গাঙ্গুবাই কে ছিলেন?

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪:৩৮ পিএম, ০২ মার্চ ২০২২

বর্তমানে গাঙ্গুবাই নামটি সবার মুখে মুখে! সম্প্রতি বলিউডে মুক্তি পাওয়া আলিয়া ভাট অভিনীত গাঙ্গুবাই সিনেমা মানুষের মুখে মুখে। ট্রেইলার মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রশংসার জোয়ারে ভাসতে শুরু করে আলিয়ার অভিনয়। মাত্র দুদিন আগে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাটি এরই মধ্যে আয় করেছে ১০০ কোটি টাকা।

তবে যে নাম ও চরিত্র নিয়ে চারদিকে এত আলোচনা সমালোচনা তাকে কয়জনই বা চেনেন। দু’ঘণ্টার সিনেমায় আসল গাঙ্গুবাইকে কতটুকু জানতে পারবেন একজন দর্শক। আসল গাঙ্গুবাইয়ের জীবন কাহিনি সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। তার পুরো নাম গাঙ্গুবাই কোঠেওয়ালি। মুম্বাইয়ের এক যৌনপল্লীর সর্দারনী ছিলেন তিনি। এতটুকুই ছিল তার পরিচয়।

তবে যতই সময় পেরিয়েছে গাঙ্গুবাইয়ের জীবনে যুক্ত হয়েছে নানা ঘটনা। সাধারণ মানুষের কাছে যৌনপল্লীর সর্দারনী হলেও পুলিশের খাতায় তিনি ছিলেন নৃশংস এক গ্যাংস্টার। ডি-কোম্পানির শীর্ষস্থানীয়রা তার ঘরে আসতেন। ফলে আন্ডারওয়ার্ল্ডের কোনো খবরই তার কাছে অজানা থাকতো না।

এর ঠিক উল্টো পিঠও রয়েছে গাঙ্গুবাইয়ের চরিত্রে। মুম্বাইয়ের নিম্নবৃত্ত নারীদের জন্য তিনি একজন আদর্শ। যিনি যৌনপল্লীতে কাজ করে পেট চালায় তারও যে একটা সাধারণ স্বাভাবিক জীবনের অধিকার আছে সে বিষয়ে তিনিই প্রথম সোচ্চার হয়েছিলেন। আর যৌনকর্মীদের কাছে তিনি ছিলেন সংগ্রামী নারীর প্রতীক।

গাঙ্গুবাইয়ের জন্ম ১৯৩৯ সালে। কিশোরী বয়সে জোর করে তাকে পাঠানো হয় যৌনপল্লীতে। দরিদ্র ঘরে জন্ম নেওয়ায় পড়ালেখা করতে পারেননি খুব বেশি দূর। ১৬ বছর বয়সে প্রেমে পড়েন রমনিক লাল নামে এক কলেজ ছাত্রের। প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে এসেছিলেন মুম্বাই।

দুজনে বিয়ে করে মহারাষ্ট্রের মুম্বাইতে বসবাস শুরু করেন। স্বপ্ন ছিল ঘর সংসার করার। হবেন বলিউডের নায়িকা। স্বামী রমনিকও তাকে কথা দিয়েছিল। কিন্তু সেই স্বামীই তাকে মাত্র ৫০০ টাকায় বিক্রি করে দেন যৌনপল্লীতে।

এই ঘটনাই তাকে মানসিকভাবে খুব দৃঢ় করে তুলেছিল। সেই দৃঢ়তায় তাকে ভাবতে শেখায় যে, হয়তো চাপে পড়ে তিনি এই পেশায় এসেছেন, কিন্তু সেটা তার মনোবলকে তার মানসিক সম্মানকে কোনোভাবেই আঘাত করতে পারবে না।

jagonews24

ষাটের দশকে যৌনকর্মী হওয়ার পরও মুম্বাইয়ের রাস্তায় তিনি কালো বেন্টলিতে করে ঘুরে বেড়াতেন। এমনই বর্ণাঢ্য ছিল তার জীবন। গাঙ্গুবাইয়ের ঠিকানা ছিল কামাথিপুরা। মুম্বাইয়ের এই জায়গাটা খুবই বিখ্যাত। কারণ এটা ভারতবর্ষের ইতিহাসের অন্যতম বড় যৌনপল্লীগুলোর একটি।

বোম্বে মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের (বিএমসি) হিসাব মতে এখানে ১৯৯২ সালেও ছিল ৫০ হাজার যৌনকর্মী। ষাটের দশকে এই সংখ্যাটা ছিল আরও বেশি। সেই লাখখানেক যৌনকর্মীর মন জয় করে নিয়েছিলেন গাঙ্গুবাই। তিনি ছিলেন কামাথিপুরার মা। যৌনকর্মীদের কাছে তো বটেই। শোনা যায়, আজও কামাথিপুরার অনেক দেয়ালে গাঙ্গুবাইয়ের ছবিসহ পোস্টার টাঙানো আছে।

শুধু সহকর্মীদের নয়, তার রূপ ছুঁয়ে গিয়েছিল আন্ডারওয়ার্ল্ডের গ্যাংস্টারদের মনও। নিন্দুকেরা বলেন, তিনি বেশ প্রভাবশালী একজন দালাল ছিলেন। খদ্দের হিসেবে তিনি পেয়েছেন নৃশংস সব গ্যাংস্টারদের। যার ফলে অপরাধ জগতের খবর তার কাছে আসাই কেবল নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব বা আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়ারও সুযোগ থাকতো গাঙ্গুর হাতে।

গাঙ্গুবাইয়ের সবচেয়ে সুবিধাজনক ব্যাপার ছিল তার অবস্থান। যৌনপল্লী বলেই কি না, এই জায়গাটায় হাত দিতে সরকারের এক রকম সংকোচ ছিল। পুলিশের পক্ষে সেখানে গিয়ে অভিযান চালানোও ছিল মুশকিল। ফলে কালক্রমে জায়গাটা গ্যাংস্টারদের অভয়ারন্য হয়ে ওঠে। পালিয়ে বাঁচার জায়গা হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় এই স্থানটি।

অনেকে গাঙ্গুর ভরসায় অস্ত্র ও গোলাবারুদও এখানে মজুদ করে লাগতো। আর এর সুবাদে গাঙ্গুবাইও গ্যাঙ সম্রাজ্ঞীর মর্যাদা ভোগ করতেন। আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে জড়িত হয়ে মাদক ব্যবসা ও খুনের নির্দেশ দেওয়া সহ শহরের একজন প্রভাবশালী দালাল হিসেবে কামাথিপুরার ম্যাডাম হিসাবে পরিচিতি পেয়েছিলেন।

jagonews24

যৌনকর্মীদের সর্দারনী হওয়ার পরও গাঙ্গু রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগেরও সুযোগ পান। তিনি একবার দেখা করেছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে। সেখানে তিনি যৌনকর্মীদের সমস্যাদের কথা তুলে ধরেছিলেন। তার ব্যক্তিত্বে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও মুগ্ধ হন।

লেখক ও সাংবাদিক হুসাইন জাইদি ২০১১ সালে মাফিয়া কুইন্স অফ মুম্বাই নামে একটি বই লিখেন, সেখানে তিনি গঙ্গুবাইয়ের জীবনীর উপরেও একটি অধ্যায় লিখেন। সেখানে ষাটের দশকের শহরের অন্যতম শক্তিশালী মাফিয়া করিম লালার কথা উল্লেখ করেছিলেন তিনি।

করিম লালার দলের এক সদস্য গাঙ্গুবাইকে ধর্ষণ করেছিল, সেই বিচার নিয়েই করিম লালার কাছে গিয়েছিল গাঙ্গুবাই। রাখি পরিয়ে করিম লালাকে ভাই বানিয়েছিলেন। এরপরই গাঙ্গুবাই করিম লালার মাধ্যমে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে যুক্ত হন।

জাইদির বইয়ের একটি অধ্যায়ের উপর ভিত্তি করে সম্প্রতি সঞ্জয় লীলা বনসালি গাঙ্গুবাই কাঠিয়াওয়াড়ি নামে একটি চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। দেখে নিন সিনেমাটি। দুর্ধর্ষ এই নারীর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ের সাক্ষী হবেন আপনিও।

গাঙ্গুবাইয়ের স্বামী সংসার আর হয়ে ওঠেনি। চারটি বাচ্চা দত্তক নিয়েছিলেন তিনি। যার একটি ছিল ছেলে, বাকি তিনটি মেয়ে। গাঙ্গুবাই ২০০৮ সালে ৬৮ বছর বয়সে মারা যান।

কেএসকে/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।