বঙ্গবন্ধু ও বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:০৯ পিএম, ০৭ জুন ২০২১

রিপন আহসান ঋতু

আমাদের স্বাধীনতা যেমন একদিনে অর্জিত হয়নি; তেমনই স্বাধীনতা সংগ্রামের এ পথও একদিনে তৈরি হয়নি। সময়োপযোগী রাজনৈতিক কৌশল রচনা ও অবলম্বন এবং তার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুই ধাপে ধাপে বাঙালি জাতিকে পৌঁছে দেন স্বাধীনতার লক্ষ্যে। ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবী ছিল তেমনই এক কৌশল রচনা।

ছয় দফা কোনো রাতারাতি কর্মসূচি ছিল না। এর প্রস্তুতি ছিল দীর্ঘদিনের। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব, ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগ, ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম, ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন—এসবই ছয় দফার ভিত তৈরি করেছে।

১৯৫৮-১৯৬৮ এই দীর্ঘ ১০ বছর চলে পাকিস্তানে আইয়ুব খানের স্বৈরশাসন। ৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয়। ১৭ দিন ধরে চলে এই যুদ্ধ। পাক-ভারত যুদ্ধ চলার সময় পূর্ব পাকিস্তানকে একদম অরক্ষিত অবস্থায় রাখা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং অস্ত্র-শস্ত্রের এমন অবস্থা ছিল না যে, ভারতের আক্রমণের মোকাবিলা করতে পারত। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিবৃতি দিয়েছিলেন এভাবে, ‘চীনের ভয়ে ভারত পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধে জড়াতে সাহস করেনি।’ এর প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানকে ১৭ দিন যুদ্ধকালীন সময়ে এতিমের মতো ফেলে রাখা হয়েছে। ভারতীয় সৈন্যরা যদি দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত লেফট রাইট করে হেঁটে যেত তবুও তাদেরকে বাধা দেয়ার মতো অস্ত্র বা লোকবল কিছুই পূর্ব বাংলার ছিল না। আর চীনই যদি আমাদের রক্ষাকর্তা হয় তবে পশ্চিম পাকিস্তানের বদলে চীনের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলেই হয়।’ বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের এই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে প্রবলভাবে মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হন।

বঙ্গবন্ধু যুদ্ধকালীন পূর্ব বাংলার নিরাপত্তাহীনতার কথা বিবেচনায় নিয়ে ও স্বায়ত্তশাসনের মূল দাবিসমূহ সন্নিবেশিত করে লাহোরের মাটিতে দাঁড়িয়ে তাঁর ৬ দফা দাবী ঘোষণা করেন। আসলে সেটা ছিল পাকিস্তানভিত্তিক বিরোধী দলের একটা জাতীয় সম্মেলন। পাক-ভারত যুদ্ধের পর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় তাসখন্দে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়। এই চুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে পাকিস্তানের বিরোধী দলীয় রাজনীতিবিদরা ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় সম্মেলন ডাকা হয়। সেখানে ৬ দফার উত্থাপনটা ছিল বেশ কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কখনো তাঁর সিদ্ধান্তে ভুল করেননি। কেননা ইতোপূর্বেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করার। তাই বিরোধী দলের ওই সম্মেলনে সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানে সমস্ত বিরোধী দল যেসব রাজনৈতিক প্রশ্নের অবতারণা করেন, বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানের দলসমূহ কী বলতে চেয়েছিল, সেদিকে বঙ্গবন্ধু দিকপাত না করে, সুযোগ বুঝে পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ও পূর্ব বাংলার জনগণের জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদানের দাবি নিয়েই তিনি ৬ দফা পেশ করেন।

ছয় দফার জন্মের পেছনে মূল কারণ ছিল মূলত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক বৈষম্য। জন্মের পর থেকে পাকিস্তান যেসব বৈদেশিক সাহায্য পেয়েছে বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তার বেশিরভাগ ব্যয় হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানের ‘সোনালি ফসল পাট’ বিদেশে রফতানি করে যে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হতো, সেটাও চলে যেত পশ্চিম পাকিস্তানে। বৈদেশিক বাণিজ্যের ৬০ শতাংশ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের কিন্তু প্রায় সমস্ত অর্থ ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। বিদ্যমান এমন অসংখ্য বৈষম্যের হাত থেকে বাঙালিকে মুক্ত করতেই ৬ দফা কর্মসূচি দেন।

এ কর্মসূচিতে ছিল—পাকিস্তান ফেডারেশনে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, সার্বজনীন ভোটাধিকার ব্যবস্থা প্রবর্তন; ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়; পূর্ব ও পাশ্চিম পাকিস্তান পৃথক কিন্তু সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু কিংবা একক মুদ্রা—তবে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ও দুটি আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংক স্থাপন; সব ধরনের কর ও শুল্ক ধার্য ও আদায় করার ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে; দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক হিসাব থাকবে, অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা থাকবে প্রদেশের হাতে এবং প্রতিরক্ষায় পূর্ব পাকিস্তানকে সাবলম্বী করার জন্য নৌবাহিনীর সদর দফতর স্থানান্তর, পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা স্থাপন ও আধাসামরিক রক্ষীবাহিনী গঠন।

ফলে ৬ দফা মানুষের প্রাণের দাবি হয়ে ওঠে। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ছয় দফা বাস্তবায়নের দাবীতে সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। সেদিনের হরতাল কর্মসূচিতে ধর্মঘটি ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য সরকারের নির্দেশে পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। ফলে হরতালে নির্বিচারে গুলি চালায় ও লাঠিপেটা করে পুলিশ ও ইপিআর। টঙ্গী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে মনু মিয়া, শফিক, শামসুল হকসহ ১১ জন বাঙালি শহীদ হন। প্রায় আটশ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মী এবং হাজারো নিরীহ মানুষকে গ্রেফতার করা হয়। ছয় দফার পক্ষে ৭ জুনের হরতাল এতটাই সর্বব্যাপী ছিল যে, এ সম্পর্কে কোনো রকম প্রতিবেদন মুদ্রণ ও প্রকাশের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল।

৬ দফা দাবীর ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন আরও ব্যাপকভাবে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সভা, সমাবেশ, প্রতিবাদ মিছিল, প্রচারপত্র বিলিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এ দাবীর প্রতি ব্যাপক জনমত গড়ে তোলার কার্যক্রম শুরু হয়। এদিকে সরকারি নির্যাতনও বাড়তে থাকে। তবে যত বেশি নির্যাতন আইয়ুব-মোনায়েম গংরা চালাতে থাকে, জনগণ তত বেশি তাদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং সব নিপীড়ন উপেক্ষা করে আরও সংগঠিত হতে থাকেন।

পরিস্থিতি দেখে সামরিক শাসক আইয়ুব খান হুমকি দিলেন এভাবে, ‘প্রয়োজন হলে অস্ত্রের মুখে এর জবাব দেয়া হবে।’ বঙ্গবন্ধু কঠিন স্বরে বললেন, ‘কোনো হুমকিই জনসাধারণকে ৬ দফা দাবী আদায় আন্দোলন থেকে নিবৃত্ত করতে পারবে না।’ শুরু হলো ধরপাকড়, নির্যাতন, জেলজুলুম। সেটি ছিল গণজাগরণের বিস্ফোরিত সময়। বাঙালি রাস্তায় নেমেছিল। সিদ্ধান্ত নিয়েছিল লক্ষ্য অর্জন ছাড়া ঘরে ফিরবে না। বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করলেন: ‘সংগ্রাম করিয়া আমি আবার কারাগারে যাইব, কিন্তু মানুষের প্রেম-ভালোবাসার ডালি মাথায় নিয়া দেশবাসীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করিতে পারিব না।’ মুহুর্মুহু করতালি ও গগনভেদী জিন্দাবাদ ধ্বনির মধ্যে তিনি ঘোষণা করেন, ‘বঞ্চিত বাঙালি, সিন্ধি, পাঞ্জাবি, পাঠান আর বেলুচের মধ্যে কোন তফাৎ নাই—কায়েমী স্বার্থবাদীদের শোষণ হইতে দেশের উভয় অংশের জনগণের মুক্তির একমাত্র পথ হইল আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও অর্থনৈতিক আজাদী।’

১৯৬৬ সালের ৮ মে নারায়ণগঞ্জে আয়োজিত সভায় বক্তৃতা করার পরে দেশরক্ষা আইনের ৩২ (১) ‘ক’ নম্বর ধারায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর সাংবাদিকদের বলতেন, ‘আমি যতদিন গভর্নর, শেখ মুজিবকে জেলেই থাকতে হবে।’ ৬ দফা কর্মসূচি বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতারের পরে ব্যাপক আকার ধারণ করে। জনগণ মিছিলে গণআন্দোলনের সাহসে উজ্জীবিত হয়। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং ৬ দফার সমর্থনে হরতাল পালন শুরু হয়। ছাত্র-জনতা ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হলে ১৪৪ ধারা জারি করে গভর্নর। স্লোগান ওঠে, ‘জেলের তালা ভাঙবো শেখ মুজিবকে আনব।’

পাকিস্তানের শাসকরা বুঝতে পারে, এতদিন যে দাবী নিছক রাজনৈতিক দলের সম্মেলন ও জনসভার প্রস্তাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল—তা নতুন মাত্রা পেয়েছে। বাঙালিরা হিসাবের পাওনা কড়ায়গণ্ডায় বুঝে নিতে প্রস্তুত হয়ে উঠছে। দাবি আদায়ে সংগঠন চাই, আন্দোলন চাই এবং তার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের প্রয়োজন পড়বে সে উপলব্ধিও ততদিনে হয়ে গেছে। নেতাও পেয়ে গেছেন তারা। আগরতলা ষড়যন্ত্রের দায়ে যখন তাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা হয়; তখন জনগণ এই মহান নেতাকে বরণ করে নেয় বঙ্গবন্ধু হিসেবে।

ছয় দফা থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের কাল পর্ব আমাদের যেসব রাজনৈতিক শিক্ষা দেয়—এক, সঠিক সময়ে সঠিক কর্মসূচি ও বাস্তবায়ন কৌশল উপস্থাপন। দুই, উপযুক্ত সাংগঠনিক প্রস্তুতি। তিন, জনগণকে সচেতন ও সংগঠিত করা। বঙ্গবন্ধু ও তার দল আওয়ামী লীগ এটা করতে পেরেছিল বলেই ১৯৬৬ সালের ৭ জুনের হরতালে অভাবনীয় সাড়া মিলেছিল। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান সফল হয়েছিল এবং ১৯৭১ সালে বিপুল আত্মত্যাগে অর্জিত হয়েছিল স্বাধীনতা। ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবীর মধ্যদিয়েই পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতা পেয়েছিল বাঙালি জাতি।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক।

এসইউ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।