এই গরমে পানির অপচয় রোধের উপায়
এখন চলছে করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার যুদ্ধ। বাঁচার জন্য ক’দিন বাদে শুরু হবে পানি নিয়ে যুদ্ধ। এ যুদ্ধের প্রথম শিকার হবেন শহরের মানুষ। কারণ বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি বাস করে শহরে। কিন্তু শহরগুলোর মোট আয়তন স্থলভাগের মোট পরিমাণের চার শতাংশেরও কম। তারপরও বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ মেট্রোপলিটন শহরে পানি সংকট আজ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। পানি নিয়ে টানাটানিতে নাগরিক জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ।
এ সময়ে রাজধানী ঢাকায়, আবহাওয়া বৈরিতায়, তীব্র দাবদাহের কারণে নগর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে ও পবিত্র রমজানের কারণে রাজধানীর অধিকাংশ বাসিন্দা নিজ নিজ বাসায় অবস্থান করছেন। ফলে বাসায় পানি ব্যবহার ও চাহিদা বেড়েছে। প্রতিবছর এ সময়ে এমনিতেই পানি সংকট দেখা দেয়। ইতোমধ্যে কিছু এলাকায় তীব্র পানি সংকটের কথা পত্র-পত্রিকায় এসেছে। ঢাকার কোন কোন এলাকার বাড়িতে এমনিতে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পানি আসে না। লাইন থেকে যুদ্ধ করে মোটর দিয়ে বাতাস পাম্প করে টেনে আনতে হয় পানি। আর বছরের এ সময়ে মোটর দিয়ে পাইপ থেকে পানি টানলেও পানি আসে না। লাইনে পানিই থাকে না। মধ্যরাতে মোটরে পানি টানলে হয়তো এক-দু’ঘণ্টা পানি পাওয়া যায়। ভাবা যায়! এই পানি নিয়ে বেঁচে থাকার পরিস্থিতিটা কিন্তু যুদ্ধের চেয়ে কম নয়।
পরিসংখ্যান মতে, ঢাকায় দৈনিক পানির প্রয়োজন ২২০ থেকে ২৩০ কোটি লিটার। ঢাকার পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ওয়াসা গড়ে দৈনিক পানির চাহিদার পুরোটাই সরবরাহ করে থাকে। অবাক হলেও সত্যি, গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে গৃহস্থালি কাজে পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি এবং পানি ব্যবহারে অপরিমিতিবোধের কারণে প্রতিদিন ত্রিশ শতাংশেরও বেশি পানি নষ্ট হচ্ছে। যা দিয়ে ত্রিশ লাখ মানুষের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। ইতোমধ্যে আফ্রিকা গৃহস্থালি কাজে মাথাপিছু সাতচল্লিশ লিটার, এশিয়ায় পঁচাশি লিটার, যুক্তরাজ্য তিনশ চৌত্রিশ লিটার ও যুক্তরাষ্ট্র পাঁচশ সাতাশি লিটার এভাবে প্রত্যাহার করে পানিসম্পদ সাশ্রয় করেছে। আমাদের দেশেও গৃহস্থালি কাজে পানির এই অপরিমিত ব্যবহার রোধ করা জরুরি। আসুন! আমরাও পানিসম্পদ সাশ্রয় করি। পানি ব্যবহারে সাবধান থাকি। পানি সাশ্রয়ের উপায়গুলো জেনে নেই।
বাথরুমে পানি ব্যবহার
করোনাভাইরাসের জন্য এখন বাইরে থেকে এসে ২০ সেকেন্ড ধরে হাত-মুখ তো ধুতেই হবে। এভাবে হাত ধোয়া, মুখ ধোয়া, দাঁত ব্রাশ করা কিংবা শেভিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে খুলে রাখা কল বন্ধ রেখে পানি সাশ্রয় করুন। মনে রাখবেন, চার সদস্যের একটা পরিবার এভাবে বিরতি দিয়ে কল ব্যবহার করলে প্রতিদিন সাশ্রয় হয় আশি লিটার পানি। আপনার টয়লেটে কখনো ছাইদানি কিংবা ময়লা ফেলার ডাস্টবিন বানাবেন না। অনেকেই টয়লেটে টিস্যু পেপার ও পরিত্যক্ত জঞ্জাল ফেলে রাখেন। যা পরিষ্কার করতে প্রয়োজন হয় অতিরিক্ত পানি। তাই ময়লা ফেলার আলাদা ঝুড়ির ব্যবস্থা করুন। এক নাগাড়ে দীর্ঘক্ষণ ঝরনা ছেড়ে দিয়ে গোসল করবেন না। ঝরনায় গোসল করতে পাঁচ মিনিটের বেশি সময়ের দরকার নেই। মনে রাখবেন, বালতিতে জমানো পানির চেয়ে ঝরনার পানিতে গোসলে পানির খরচ বেশি হয়। বাথটাবে পানি ছাড়ার আগে অবশ্যই পানি নিষ্কাশনের নলটা বন্ধ করে নিন। সব সময় অর্ধেক পানি ভরবেন। কানায় কানায় ভরলে পানি উপচে পড়ে অপচয় হয়। বাথরুমের ওভার হেড ট্যাঙ্কে পানি ওঠানোর আগে টয়লেট ট্যাঙ্কে অদৃশ্য কোন ছিদ্র রয়েছে কি-না, পরখ করুন। এজন্য ট্যাংকের উপর কয়েক ফোটা খাবার রং ছড়িয়ে দিয়ে মিনিট দশেক অপেক্ষা করুন। পানি ভরার পর যদি দেখেন ট্যাঙ্কের উপর ছড়ানো রং কোথাও ধুয়ে গেছে। বুঝবেন ওখানেই রয়েছে চোরা ছিদ্র। যতদ্রুত সম্ভব ছিদ্র বন্ধের ব্যবস্থা করুন। দুধের একটা খালি কৌটায় পানি ভরে টয়লেট ট্যাংকের ভিতরে ডুবিয়ে রাখুন। এই কৌশল প্রয়োগে প্রতিদিন কমসে কম দশ লিটার পানি সাশ্রয় হবে।
রান্নাঘরে পানি ব্যবহার
বাসন ধোয়া, মাজা-ঘঁষার সময় এক মনে কল ছেড়ে দিয়ে ধোবেন না। বেসিনে কিংবা একটা পাত্রে পানি জমিয়ে তারপর ধোবেন। ডিস ওয়াসারে বাসন-কোসন পরিষ্কার করলে অবশ্যই পরিপূর্ণ ভরার পর সুইচ টিপবেন। এভাবে ডিসওয়াসারে প্রতিবার পঞ্চাশ লিটার পানি ব্যবহার ও ব্যয় সাশ্রয় হয়। সবজি ও ফল-মূল বেসিনে পরিষ্কার করুন। ময়লা তাড়াতে যথাসম্ভব পানির পরিবর্তে ব্রাশ ব্যবহার করুন।
ওয়াশিং মেশিনে কাপড় ধোওয়ার আগে নির্দিষ্ট মাত্রায় পানিপূর্ণ করে সতর্কতার সঙ্গে চালু করুন। কল ছেড়ে দিয়ে গরম পানি বের করে দিয়ে তারপর ঠান্ডা পানি ব্যবহার করার বদভ্যাস যদি থাকে, তবে তা এ মুহূর্তেই ত্যাগ করুন। ঠান্ডা পানীয়ের জন্য সব সময় ফ্রিজে পানি সংরক্ষণ করুন। ফ্রিজ থেকে মাংস, মাছ বের করে বরফ ছাড়াতে জমানো পানি ব্যবহার করুন। আগের রাতে ফ্রিজের নরমাল চেম্বারে রাখলেও বরফ গলে যাবে। এ কাজে মাইক্রোওয়েভ ওভেনও ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু বরফ ছাড়াতে কলের প্রবাহিত পানি ব্যবহার কখনোই করবেন না। বাসন-কোসন হাতে ধোয়ার সময় কখনোই কল ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথাও যাবেন না। পানি রাখার পাত্র দু’টো থাকলে একটাতে সাবান পানি, অন্যটাতে পরিষ্কার পানি ব্যবহার করুন। পানির পাত্র একটা থাকলে বাসন-কোসন একসঙ্গে না চুবিয়ে স্পঞ্জের সাহায্যে কিংবা হাতের চেটোয় হাল্কা গরম পানি নিয়ে একটু একটু করে পানি দিয়ে প্রথমে পরিষ্কার করুন। এরপর পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে নিন।
বাগানে পানি ব্যবহার
শখ করে ঢাকা শহরে অনেকেই ছাদ বাগান করেন। বাগানের চারাগাছে দিনের ঠান্ডা সময় অর্থাৎ ভোরবেলা পানি দিন। এতে পানি বাষ্পীভুত হবে না। বাগানের গাছের নিচের মাটিতে পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কমপোস্ট বা জৈব সার ‘এগ্রো মিশ্র সার’ ব্যবহার করুন। পানি বাষ্পায়ন এড়াতে গাছের গোড়ায় কচুরিপানা, কাঠের গুড়া, পচা পাতা ব্যবহার করতে পারেন। এতে মাটি ক্ষয় রোধ হবে এবং বাগান থাকবে আগাছামুক্ত। বাগানে পানি সেচের আগে পরখ করে নিন, হোজ পাইপটির মুখ কলের সঙ্গে ঠিকঠাক লাগানো আছে তো? পাইপে কোথাও কোনো রকম ছিদ্র থাকলে খুঁজে বের করুন এবং মেরামত করুন। বাগান পরিচর্যাকারীকে অল্প পানি ব্যবহারের পরামর্শ দিন। বড় বড় ঘাসগুলো কেটে ফেললে পানি কম লাগবে। ছাদ বাগানে ছোট শিকড়যুক্ত গাছের পরিবর্তে লম্বা শিকড়যুক্ত গাছ রোপণ করুন। এতে ছাদ বাগানে প্রতিদিন পানি সেচের প্রয়োজন হবে না। ছাদ বাগানে টবের পাশে ইটের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখলে টবের মাটি ভেজা ভেজা থাকে এবং পানি বাষ্পীভুত হওয়া থেকে রক্ষা পায়। মনে রাখবেন, কোন অবস্থাতেই বাগানে সপ্তাহে এক ইঞ্চির বেশি পানি সেচ দেবেন না। এক ইঞ্চির বেশি পানি দিলে গাছের শিকড় পচে গাছ মরে যায়। অতএব বেশি পানি দিয়ে গাছ তাড়াতাড়ি বড় করার চেষ্টা করা বোকামি।
পরিবেশের অন্যতম প্রধান উপাদান হচ্ছে পানি। দিন দিন পানির চাহিদা বেড়েই চলেছে। পানি ছাড়া একদিনও চলা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। প্রতিদিন প্রায় সব ধরনের কাজে আমাদের পানি লাগে। আমাদের শরীরের দুই-তৃতীয়াংশই হচ্ছে পানি যা রক্তে ৮৩ ভাগ, হাড়ে ২২ ভাগ, মস্তিষ্কে ৭৪ ভাগ, পেশিতে ৭৫ ভাগ। অর্থাৎ শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোর সঠিক কর্ম সম্পাদনের জন্য পানির প্রয়োজনীয়তা অনেক। প্রতিদিন যদি যথেষ্ট পরিমাণ পানি পান না করা হয় তাহলে শরীর দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ে। গাছের গোড়ায় পানি না দিলে যেমন শুকিয়ে যায় তেমনি পানির অভাবে আমাদের শরীরে পুষ্টি সরবরাহ ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যাহত হয়। তাই পানি নিয়ে যুদ্ধ শুরুর আগেই মহামূল্যবান সম্পদ পানি নিয়ে বেঁচে থাকতে আমরা প্রস্তুত হই। পানি ব্যবহারে সাবধান ও মিতব্যয়ী হই। পানি অপচয় রোধ করি। আসুন, জীবনের জন্য অপরিহার্য এই সাশ্রয়ে আমরা দায়িত্ববান হই।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এসইউ/এএসএম