শাড়ির আঁচলে স্বপ্ন আঁকেন মিলি
কানিছ সুলতানা কেয়া
সবার আগে তিনি ক্রেতার ভাবনাকে বুঝতে চেষ্টা করেন। তারপর তার মতো করেই সেই ভাবনা নিজে ভাবেন। পেন্সিলের টানে এঁকে ফেলেন সেই গল্প। এরপর তা স্থান পায় শাড়ির আঁচলে। এভাবে কাজে কথায় মিল রেখে ক্রেতাদের আস্থা অর্জন করেছেন অনলাইন পেজ চিত্রকরের স্বত্বাধিকারী সানজিদা ফেরদৌস মিলি। সম্প্রতি জাগো নিউজকে বলেছেন নিজের উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প।
সানজিদা মিলি রং নিয়ে খেলতে ভালোবাসেন। অন্যদের স্বপ্নকে রং-তুলিতে বাস্তব রূপ দেন তিনি। অন্যদের কল্পনায় যে চিত্র রয়েছে তা কাপড়ে ফুটিয়ে তোলেন। ছোটবেলা থেকেই আঁকা আঁকির প্রতি আলাদা ঝোঁক ছিল তার। তবে পরিবারের পক্ষ থেকে তেমন আগ্রহ ছিল না এর জন্য বাড়তি খরচ করে শেখানোর। তবে মিলি থেমে থাকেন নি, নিজের মতো করেই আঁকার কাজ চালিয়ে গেছেন।
স্কুলের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। শুধু ছবি আঁকা নয়, গান, কাওয়ালিসহ নানান ক্যাটাগরিতে তিনি অংশ নিয়ে পুরস্কার পেতেন। তবে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষার সুযোগ পাননি সানজিদা। এরপর স্কুল শেষে কলেজে যাওয়ার পর আঁকার অভ্যাস কমে যায় অনেকটাই। পড়াশোনার চাপ, অন্যদিকে পারিবারিক বাঁধা। সব মিলিয়ে এটা থেকে নিজেকে দূরেই রাখতেন।
তবে কলেজের পর আবার সেই ঝোঁক ফিরে আসে মিলির। তখন অনলাইনে অনেকেই ব্যবসা করছেন। কিন্তু পেইন্টিং নিয়ে তখনও তেমন কোনো পেজ ছিল না। যা ছিল তা সবই একই ধরনের। কারিগর দিয়ে একই ডিজাইনের হাজার হাজার শাড়ি। সে সময় এক বন্ধুর পরামর্শে অনলাইনে পেজ খোলেন মিলি। সময়টা ২০১৯ সালে। তখন পাশে পেয়েছেন বড় বোনকে।
সব সময় পাশে ছায়ার মতো ছিলেন মিলির বড় বোন। নানান পরামর্শ দিতে থাকেন তিনি। কাগজ ছেড়ে শাড়ি, কামিজে পেইন্ট করার পরামর্শ দেন। তবে সাহস করে উঠতে পারছিলেন না মিলি। এমন সময় এক আত্মীয়র জন্য শাড়ি পেইন্ট করেন তিনি। সেই শাড়ির অনেক প্রশংসা পান তিনি। এরপর আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় আরও কয়েকগুণ।
কিন্তু এর জন্য তার আরও জ্ঞানের প্রয়োজন। সামান্য এই জ্ঞান নিয়ে যে বড় পরিসরে কিছু করা যায় না তা ভালোই বুঝতে পারছিলেন মিলি। ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি নিয়ে ভর্তি হন বিজিএমইএ তে। সেখানে গিয়ে শিখতে শুরু করেন অনেক কিছু। যা এতদিন তিনি কল্পনাও করতে পারেননি, যে পেন্টিং নিয়ে আসলে এতো কিছু জানার আছে।
২০১৯ সাল, পুরোদমে পেজের কাজ করতে শুরু করেন মিলি। তার কাজ সবার থেকে আলাদা হওয়ায় অল্প দিনেই খুব ভালো সাড়া পেতে শুরু করেন। পেজের জন্য প্রথম যে কাজটি করেছিলেন মিলি তা আজও মনে আছে তার। একটি কামিজে সানফ্লাওয়ার এঁকে ছিলেন। যা বেশ ভালোই সাড়া ফেলেছিল সেসময়। অনেকেই তাকে অনুকরণ করেছে। তবে মিলির নিজস্বতা তাকে বরাবর অন্যদের থেকে আলাদা অবস্থানে রেখেছে।
এরপর বড় বোনের পরামর্শে ধীরে ধীরে শাড়ি, পাঞ্জাবিতে পেইন্ট করতে শুরু করেন। সুতি, হাফ সিল্ক, মসলিন শাড়িতে কাজ করেছেন তিনি। একেকটি শাড়ির দাম নির্ভর করে কাজের পরিমাণ এবং কাপড়ের উপর। তার করা একেকটি শাড়ির দাম ৩ হাজার থেকে ৬ হাজার পর্যন্ত। মসলিন কাপড়ের ক্ষেত্রে দাম বেশি হলেও অন্যান্য কাপড়ের ক্ষেত্রে দাম আরও কিছুটা কম।
চিত্রকরের সবচেয়ে বেশি বিক্রিত পণ্য কাপল ড্রেস। পরিবারের সবাই একই রকম পোশাক পরা এখন বেশ ট্রেন্ডি। এই সুযোগ বেশ ভালোভাবেই কজে লাগিয়েছেন এই উদ্যোক্তা। এ ছাড়াও কুশন কভারও রাঙিয়ে তোলেন তার শিল্প প্রতিভায়। পেজের একটি মোস্ট সেলিং পণ্য এটি। কুশনের দাম রয়েছে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে।
তবে শুধু পেইন্টিং নয় সুই সুতার কাজেও মিলির দক্ষতা প্রশংসনীয়। ক্রেতাদের চাহিদায় সেই কাজও করছেন পাশাপাশি। এ ছাড়াও আছে কাঠের, পুঁথির গয়না। মিলির একেকটি শাড়ি শেষ করতে লাগে ৭ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত। যেহেতু রং করার পর কাপড় রোদে দিতে হয় তাই সময় একটু বেশি লাগে। এজন্য মাসে খুব বেশি কাজ করতে পারেন না।
যেহেতু নিজেই সব করেন তাই লেখাপড়ার পাশাপাশি সব কিছু করা একটু কঠিনই বটে। এরপরও মাসে তার আয় ২০ হাজারের আশেপাশেই থাকে। যে মাসে কাজ বেশি হয় সে মাসে আরও বেশি। তবে পেইন্টিং শাড়ি বিক্রির উপযুক্ত সময় হচ্ছে যে কোনো উৎসব। যেমন পহেলা ফাল্গুন থেকে শুরু করে যে কোনো বাঙালি উৎসব। এ ছাড়াও বিয়ের সিজনে তার বিক্রি এবং কাজের চাপ বেড়ে যায় বহুগুণ। বর্তমানে হলুদের শাড়ির জন্য পেন্টিং শাড়ি, পাঞ্জাবির বেশ চাহিদা রয়েছে।
কাপড় কেনা থেকে শুরু করে ক্রেতার হাতে পৌছানো পর্যন্ত সব কাজ নিজে হাতেই করেন। কাপড়ে ডিজাইন করা, রং করা, রোদে দেওয়া এবং শেষে আয়রনের কাজ সবই করেন নিজের হাতে। কাজের জায়গায় যেন এতোটুকু ত্রুটি না থাকে, সেটা নিশ্চিত করতেই অন্য কারও উপর ভরসা করেন না। সব সময় ক্রেতার পছন্দকেই প্রাধান্য দেন। তবে তার নিজের করা সব পণ্যই ক্রেতারা পছন্দ করেছেন সব সময়।
মিলির অনুপ্রেরণা প্রতিষ্ঠিত উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি এই প্রজন্মের অনেকেই। তার মতো আরেকজন অনলাইন পেজের স্বত্বাধিকারী এবং উদ্যোক্তা মনিরা সুলতানা মায়াকে নিজের আইডল ভাবেন। কাজের ক্ষেত্রে ছোটবড় সব ধরনের পরামর্শ তার কাছ থেকে নিয়ে থাকেন মিলি। মিলির স্বপ্ন নিজের একটি ব্র্যান্ড তৈরি করা। তার পণ্য ছড়িয়ে যাক বিশ্বের সব প্রান্তে।
সব সময় চেষ্টা করেন দেশিয় কাপড় নিয়েই কাজ করতে। বিশেষ করে, তাঁত, মসলিন বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে লালন করে। সেই পণ্যগুলোকেই তিনি রাঙাতে চান তার কল্পনার রঙে। দেশের ঐতিহ্যকেই পুঁজি করে সেগুলো নিয়ে কাজ করতে চান। যা একসময় ছড়িয়ে যাবে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের মানুষের হাতে।
সানজিদা মিলি নিজে কোনো একটি নতুন পণ্য নিয়ে কাজ করার আগে বাজার যাচাই বাছাই করেন। এতে বাজারে কি ধরনের পণ্য রয়েছে, কোন পণ্যের চাহিদা বেশি, দাম কোথায় কেমন, অনলাইন এবং অফলাইনের পার্থক্যটাও বুঝে নেন। তিনি বলেন যে কোনো কাজ করার আগে তার প্রেক্ষাপটটা অনেক ভালো করে বুঝে নেওয়া উচিত।
যারা এই সেক্টরে আসতে চান, অর্থাৎ পেইন্টিংয়ের কাজ করতে চান। তাদের আগে অবশ্যই কাজ শিখে নিতে হবে। বুঝতে হবে রং এবং কাপড়। যে যে পণ্য নিয়েই কাজ করুক না কেন, সেই সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আপনার ভেতরের প্রতিভাকে অনেকবেশি প্রসারিত করে। ক্রেতার মন বুঝতে হবে। বাজার রিসার্চ করে ট্রেন্ড ফলো করতে হবে। তাহলেই একজন উদ্যোক্তা তার কাজে টিকে থাকতে পারবে।
কেএসকে/জেআইএম