স্বপ্ননগরে স্বপ্ন বুনি

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪:৩৬ পিএম, ১০ জুন ২০২১

তৌহিদ এলাহী

প্রিয় লেখক মানিক বন্দোপাধ্যায়। অনেকের মতে কিংবা তর্ক সাপেক্ষে। মানিক শুধু গদ্যকার হিসেবে নজরুল-রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বড়। ফ্যান্টাসির বাইরে জীবনঘনিষ্ঠতার বলেই তিনি শক্তিশালী। তার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজেক্ট- পদ্মা নদীর মাঝি, সুন্দরতম স্বপ্ন ময়নাদ্বীপ। শ্বাপদসংকুল ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে দ্বীপ কিনে তার চেনা মানুষগুলোকে একত্র করেছেন ময়নাদ্বীপের বাসিন্দা হিসেবে।

প্রজেক্টের অংশ হিসেবে মানিক তৈরি করেছেন হোসেন মিয়া, কুবের মাঝি, কপিলার মত চরিত্র। যাদের পূর্ণতা পেয়েছে ওই ময়নাদ্বীপকে কেন্দ্র করে, ময়নাদ্বীপে গিয়ে। একটি পরিপূর্ণ সমাজের স্বপ্ন তিনি দেখিয়েছেন পদ্মা নদীর মাঝিতে। জীবন সাহিত্যের মলাটের সুন্দরতম গল্প নয়। অধিকন্তু সাহিত্যই দিনশেষে নিয়তির হাতে সঁপে দেওয়া যাপিত অপূর্ণাঙ্গ মানবজীবনের প্রতিচ্ছবি।

কাকতালীয়ভাবে, জীবনকালে দেখা সুন্দরতম একটি গদ্যের সাথে যুক্ত হওয়ার সৌভাগ্য হলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘরগুলো করতে গিয়ে। ছোট আলফাডাঙ্গা উপজেলায় ৬০০টি ঘর এনে দিয়েছেন জেলা প্রশাসক স্যার। জুন মাস নাগাদ শেষ হয়ে যাবে ৫০০ ঘরের কাজ। মাটি ভরাট ও স্থিতিকরণহেতু বাকি কাজ জুলাই মাস নাগাদ শেষ হবে বলে আশা করা যায়। সবগুলো ঘর করতে গিয়ে উপজেলা প্রশাসন উদ্ধার করেছে পঞ্চাশ একরের বেশি বেহাত হয়ে যাওয়া সরকারি খাস জমি।

যা হোক, মোট ৬০০ ঘরের মধ্যে ২০০ ঘর নিয়ে গোপালপুর ইউনিয়নের চরকাতলাসুর গ্রামে একই স্থানে গড়ে তোলা হচ্ছে প্রজেক্ট ‘স্বপ্ননগর’। ৭০০ মিটার ব্যাসার্ধের মধ্যেই থাকবে আরও ৫০টি ঘর। এই ২৫০ ঘর নির্মাণ করা আমাদের দায়িত্ব। এটি হয়তো সবাই করে। ঘর তৈরি বাদে বাকি সব কর্মযজ্ঞে আমরা সাহিত্যকথার ছোটখাট চরিত্র।

একদম শুরুর দিকে মোটামুটি হত্যা-হুমকি মাথায় নিয়ে ৩১ একর খাস জমি উদ্ধার। এ কাজ খুব কঠিন। ম্যাকিয়াভেলি বলেছেন, ‘মানুষ তার বাপের সম্পত্তি হারানোর ব্যথার চেয়ে বাপ হারানোর ব্যথা দ্রুত ভুলে যায়।’ আমার মনে হয়েছে, কেউ কোনভাবে সরকারি সম্পত্তি হস্তগত করলে, তা বাপের সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করে। এই উদ্ধারকৃত সম্পত্তির ঝোপঝাড় কেটে ঘরের কাজ শুরু।

jagonews24

এখানে ঘর করলেও সে অর্থে জায়গাটি প্রতিষ্ঠিত গ্রোথ সেন্টার নয়। আর এখানেই আসলে কাজ করার সুযোগ। ২০০টি পরিবারের মধ্যে ১৭০টির মত মুসলিম পরিবারের জন্য প্রয়োজন মসজিদ-ঈদগাহ। ৩০টি সনাতন ধর্মাবলম্বী পরিবারের জন্য প্রয়োজন প্রার্থনাগৃহ। আশেপাশে নেই কোন উচ্চ বিদ্যালয়। কিছু দূরে রয়েছে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বাজার ৩ কিলোমিটার দূরে। নতুন বাসিন্দাদের দরকার নাগরিক সুযোগ-সুবিধা। শিশুদের দরকার খেলার মাঠ। তাই প্রয়োজন সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা।

তবে এটি পরিকল্পনা বা ভবিষ্যৎ চিন্তা হিসেবে সীমাবদ্ধ নেই। ইতোমধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে ১৬ শতাংশ জমিজুড়ে মসজিদ ও ঈদগাহ। ৮ শতাংশ জমির বাউন্ডারি রেখে নির্মাণ করা হয়েছে মন্দির। ১.৫ একর জমিজুড়ে স্থাপন করা হয়েছে বাজার, চান্দিনা ভিটির কাজ চলছে। ২ একর জমি রাখা হয়েছে স্কুল ও খেলার মাঠের জন্য। এগুলোর ভূমি উন্নয়নের কাজ চলমান। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিকের ৮ শতাংশ জায়গা আলাদা করে ভূমি উন্নয়ন করে রাখা হয়েছে। এটি কেন্দ্রীয় সরকারের বিষয় হওয়ায় কিছুটা সময় লাগবে হয়তো। অদূরে ৯ একর জমিজুড়ে কাজ শুরু হচ্ছে নানা প্রজাতির দেশীয় গাছপালা রোপণের মাধ্যমে ইকোপার্ক।

সবকিছুর পর যেখানে যেতে হবে, সেই কবরস্থানের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ শতাংশ জমি। কমিউনিটি ক্লিনিক বাদে বাকি সব কিছুর কাজ শেষ হবে জুলাই মাসের মধ্যেই। ২৮টি গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজ শেষ হবে ১৫ জুনের মধ্যে। নির্মাণকৃত সবগুলো ঘরের বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে এ মাসের মধ্যেই। ঘর বাদে বাদ বাকি সব পরিকল্পনার অর্থসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান।

jagonews24

স্বপ্ননগরের আলাদা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, বেদখলকৃত খাস জমির প্রাচুর্য থাকায় ২০০টি পরিবারের মধ্যে ১৫০ পরিবার পাচ্ছে তিন শতাংশ করে জমি। বাকিরাও ঘরসহ দুই শতাংশ জমির পাশে পাবে ব্যবহারযোগ্য কমন স্পেস। যাতে তারা করে নেবে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগলের ক্ষুদ্র খামার ও অল্প বিস্তর মৌসুমী সবজির চাষবাস করার সুযোগ। প্রকল্প ঘিরে থাকছে প্রশস্ত চলাচলের রাস্তা। আপাতদৃষ্টিতে উপজেলা পর্যায় থেকে যা যা করা সম্ভব, সবই শেষ হবে জুলাই মাসের মধ্যে। মধুমতির নদীভাঙনের কবলে নিস্ব হওয়া কিংবা স্থায়ী ঠিকানাহীন মানুষগুলোর ঠাঁই হচ্ছে এ স্বপ্ননগরে।

মানিকের ময়নাদ্বীপের তিনি শেষ দেখাননি। একেকটি সমাজ ও সভ্যতার শেষ কথা বলে কিছু নেই। ভাঙা-গড়াই এর নিয়তি। মার্কসবাদী দৃষ্টিতে দেখলে মানিক হয়তো সফল হননি। তিনি ময়নাদ্বীপকে দেখিয়েছিলেন কুবেরের চোখে, যেখানে হোসেন মিয়া সামন্তপ্রভু। আবার হয়তো তিনি সফল, প্রাণহীনের মাঝেও প্রাণের সূচনারেখা তিনি দেখিয়েছেন। দেখিয়েছেন ব্যক্তিপ্রচেষ্ঠা সভ্যতা গড়ে তুলতে পারে না, কিন্তু শুরুর বাঁশি তো বাজাতেই পারে। ধনঞ্জয়, গনেশ, আমিনুদ্দি, রাসু, পীতম মাঝি, বশির, এনায়েত- এদের কেউ কেউ আবার এদের বাইরেও অনেকেই ময়নাদ্বীপে গিয়েছিলেন। কেউ কেউ পালিয়েছেন, আবার মানিক নিজেই ময়নাদ্বীপ থেকে বের করে দিয়েছেন অনেককে।

প্রজেক্ট স্বপ্ননগরের গদ্যটি লিখেছেন জেলা প্রশাসক স্যার। স্বপ্ননগর নামটিও তার দেওয়া। আমরা কেউ কেউ তার দু’একটি চরিত্র, যাদের স্যারের গল্পের প্লটের প্রয়োজনে কিছু কিছু ভূমিকা আছে। মানিকের গল্পে হোসেন মিয়া, কুবেরের পরিবর্তে রহিম মিয়া বা যে কাউকে বসালেও গল্পের ক্ষতিবৃদ্ধি হতো না। আমাদের ক্ষেত্রেও তাই। ঔপন্যাসিক যেভাবে চাইবেন; সেভাবেই এগোবে তার প্লটের চরিত্রগুলো।

আমার ধারণা, এই স্বপ্ননগর সফল হবে। হয়তো কখনো ভাঙবে। আবার সময় তার নিজ প্রয়োজনেই অনেক দূর এগিয়ে নেবে। ইচ্ছে আছে, যদি বেঁচে থাকি, যেখানেই থাকি- দু’চার বছর পর পর হয়তো লুকিয়ে দেখে যাব। হিসেব করে দেখব, কতটুকু শোরগোল বেড়েছে স্বপ্ননগরে, কয়টি নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। আর স্বপ্ননগরের ওই গোরস্থানের স্থায়ী বাসিন্দাই বা হয়েছে ক’জন?

লেখক: উপজেলা নির্বাহী অফিসার, আলফাডাঙ্গা, ফরিদপুর।

এসইউ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।