জীবিত থেকেও যে মানুষটি ১৮ বছর মৃত ছিলেন!

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ১১:২৪ এএম, ২৫ জুন ২০২১

সালমান আহসান

মৃত মানুষ! এই মরার মতো পড়ে ছিল! আবার এই উঠে কোথায় চলে গেল? ঠাট্টার সুরে করা সংলাপটি এ বছর মুক্তি পাওয়া ভারতীয় সিনেমা ‘কাগজ’ এর। এ সিনেমায় মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন ‘গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর’ ও ‘মির্জাপুর’ খ্যাত অভিনেতা পঙ্কজ ত্রিপাঠি।

এই সিনেমাটি তৈরি হয়েছে উত্তরপ্রদেশের এক কৃষক লালবিহারীর জীবন কাহিনী নিয়ে। যাকে ভারতের ওই প্রদেশটির ভূমি অফিসের রেকর্ডে ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ১৮ বছর মৃত দেখানো হয়েছিল! তার জীবনে ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক এই ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে ‘কাগজ’ সিনেমায়। কী ঘটেছিল লালবিহারীর সঙ্গে? আজ জানাবো সেই কাহিনী।

লালবিহারীর জন্ম উত্তরপ্রদেশের আজমগড়ের আমিলো গ্রামে। তার বয়স যখন ২২, তখন একদিন ঋণ নিতে গিয়েছিলেন ব্যাংকে। সেখানে জমির দলিল চাইলে তিনি ছুটলেন ভূমি অফিসে। গিয়ে তো আক্কেলগুড়ুম! সেখানকার কাগজপত্রে তিনি মৃত!

jagonews24

প্রথমে হাস্যরসের সঙ্গে উড়িয়ে দিলেও ভূমি অফিসের কর্মচারী জানায়, তার জমিজমা সব চাচাতো ভাইদের নামে লেখা হয়ে গেছে। আরও পরে জানতে পারেন তার চাচা স্থানীয় ভূমি অফিসের কর্মকর্তাকে ঘুষ দিয়ে নিজের ছেলেদের নামে সম্পত্তি লিখে নিয়েছেন।

দুঃখের বিষয় হলো, তার চাচা মাত্র ৩০০ রুপি ঘুষের মাধ্যমে ভূমি অফিসের একজন সরকারি কর্মচারীকে (যে কি-না লালবিহারীর ছোটবেলার বন্ধু ছিল) হাত করে তার এই সর্বনাশ ঘটিয়েছিলেন। দিশাহীন হয়ে পড়েন লালবিহারী।

jagonews24

ক্রমেই লালবিহারী বুঝতে পারেন, এই আমলাতন্ত্রের জটিলতাকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে মাত্র একটি কাগজের মাধ্যমে কেউ কারও পরিচয় কেড়ে নিতে পারে। এমনকি মৃত বলেও চালিয়ে দিতে পারে! লালবিহারী মনোবল না হারিয়ে আইনগতভাবেই নিজেকে জীবিত প্রমাণ করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন।

এভাবেই জীবনের ১৮টি বছর ধরে বেঁচে থাকার প্রমাণ নিয়ে লড়েছেন এই মানুষটি। তার এই সংগ্রামের মাধ্যমেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘মৃত মানুষদের সংঘ’। এই সংঘের মাধ্যমে তিনি আমলাতন্ত্রের জটিলতায় সৃষ্ট সমস্যাটিকে সরকার ও জনগণের সামনে তুলে ধরার প্রয়াস চালান।

jagonews24

দ্রুতই তিনি খেয়াল করেন, এ সমস্যায় তিনি একাই জর্জরিত হননি, তার মতো আরও অনেক হতভাগ্য মানুষ জীবিত থেকেও মৃত হয়ে জীবনযাপন করছেন। ফলশ্রুতিতে ‘জীবন্মৃত’ মানুষেরা দলে দলে ভিড়তে থাকেন লালবিহারীর সংঘে।

মনে ক্ষোভ কাজ করলেও অনেক হাস্যরসাত্মক কাজও লালবিহারী ওই সময়টিতে করেছেন। সরকারি এক কর্মচারীকে ঘুষ দিয়ে কাজ করানোর জন্য তার এক চাচাতো ভাইকে অপহরণ করেছিলেন, নির্বাচনে লড়েছিলেন, বউয়ের বিধবা ভাতার জন্য সরকারি অফিসে আবেদন করেছিলেন। একবার বিধানসভায় ‘আমাকে বাঁচিয়ে তোলো’ প্লেকার্ড হাতেও ঢুকে পড়েছিলেন।

jagonews24

মৃত্যুই যখন নতুন সূচনা

অল্প বয়সেই লালবিহারীর বাবা মারা যান। তখন তার মা আরেকটি বিয়ে করে তাকে নিয়ে খলিলাবাদ থেকে আমিলো গ্রামে চলে যান। স্কুলের গন্ডির মধ্যে আনুষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা না পেলেও কম বয়সেই লালবিহারী বেনারসি শাড়ি বোনা শিখে ফেলেন। ২২ বছর বয়স থেকেই তিনি মৃত বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তির ওপর ভরসা করে, একটি কাপড় বোনার দোকান খোলার স্বপ্ন দেখেন।

ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গেলে তাকে স্থানীয় ভূমি অফিসে যোগাযোগ করতে বলা হয়। সেখানে তাকে লোন নেওয়ার আইনগত অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানায় অফিসের কর্মকর্তা (যে কি-না লালবিহারীর বন্ধু)। তিনি জানান, কাগজপত্র অনুযায়ী লালবিহারী মৃত!

jagonews24

পুরোপুরি সুস্থ এবং জীবিত একজন মানুষ হিসেবে সামনে দাঁড়িয়ে থাকার পরও সরকারি কাগজপত্রের উপর দৃঢ় বিশ্বাসী কর্মকর্তা বন্ধুটি তাকে জীবিত বলে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়! তার মা যখন তাকে নিয়ে আমিলো গ্রামে চলে আসেন; তখন তাদের অনুপস্থিতির সুযোগে তার চাচা ষড়যন্ত্র এবং কৌশল করে জমি নিজের নামে লিখে নেন।

সরকারি অফিস থেকে কোনো সহায়তা না পেয়ে লালবিহারী স্থানীয় আইনজীবীদের সহায়তা চন। তবে কেউই লালবিহারীর সমস্যাটিকে পাত্তা দেননি। বরং হাসি তামাশা করে আবার কেউ কেউ ‘ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে এমন ঘটনা ঘটেই থাকে’ বলে তাকে অবহেলা করেন।

jagonews24

সমস্যার সমাধান নিজেকেই করতে হবে- এই ভেবে লালবিহারী কাজে লেগে পড়েন। এক পুলিশকে ঘুষ দিয়ে সরকারি রেকর্ডে নিজেকে জীবিত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াসে স্বেচ্ছায় গ্রেফতার হওয়ার প্রচেষ্টা চালান। তবে পুলিশ তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে ঘুষ ফেরত দেন।

তা ছাড়া তিনি যেহেতু মৃত; তাই তার বিধবা বউকে ‘বিধবা ভাতা’ পাইয়ে দেওয়ারও বৃথা চেষ্টা করেছিলেন।
এসব কর্মকাণ্ডের ফলে স্থানীয় পত্রপত্রিকাগুলোতে লালবিহারীকে নিয়ে সংবাদ ছাপা হতে থাকে। ক্রমেই তিনি তার সমস্যা সমাধানের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন।

jagonews24

মৃত মানুষদের সংঘ

১৯৮০ সালে শ্যামলাল নামে এক রাজনীতিবিদ লালবিহারীর দুরবস্থা শুনে তাকে নিজের নামের শেষে 'মৃত' শব্দটি জুড়ে দিতে বলেন। তারপর থেকেই এখনো পর্যন্ত তিনি তার নামের সাথে মৃত(মৃতক) শব্দটি ব্যবহার করেন।

ওই একই বছরে তিনি মৃত মানুষদের সংঘ বা মৃতক সংঘ গড়ে তোলেন। একই সমস্যায় ভোগা আরো অনেক মানুষকে তিনি এই সংঘে আমন্ত্রণ জানান এবং তাতে উৎসাহব্যাঞ্জক সাড়া পান। তিনি জানতেন, মিডিয়ার সুদৃষ্টি পেলে তার কাজটি অতি দ্রুত সমাধান হবে।

সেজন্য ১৯৮৮ সালে তখনকার প্রধানমন্ত্রী ভিপি সিংয়ের বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাঁড়ান। নির্বাচনে জিততে না পারলেও, এই নির্বাচন তার জন্য বেশ কাজে দেয়। কারণ এতে করে বহুল সংখ্যক লোক তার সঙ্গে ঘটা অন্যায় সম্পর্কে জানতে পারে।

jagonews24

অবশেষে ১৯৯৪ সালে জেলা প্রশাসন ওই ত্রুটিযুক্ত ভূমি রেকর্ড সংশোধন করে। ফলে রেকর্ড থেকে লালবিহারীর মৃত অন্তর্ভুক্তিটিও বাতিল হয়ে যায়। এরই মধ্য দিয়ে লালবিহারী ভারতীয় আমলাতন্ত্র এবং দুষ্কৃতকারী আত্মীয়দের সঙ্গে ১৮ বছর ধরে ‘মরণোত্তর’ সংগ্রাম চালিয়ে অবশেষে প্রমাণ করেই ছাড়েন যে তিনি জীবিত!

প্রথমদিকে যখন তিনি আইনিভাবে লড়াই চালিয়ে যেতে শুরু করেছিলেন; তখন তার পাশে কেউই দাঁড়ায়নি। বরং বলেছে- এই পঁচে যাওয়া সিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়াই করা তুমি পারবে না। তবে লালবিহারী চেষ্টা করেছেন প্রাণপণে। পরবর্তীতে যা হলো তা এক চমৎকার ইতিহাস।

জেএমএস/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।