১৫ বছর বয়সে বিশেষ বর্ণমালা তৈরি করেন অন্ধ ব্রেইল

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:২১ পিএম, ০৪ জানুয়ারি ২০২১

অডিও শুনুন

অন্ধ হওয়া মানেই পরিবার বা সমাজের বোঝা নন। অন্ধরাও স্বাভাবিক মানুষের মতো বাঁচতে পারেন। এমনকি পড়ালেখা শিখে নিজ পায়েও দাঁড়াতে পারেন। তবে অন্ধদের শিক্ষাদানের জন্য প্রয়োজন বিশেষ শিক্ষাব্যবস্থা। যা সম্ভব ব্রেইল পদ্ধতির মাধ্যমে।

ব্রেইল নামটির সঙ্গে সবাই কম-বেশি পরিচিত। বর্তমানে ব্রেইল পদ্ধতি ব্যবহার করে অন্ধদের শিক্ষা দেওয়া হয়। আর এ উপায়ে অনেক দৃষ্টিহীন মানুষ শিক্ষার আলোয় আলোকিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। কেউ কেউ আবার উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও কর্মরত আছেন।

তবে জানেন কি? যিনি এ বিশেষ শিক্ষাপদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন, তিনিও ছিলেন অন্ধ। মাত্র তিন বছর বয়সে তার চোখের আলো নিভে যায়। এরপর তিনি আজীবন শুধু শিক্ষার পেছনেই আত্মনিয়োগ করেন।

jagonews24

আবিষ্কার করেন ছয় বিন্দুর শিক্ষাপদ্ধতি। আসলে ব্রেইল পদ্ধতি হলো, কাগজের উপর ছয়টি বিন্দুকে ফুটিয়ে তুলে লেখার এক বিশেষ কৌশল। দৃষ্টিহীনরা এ বিন্দুগুলোর ওপর আঙুল বুলিয়ে ছয়টি বিন্দুর নকশার কোনটি কোন বর্ণ, তা বোঝার চেষ্টা করে শিক্ষাগ্রহণ করে।

লুই ব্রেইল ১৮০৯ সালের আজকের এ দিনে অর্থাৎ ৪ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। সে অনুযায়ী আজ ‘বিশ্ব ব্রেইল দিবস’। তিনি একজন ফরাসি আবিষ্কারক ও শিক্ষক। ফ্রান্সের কুপভ্রে এলাকায় তিনি এক চামড়া ব্যবসায়ীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। চার ভাই-বোনের মধ্যে লুই ছিলেন সবচেয়ে ছোট।

তার বয়স যখন তিন বছর; তখন দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। আকস্মিকভাবে তার এক চোখে সুঁইয়ের আঘাত লাগে। আর ওই সময় ভালো চিকিৎসাব্যবস্থা ও অ্যান্টিবায়োটিক না থাকায় লুইয়ের আঘাতপ্রাপ্ত চোখ আরও সংক্রমিত হতে থাকে। এরপর তার দুই চোখেই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। লুই ব্রেইল চিরদিনের মতো অন্ধত্ব বরণ করেন।

১০ বছর বয়সে ব্রেইল অন্ধদের উপযোগী রাজকীয় এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন। তিনি বরাবরই একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। বিজ্ঞান ও গানের প্রতি ছিলেন আগ্রহী। পরবর্তীতে চার্চের অর্গ্যান যন্ত্রবাদক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। পাশাপাশি তরুণদের অন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরও শিক্ষক হয়ে ওঠেন।

jagonews24

ব্রেইল ১৫ বছর বয়সে অন্ধদের জন্য বর্ণমালা তৈরি করেন। এটি ছিল তার স্বপ্ন। পাঁচ বছর পর ১৮২৯ সালে ব্রেইল পদ্ধতি প্রকাশ পায়। বিভিন্ন জ্যামিতিক প্রতীক এবং বাদ্যযন্ত্রের চিহ্ন অন্তর্ভুক্ত ছিল এ বর্ণমালায়।

২০ বছর বয়সে লুই অন্ধদের কল্যাণে ব্রেইল শিক্ষা পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এজন্য তিনি অনেক পরিশ্রম করেন। একে তো কিছু দেখতেন না, তার ওপরে চলাফেরা, কাজসহ নানা দায়িত্ব পালনের পরেও ব্রেইল পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন মেধাবী লুই।

তিনি বরাবরই চেয়েছেন, তার মতো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা যেন সমাজের বোঝা হয়ে না থাকেন। তারাও যেন সমাজের অগ্রগতিতে অবদান রাখতে পারেন। এ জন্যই লুই অন্ধ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের কল্যাণে ব্রেইল পদ্ধতি আবিষ্কার করে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটান।

এক থেকে ছয়টি বিন্দু স্পর্শ করেই বর্তমানে বিশ্বের লাখ লাখ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষা গ্রহণ করছেন। পদ্ধতিটি বিশ্বের সর্বত্র পরিচিতি পেয়েছে এবং প্রচলিত সব ভাষায় গ্রহণ করা হয়েছে।

ব্রেইল পদ্ধতি কী: ব্রেইল কোনো ভাষা নয়। এটি একটি লিখন পদ্ধতি। চার্লস বারবিয়ে কর্তৃক উদ্ভাবিত যুদ্ধকালীন সময় রাতে পড়ার জন্য যে উত্তল অক্ষরের প্রচলন ছিল তা পর্যবেক্ষণ করে লুই ব্রেইল কাগজে উত্তল বিন্দু ফুটিয়ে লিখন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।

তার নামেই এই পদ্ধতি পরিচিত। পরবর্তীতে ১৮২৯ সালে তিনি স্বরলিপি পদ্ধতিতেও প্রকাশ করেন ব্রেইল শিক্ষা। ১৮৩৭ সালে প্রকাশিত দ্বিতীয় সংস্করণটি ছিল আধুনিক যুগে বিকশিত প্রথম ক্ষুদ্র বাইনারি লিখন পদ্ধতি।

ছয়টি বিন্দু দিয়ে ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখা হয়। এ উপায়ে ৬৩টি নকশা তৈরি করা যায়। একেকটি নকশা দিয়ে বিভিন্ন বর্ণ, সংখ্যা বা যতিচিহ্ন প্রকাশ করা হয়। ৬টি বিন্দু বাম ও ডান দুটি উল্লম্ব স্তম্ভে সজ্জিত থাকে। অর্থাৎ প্রতি আনুভূমিক সারিতে থাকে দুটি বিন্দু। বিন্দুগুলোর পরস্পরের আকার ও দূরত্ব থাকে অভিন্ন। যেমন- বাম স্তম্ভের ওপরের বিন্দুটি যদি উত্তল থাকে আর বাকি ৫টি সমতল থাকে। তবে নকশাটি দ্বারা ইংরেজি বর্ণমালার ‘এ’ বর্ণটি প্রকাশ পায়। ঐতিহ্যগতভাবে অ্যাম্বুজকৃত কাগজের ওপর ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখা হয়। এর বিকল্প হিসেবে এখন অবশ্য বিশেষায়িত টাইপরাইটার ব্যবহার করে সবাই। এ টাইপরাইটারের নাম ব্রেইলার।

jagonews24

ব্রেইলার এক ধরনের টাইপ মেশিন, যাতে ছয়টি বিন্দুর জন্য ছয়টি বাটন, স্পেস বার, ক্যাপিটাল লেটার ও সংখ্যা বোঝানোর জন্য পৃথক দুটি বাটন থাকে। ব্যাকস্পেস ও পরের লইনে যাওয়ার জন্যও পৃথক বাটন থাকে। ব্রেইল টাইপ রাইটারে শক্ত ধরনের কাগজ ব্যবহার করা হয়। যাতে স্ফূটিত অক্ষরগুলো সহজে ভেঙে না যায়। সাধারণত ১৪০ থেকে ১৬০ জিএসএমের কাগজ ব্যবহৃত হয়।

ব্রেইল ব্যবহারকারীরা রিফ্রেশেবল ব্রেইল ডিসপ্লে ব্যবহার করে থাকে। এর মাধ্যমে কম্পিউটারের মনিটর ও মোবাইলসহ অন্যান্য ইলেকট্রনিক সমর্থনযোগ্য ডিভাইসে পড়তে পারে। তারা স্লেট অ্যান্ড স্টাইলাসের মাধ্যমে লিখতে বা পোর্টেবল ব্রেইল নোট টেকার বা কম্পিউটারের মাধ্যমে ব্রেইল রাইটারে টাইপ করতে পারে।

এ বিশেষ শিক্ষাপদ্ধতি আবিষ্কার করে লুই ব্রেইল ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন। তার এ আবিষ্কারের কারণেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা আজ শিক্ষার আলোয় আলোকিত হচ্ছেন। তবে এটি আবিষ্কারের পর লুইয়ের গ্রহণযোগ্যতা পাননি।

কারণ ইনস্টিটিউটে ব্রেইল পদ্ধতি গৃহীত হয়নি। হাউয়ের উত্তরাধিকারীরা এ আবিষ্কারের বিপক্ষে ছিলেন। এমনকি ইতিহাস বই ব্রেইলের ভাষায় অনুবাদ করার জন্য প্রধান শিক্ষক ড. আলেকজান্ডার ফ্রাঙ্কোরেন পেইনিয়ারকে বরখাস্ত করা হয়।

জন্মের পর থেকে লুই ব্রেইল শারীরিকভাবে সব সময়ই অসুস্থ থাকতেন। ৪০ বছর বয়সে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন। এরপর অবসর গ্রহণ করেন। তার শারীরিক অবস্থার গুরুতর অবনতি হতে থাকলে তার বাসভবন কুপভ্রে-তে নিয়ে আসা হয়। জন্মদিনের ঠিক দু’দিন পরই ১৮৫৩ সালে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন লুই ব্রেইল।

তার মৃত্যুর দুই বছর পর ছাত্রদের চেষ্টায় ইনস্টিটিউট অবশেষে তার বর্ণমালার পদ্ধতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। পরে এটি ফরাসি ভাষাভাষিদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

২০০৯ সালে তার দ্বি-শতবর্ষ জন্মদিন উদযাপন উপলক্ষে বিশ্বের সর্বত্র যথাযোগ্য মর্যাদার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রদর্শনী ও সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা হয়। এতে তার জীবন, কর্ম ও ভূমিকা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়। বেলজিয়াম এবং ইতালিতে দুই ইউরো, ভারতে দুই রুপি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক ডলার মূল্যমানের মুদ্রা প্রকাশ করা হয়।

জেএমএস/এসইউ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।