মাস্ক এখন যে কারণে জরুরি

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:১০ পিএম, ০৭ নভেম্বর ২০২০

শেখ আনোয়ার

মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত বিশ্বব্যাপী বহুল আলোচিত প্রাণঘাতী অসুখ করোনাভাইরাস। সভ্যতার ইতিহাসে খুব কম উদাহরণ রয়েছে, যেখানে একটা রোগ এতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বে প্রতি ১০ জনে একজন এরই মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমিত বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যানে জানা গেছে। বাংলাদেশে শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৭৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। শনাক্তের দিক থেকে পঞ্চদশ আর মৃতের সংখ্যায় বাংলাদেশ রয়েছে ২৯তম অবস্থানে।

যদিও পরিসংখ্যান বলছে, অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সুস্থতার হার বেশি। মৃত্যু হার কম। তবুও বিপুল জনঘনত্বের দেশে মানুষ একবার রাস্তায় বেরোলে গায়ে গায়ে ঠেসাঠেসি অনিবার্য। পেট বড় দায়। সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি রয়ে যায়। পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় ঘোরাফেরাও হচ্ছে প্রচুর। বেড়েছে ছোটখাটো অনুষ্ঠানাদি, আত্মীয়-স্বজনের বাসায় বেড়াতে যাওয়ার প্রবণতা। বাস বা অন্যান্য যানবাহনে গাদাগাদি করে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। হাট-বাজারে মানুষ গাদাগাদি করে কেনাকাটা করছে। রেস্টুরেন্টে বসে আড্ডা দিচ্ছে। দেখা যায়, বেশিরভাগ মানুষ মুখে মাস্ক পরছে না। সরকারিভাবে সতর্ক করা হচ্ছে, ‘করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে ঘরের বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করুন।’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বারবার করে বলে আসছে, ‘মাস্ক পরলে ‘জীবাণু’র ড্রপলেট থেকে সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব।’ বিজ্ঞানীরাও দাবি করছেন, ‘করোনা বাতাসের মাধ্যমেও ছড়ায়।’ তাই মাস্ক ব্যবহার আরও জরুরি। কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হয়, এসব কথার দিকে কারো কান নেই।

বাইরে পা দিলেই মাস্ক জরুরি: বর্তমানে করোনায় আক্রান্ত্র প্রায় ৪০ শতাংশ রোগীই উপসর্গহীন। এদের শরীরে ভাইরাস বাসা বাঁধলেও রোগ লক্ষণ ফুটে ওঠে না। মুশকিল হলো, এরা কিন্তু অন্যের মধ্যে রোগ ছড়িয়ে দিতে পারে। রোগ লক্ষণ থাকে না বলে এদের চিহ্নিত করাও কঠিন। আপনি বুঝতেও পারবেন না, সামনের মানুষটা উপসর্গহীন কি না! এই সমস্যা সমাধানে বাড়ির বাইরে পা দিলেই মাস্ক ব্যবহার করা জরুরি। সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রকাশ, করোনা মোকাবিলায় মাস্কের বিকল্প নেই। মাস্ক ছাড়া বাইরে বেরোলে করোনায় সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়।

jagonews24

পুলিশের ভয়ে থুতনিতে মাস্ক: পুলিশ যদি ধরে! রাস্তায় কেউ যদি কটু কথা বলে! বাংলাদেশে এ ভয়ে মাস্ক সবাই সঙ্গে রাখছেন। হ্যাঁ, ‘সঙ্গে রাখছেন’ বলাই ভালো। কারণ রাস্তায় বেরোলেই এখন দেখতে পাওয়া যায়, মাস্ক প্রায় সবার কাছেই রয়েছে। তবে অনেকেরই তা ঝুলছে থুতনিতে। কখনো কানের পাশে। কখনো আবার নাকের নিচে। কারো মাস্ক পকেটে। কারো মাস্ক দেখা যায় একপাশ থেকে খোলা। কান থেকে ঝোলা। অথচ মাস্ক ব্যবহারের প্রথম শর্ত হলো- নাক এবং মুখ ঢেকে রাখতেই হবে। এটুকু শর্ত পালনই যথেষ্ট। নাক-মুখ ঢাকা না থাকলে মাস্ক পরে আত্মপ্রসাদ লাভ হতে পারে। কিন্তু তাতে উপকার চার আনাও মিলবে না। বাজারে গেলে বোঝা যায় করোনা বলতে কিছু নেই। বহু লোকই মাস্ক ছাড়া দিব্যি কেনাবেচা করছে। বরং যারা মাস্ক পরছে, তারা কিছুটা টিপ্পনীর সম্মুখীন হচ্ছে। জনস্বাস্থ্যের বিবেচনায় এ প্রবণতা অত্যন্ত বিপজ্জনক। আর তাই, বাড়ির বাইরে যতক্ষণ থাকছেন, ততক্ষণ মাস্ক থাকবে নাক ও মুখের উপর। পকেটে বা থুতনিতে নয়।

মাস্ক কেন: মাস্কই হলো করোনা থেকে বাঁচার অন্যতম পথ। কথা বলার সময়, হাঁচি, কাশির সময় মুখ-নাক থেকে বেশকিছু তরলবিন্দু বেরিয়ে আসে। এই তরলবিন্দুকে বলে ড্রপলেট। মুশকিল হলো, একজন করোনা আক্রান্তের ড্রপলেটে থাকে ভাইরাস। আক্রান্ত মানুষটা কথা বললে, হাঁচলে বা কাশলে ড্রপলেট বের হয়। যেগুলো বাতাসে ৩-৪ ঘণ্টা ভেসে থাকতে সক্ষম। সেই ড্রপলেট কোনো সুস্থ ব্যক্তির নাক, মুখ, চোখ হয়ে শরীরে প্রবেশ করলেই বিপদ! তখন সুস্থ মানুষটার দেহের অন্দরে প্রবেশ করে করোনাভাইরাস। মানুষটা করোনায় আক্রান্ত হন। অথচ মাস্ক পরলে মাইক্রো-ড্রপলেট থেকে রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায়। ভাইরাস ঠেকাতে মাস্ক তাই অন্যতম এক পরিধানের অনুষঙ্গ। সংক্রমিত ব্যক্তি ঠিকঠাকভাবে মাস্ক পরলে, তার নাক, মুখ থেকে ড্রপলেট বেরোলেও মাস্ক আটকে দেয়। আক্রান্তের কাছাকাছি চলে আসা সুস্থ মানুষের পক্ষে তখন রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে এ মাস্ক। অপরদিকে একজন সুস্থ মানুষ মাস্ক পরলে একইভাবে করোনা আক্রান্তের মুখ-নাক নিসৃত ড্রপলেট হুট করে তার শরীরে ঢুকতে পারে না। সংক্রমণের আশঙ্কাও কয়েকগুণ কমে। এখন এটাও জানা, উপসর্গ দেখা দেওয়ার আগে থেকেই সংক্রমিত ব্যক্তি ভাইরাস ছড়াতে পারেন। তাই মাস্ক পরা থাকলে আপনি কাউকে সহজে সংক্রমিত করতে পারবেন না। তিনিও আপনার শরীরে সংক্রমণ ছড়াতে ব্যর্থ হবেন।

jagonews24

মাস্ক কি ভাইরাস রুখতে পারে: গবেষকরা জোর গলায় বলেন, ‘জ্বি হ্যাঁ, পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পারে। তবে সঙ্গে চাই বাকি প্রোটোকল মেনে চলা।’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ‘তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ যা বিশ্ববাসীকে মেনে চলতে হবে। তার মধ্যে অন্যতম হলো মাস্ক পরা। অন্য দু’টো হলো, সামাজিক, শারীরিক দূরত্ব এবং নিয়মিত হাত ধোয়া নয়তো যথার্থ স্যানিটাইজারের ব্যবহার।’ ল্যানসেটের সাম্প্রতিক সমীক্ষায় প্রকাশ, ‘মাস্ক পরা, চোখকে সুরক্ষা দেওয়া ও ঠিকঠাকভাবে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারলে করোনা সংক্রমণ হওয়ার হার হ্রাস পেতে পারে।’ চীনে এখনো ৮০ শতাংশ মানুষ মাস্ক পরে তবেই ঘরের বাইরে বেরোচ্ছে। চীনের সর্বত্র, এমনকি আনাচে-কানাচেও মানুষের শৃঙ্খলাবোধ, আত্মসংযত মনোভাব, অনুশাসন দৃষ্টান্তমূলক। পুলিশের ডান্ডা, প্যাদানি, খোঁচানি দিয়ে এমনটা শেখানো যায় না। ওদিকে ফেস মাস্ক পরার নিরিখে এগিয়ে থাকা প্রথম পাঁচ দেশের মধ্যে একমাত্র স্পেনে শুরু হয়েছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বা সেকেন্ড ওয়েভ। মোট জনসংখ্যার ৯২ শতাংশ সিঙ্গাপুরবাসী নিয়মিত মাস্ক ব্যবহার করছেন। স্পেনে ৯০, থাইল্যান্ড ৮৮, হংকং ৮৬, জাপান ৮৬ শতাংশ মাস্ক ব্যবহার করে।

মাস্ক মানে ওষুধ: করোনায় নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাইরাস কোনো ব্যক্তির শরীরে প্রবেশ করলে ওই ব্যক্তি সংক্রমিত হন। তার আগে নয়। এই মুহূর্তে সবারই বোঝা দরকার, মাস্ক হলো এমন একটা ওষুধ, এমন একটা ভ্যাকসিন যা সঠিকভাবে ব্যবহার করলে রুখে দেওয়া যায় করোনা। নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরে থাকলে ভাইরাস থেকে যেমন নিজে সুরক্ষিত থাকা যায়, তেমনই অন্যকেও সংক্রমিত করার অপরাধ থেকে বাঁচা যায়। মাস্ক পরা অবস্থায় সুস্থ ব্যক্তি করোনা সংক্রমিতের কাছে গেলেও সুস্থ ব্যক্তির শরীরে যে পরিমাণ ভাইরাস ঢুকতে পারে, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওই ব্যক্তিকে কাবু করার ক্ষমতা রাখে না। বরং মাস্কের মধ্য দিয়ে সামান্যতম ভাইরাস ঢোকার ফলে দেহে যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়, তা পরবর্তী সময়ে প্রায় ভ্যাকসিনের মতো কাজ করে বলে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অভিমত। তাই মাস্ক ছাড়া চলাফেরা আত্মহত্যার শামিল। কোনো কারণে দূরত্ব হয়তো সব সময় মানা সম্ভব হয় না। বাঁচার একমাত্র উপায় চোখ, নাক, মুখ ঢেকে রাখা। এতে মুখোমুখি হলে মাস্কই বাঁচাবে। মাস্ক পরার অর্থ নিজেকে বাঁচানো এবং রোগ না ছড়ানো।

jagonews24

মাস্ক পরায় হেলাফেলা নয়: করোনাকালে মাস্ক দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই মাস্ককে হেলাফেলা করা চলবে না। না হলে তার ফল হবে মারাত্মক। আসছে শীতে পাল্লা দিয়ে বাড়তে পারে গুরুতর অসুস্থ রোগীর সংখ্যা। স্বাস্থ্যব্যবস্থার উপর নেমে আসতে পারে অসম্ভব চাপ। স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনা শুরুর দিন থেকেই টানা লড়াই করতে করতে ক্লান্ত। রোগীর সংখ্যা হঠাৎ ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠলে আহত যোদ্ধা দিয়ে যুদ্ধ জেতা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই এ সঙ্কট থেকে বাঁচতে গেলে দেশের প্রত্যেক নাগরিককে সচেতনভাবে বাইরে বেরিয়ে মাস্ক পরতেই হবে। নিজের পাড়ায় রয়েছি বলে করোনা হবে না, এমনটা কিন্তু নয়। তাই পাড়ায় আড্ডায় বসলেও মাস্ক পরতেই হবে। পাশাপাশি আড্ডার আবহেও অবশ্যই মানতে হবে শারীরিক দূরত্ব। নিজে মাস্ক পরলে সুরক্ষা মেলে। তবে সামনের ব্যক্তিটা মাস্ক পরে থাকলে সুরক্ষাবলয় আরও দৃঢ় হয়। তাই মাস্ক নিজে পরুন। অন্যকে পরতে উৎসাহিত করুন।

নো মাস্ক, নো সার্ভিস: করোনাভাইরাসের প্রথম দফা করোনার দাপাদাপির ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই বিশ্বব্যাপী প্রবলভাবে ফিরে এসেছে দ্বিতীয় দফা সংক্রমণ। বাংলাদেশ এ মুহূর্তে করোনার প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠে ধীরে ধীরে ছন্দে ফেরার চেষ্টা করছে। দ্বিতীয় দফা সংক্রমণের আশঙ্কায় বিশেষজ্ঞরা সাবধান করছেন। আবহাওয়া একটু ঠান্ডা হলেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আরও বেশি হবে। যদি তাই হয়, তাহলে শীতকালে আমাদের দেশে ভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাবে। শীতে দ্বিতীয় ঢেউ এলে সেক্ষেত্রে প্রায়শ্চিত্তটা নিদারুণ হবে। ইতোমধ্যে ভ্যাকসিন হিরো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার করোনাভাইরাসের ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ সম্পর্কে জনসাধারণকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ প্রদানের পাশাপাশি করণীয় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সবার মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ অর্থাৎ সরকারি-বেসরকারি কোনো অফিসেই মাস্ক ছাড়া কেউ ঢুকতে পারবে না, কোনো সেবাও পাবে না।

jagonews24

যতদিন না ভ্যাকসিন আসছে; ততদিন মাস্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভ্যাকসিন না আসা পর্যন্ত প্রতিরোধে এখন থেকে প্রয়োজন মিলিটারির মতো অনুশাসন। সাবধানতা হিসেবে গ্লাভস ও মাস্ক পরা, ঘন ঘন হাত ধোয়া। কমপক্ষে ছয় ফুটের সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা। মাস্ক ছাড়া লোকজন কিংবা যারা জোরে কথা বলে তাদের সামনে না যাওয়া। যানবাহন ও বাজারে সর্বত্র ভিড় পরিহার করা। টাকা বা কাগজ গোনার সময় আঙুল দিয়ে জিহ্বা বা ঠোঁট স্পর্শ না করা। চুলসহ শরীর যথাসম্ভব আবৃত রাখা। বাইরে থেকে বাড়িতে ফিরে সব পরিধেয় ধুতে দেওয়া। হাত-মুখ না ধুয়ে ঘরের কোনো কিছু না ধরা ইত্যাদি প্রাত্যহিক কাজ এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। এখনো করোনার কার্যকর ওষুধের অভাব রয়েছে। এ অবস্থায় শুধু ব্যক্তিগত সচেতনতাই পারে করোনা প্রতিরোধ করতে।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এসইউ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।