বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়ি একটি ইতিহাস
অডিও শুনুন
স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি ইতিহাস, তাঁর বাড়িটিও একটি ইতিহাস। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের সেই বাড়িটি স্বাধীন বাংলাদেশের সাক্ষী। এই বাড়িতেই তিনি জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটিয়েছেন, স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামে জাতিকে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। বাড়িটি তৈরিরও একটি ইতিহাস রয়েছে। সেসব স্মৃতিচিহ্ন বহন করে আছে বাড়িটি। বর্তমানে যা বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করার সময় বঙ্গবন্ধু চা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। সে হিসেবে তিনি সপরিবারে সেগুনবাগিচার ১১৫ নম্বরের সরকারি বাড়িতে বসবাস করতেন। ১৯৫৮ সালের ১২ অক্টোবর ওই বাড়ি থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তখন তিন দিনের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ দেওয়া হয়।
নোটিশ পেয়ে বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় মাসিক ২০০ টাকায় বয়েজ স্কুলের মাঠের পাশে পুলিশ কর্মকর্তার মালিকাধীন একটি বাড়ি ভাড়া নেন। পরে সরকারি এজেন্সির হুমকি-ধমকির মুখে এ বাড়িটিও ছাড়তে বাধ্য হন। তারপর কবি সুফিয়া কামালের প্রচেষ্টায় সেগুনবাগিচার ৭৬ নম্বর বাড়িতে মাসিক ৩০০ টাকা ভাড়ায় ওঠেন।
বঙ্গবন্ধু জাদুঘর সূত্রে জানা যায়, ১৯৫৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর একান্ত সচিব নূরুজ্জামান বেগম মুজিবের অনুরোধে ধানমন্ডি এলাকার জমির জন্য গণপূর্ত বিভাগে আবেদনপত্র জমা দেন। ১৯৫৭ সালে ৬ হাজার টাকায় ধানমন্ডিতে ১ বিঘা জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়।
বরাদ্দকৃত জমিতে প্রথমে ২ কক্ষবিশিষ্ট একতলা বাড়ি ও পরে দোতলা করা হয়। ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরিবার-পরিজন নিয়ে নির্মাণাধীন এ বাড়িতে ওঠেন। তখন একতলা বাড়িটিতে মাত্র দু’টি শয়নকক্ষ ছিল। যার একটি কক্ষে বঙ্গবন্ধু দম্পতি থাকতেন।
১৯৬৬ সালে দ্বিতীয় তলার নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত নিচতলার এ কক্ষেই বঙ্গবন্ধু দম্পতি থাকতেন। দ্বিতীয় তলায় বসবাস শুরু হলে কক্ষটি তিনি গ্রন্থাগার হিসেবে ব্যবহার করতেন। উত্তর পাশের কক্ষে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা থাকতেন। এ কক্ষের একপাশে থাকতেন শেখ কামাল ও শেখ জামাল। বাড়িতে ঢুকতেই ছিল ছোট একটি কক্ষ। যেটি ড্রয়িং রুম হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
সূত্র আরও জানায়, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি সিদ্ধান্ত এ বাড়ি থেকেই দেওয়া হতো। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর এ বাড়ি থেকেই বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে দিক-নির্দেশনা দিতেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে হানাদার বাহিনী অপারেশন ‘সার্চ লাইট’ নামে নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্বিচারে হত্যা ও গণহত্যা চালায়। খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু এ বাড়ির নিচ তলায় ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার থেকে টেলিফোনে রাত সাড়ে ১২টায় স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তখন যার যা কিছু আছে, তা নিয়ে হানাদার বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন।
তাঁর স্বাধীনতা ঘোষণার খবর ওয়্যারলেস ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেওয়া হয়। এ বাড়ি থেকেই ২৫ মার্চ রাত দেড়টায় তথা ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি জাতির পিতাকে গ্রেফতার করে।
তাঁকে প্রথমে ঢাকা সেনানিবাস ও পরে পাকিস্তানের পাঞ্জাবের মিওয়ানওয়ালি কারাগারে বন্দি করে রাখে। স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশ বিজয় লাভ করার আগ পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাড়িটি দখল করে রাখে। অপরদিকে ধানমন্ডির ১৮ নম্বর সড়কের ২৬ নম্বর বাড়িতে শেখ মুজিব পরিবারকে বন্দি করে রাখে।
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন ও দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি তাঁর প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ হানাদার বাহিনীর গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা হয়েছিল বাড়িটি। তাই তিনি নিজ বাড়িতে উঠতে পারেননি।
১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। বাড়ির মেরামত কাজ শেষ হলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও পরিবার নিয়ে সরকারি বাসায় না উঠে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে এ বাড়িতে বসবাস করতে থাকেন।
বঙ্গবন্ধুর বাড়িটি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোররাতে তাঁরই রক্তে রঞ্জিত হয়। ঘাতকরা একে একে হত্যা করে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ আবু নাসের, সুলতানা কামাল খুকু, পারভীন জামাল রোজীকে। সেদিন বঙ্গবন্ধু পরিবারের মোট ৮ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
ইতিহাসের এ ঘৃণ্যতম হত্যাকাণ্ডের কথা বাংলাদেশের মানুষ কোনোদিন ভুলবে না। তাই তো স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িটি একটি ইতিহাস। যে ইতিহাস আজীবন মানুষের অন্তরে গেঁথে থাকবে। বঙ্গবন্ধু জাদুঘর সেই ইতিহাস মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেবে।
তথ্যসূত্র:
১. ঢাকা জেলার ওয়েবসাইট
২. উইকিপিডিয়া
৩. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্মৃতি জাদুঘর
এসইউ/পিআর