যবসা প্রত্যেক ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব পদ্ধতি রয়েছে। সরকার একটা সহজ নিয়ম করেছে, যেখানে মেয়েরা যখন সরকারি চাকরিতে আসছে বা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে তাদের পুরোপুরি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। নারীরা এখানে খুব সহজে কাজ করতে পারেন। বেসরকারি সেক্টরে নারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি সেই প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করে। তাদের পরিবেশ নারীবান্ধব হলে নারীদের কাজ করতে কোনো সমস্যার মুখোমুখি হতে হবেনা। নারীদের যাতে মর্যাদাহানী না হয় এরকম কর্মপরিবেশ তৈরি করা জরুরি। এটা নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
জাগো নিউজ: আমাদের সমাজে গৃহিণীদের ভূমিকা নিয়ে আপনার অভিমত কী?
অঞ্জনা খান মজলিস: নারীদের মধ্যে যারা অফিস, আদালত বা বাইরে চাকরি করছে আর যারা গৃহিণী তারা যে কাজ করছে না বিষয়টা এমনটা নয়। এরকম হীন মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। একজন মা সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি পযার্য়ক্রমে কাজ করতে থাকেন। পরিবারের সকল সদস্যদের খেয়াল রাখেন। শস্যের বীজ বপন থেকে শুরু করে শস্য পাকা পর্যন্ত কৃষিক্ষেত্রে ২১টি ধাপ রয়েছে। তার মধ্যে ১৬টি ধাপ একজন কৃষাণী করে থাকেন। কৃষাণীরা আমাদের সমাজে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। নারী তথা গৃহিণীরা পরিবারের ও সমাজের বিভিন্ন কাজ করে দেশকে অর্থনীতিকভাবে সাহায্য করছে। এটা বড় একটা বিষয়। অবশ্যই সমাজে তাদের পরিশ্রমের মূল্যায়ন করা উচিত।
জাগো নিউজ: সমাজে নারীদের বাল্যবিবাহ সম্পর্কে কী বলবেন?
অঞ্জনা খান মজলিস: নারীদের বাল্যবিবাহের জন্য অবশ্যই আইন থাকে। বাল্যবিবাহ নিষেধ করে আইন করা হয়েছে। আমরা খবর পাওয়া মাত্রই বাল্যবিবাহ বন্ধ করে দিচ্ছি এবং বাবা-মাকে সচেতন করার চেষ্টা করছি। যেসব কাজীরা বাল্যবিবাহ করান তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসি। বাল্যবিবাহ হলে নারী দু'দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।লেখাপড়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয় ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাল্যবিবাহের ফলে একজন নারী নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সংসারে পৌছে যায়। তখন তার ভূমিষ্ট হওয়া সন্তান অপুষ্টিতে ভোগে ও সে নিজেও অপুষ্টির শিকার হয়। তাছাড়া নারীরা শারীরিক, মানসিকভাবে ও সামাজিকভাবে নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়। সেক্ষেত্রে বাবা-মার পাশাপাশি সমাজকে সচেতন হতে হবে। তাহলেই আমরা বাল্যবিবাহের কবল থেকে রক্ষা পাব।
জাগো নিউজ: আগামীর বাংলাদেশে নারীদের আপনি কোন অবস্থানে দেখতে চান?
অঞ্জনা খান মজলিস: আমি বলতে চাই, সমাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা কাজ করবে। নারী পুরুষের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ থাকবেনা। সবাই সমানতালে এগিয়ে যাবে। নারী ও পুরুষের মধ্যে আন্তরিক, সৌহার্দ্যপূর্ণ ও সমতার সম্পর্ক হবে।
জাগো নিউজ: আপনি কাকে একজন সফল নারী বলবেন?
অঞ্জনা খান মজলিস: সফল বা ব্যর্থতা আপেক্ষিক বিষয়। এটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন হতে পারে। কেউ যদি কোনো কাজ করার সংকল্প করে এবং সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌছতে পারে তাহলেই সে সফল হবে।
জাগো নিউজ: যেসব নারীরা এখনো সমাজে এগিয়ে আসতে ভয় পায়, তাদের উদ্দেশ্যে আপনি কী বলতে চান?
অঞ্জনা খান মজলিস: কোনো কিছু পাবার বা হবার জন্য মানুষের ইচ্ছা শক্তিটা সবচেয়ে বড়। কেউ যদি কোনো কিছু করার ইচ্ছা পোষণ করে, তাকে একাগ্রতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে। তাহলে একসময় সে অবশ্যই সফল হবে। নারীদের ক্ষেত্রে বলব, সবাইকে শিক্ষিত হওয়া বা শিক্ষার আওতায় আনতে হবে।
শিক্ষিত ও অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী নারী তার ইচ্ছা ও মতামত সবার সামনে তুলে ধরতে পারে। নারীরা যদি অর্থনৈতিকভাবে অন্যের উপর নির্ভর থাকে এবং অশিক্ষিত হয়, তখন তার ইচ্ছা অনিচ্ছা কোনো কিছুই তার থাকেনা। নারীকে তখন অন্যের ইচ্ছায় উঠাবসা করতে হয়। তার নিজের ইচ্ছের কোন মূল্য থাকবে না। আর যার মধ্যে শিক্ষা নাই সে সমাজের ভালোমন্দ বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন থাকেনা। কাজেই প্রতিটা মেয়েকে প্রথমে শিক্ষিত হতে হবে এবং তারপর অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
কেএসকে/এমএস