শীতে বাড়তে পারে করোনার তাণ্ডব
নাজমুল হুদা
ঘুরছে ঘড়ির কাঁটা, বদলাচ্ছে পঞ্জিকার পাতা। শীতের আগমনী গান বাজাচ্ছে হেমন্ত। ক’দিন পরই আসবে শীত। পৌষ-মাঘ পুরোদমে শীত থাকে। প্রতিবছর এ শীতকালকে নিয়ে থাকে মিষ্টি-মধুর অভিজ্ঞতা। কুয়াশার ভোরে হাড়িভরা খেজুরের রস খেয়ে অমৃতের স্বাদ নেওয়া যায়। শীতের পিঠা-পায়েস খাওয়া, মাঠে গিয়ে উষ্ণ-মিঠা রোদ পোহানো কিংবা খড়-পাতার আগুনে শীত তাড়ানো। তবে এবারে কুয়াশার চাদরে ঘেরা শীত একটু ব্যতিক্রমী হয়ে আসবে। বর্তমান বিশ্বে রাজত্ব করা করোনা মহামারীর তাণ্ডবকে আরও শক্তিশালী করবে এবারের শীত।
করোনা আসার পর অনেক পরিবর্তন দেখেছি। হারাতেও দেখেছি। তারমধ্যে দেখেছি মানুষের মৃত্যুর মিছিল। যেভাবে ফাল্গুনে ঝরে পড়ে গাছের শুকনো পাতা। সেভাবেই ঝরছে প্রাণগুলো। ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী, ৩ নভেম্বর সকাল পর্যন্ত বিশ্বে প্রাণঘাতী এ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৬৮ লাখ ৭৮ হাজার ১৮৯ জনে। এ ছাড়া কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১২ লাখ ১১ হাজার ৩০০ জন। করোনাভাইরাসে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত এবং ল্যাটিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিল। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বে প্রথমে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
বিশ্বের অনেক দেশেই করোনার প্রথম ঢেউ শেষ হয়েছে। শীতের কারণে শুরু হচ্ছে দ্বিতীয় ঢেউ। বিশ্লেষকরা জানাচ্ছেন, ঠান্ডা পড়লে করোনার সংক্রমণ বাড়বে। ফের তা মাথাচাড়া দেবে। কারণ ঠান্ডা করোনার জন্য অনুকূল পরিবেশ নিয়ে আসে। এদিকে ইউরোপ ও আমেরিকায় এবার ধীরে ধীরে ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। এতে দেশগুলোয় ফের নতুন করে মাথাচাড়া দিচ্ছে করোনা সংক্রমণ।
ইতোমধ্যে আমেরিকায় একদিনে রেকর্ড সংখ্যক সংক্রমণ ধরা পড়েছে। এতদিনেও আমেরিকায় একদিনে ৯০ হাজার সংক্রমণ দেখতে পাওয়া যায়নি। ওটা কেবল বিশ্বের মধ্যে ভারতেই হয়েছিল। কিন্তু এবার আমেরিকায়ও ৯০ হাজারের ওপর সংক্রমণ ধরা পড়ল একদিনে। ফলে মার্কিন মুলুকে ভোটের মুখে নতুন করে করোনা ফের তাণ্ডব শুরু করে দিলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমন পরিস্থিতির সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে ইউরোপও। ফ্রান্সে গত একদিনে প্রায় ৫০ হাজার সংক্রমণ ধরা পড়েছে। যা ফ্রান্সের এখন পর্যন্ত রেকর্ড সংক্রমণ। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ রোধে তাই গত শুক্রবার থেকে ফের দেশজুড়ে লকডাউন ফিরিয়েছে ইউরোপ।
বাংলাদেশে নভেম্বরের শেষদিকেই শীত পড়তে শুরু করে। এরপর ডিসেম্বর-জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারির শুরুতে শিথিল হতে থাকে। এ সময় আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের জ্বর, সর্দি-কাশি, ঠান্ডা বেড়ে যায়। ফলে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিও বেশি থাকে। করোনার প্রথম ঢেউয়ে বিশ্বের অন্য দেশগুলোর চেয়ে তুলনামূলক স্বস্তিতে ছিল বাংলাদেশ। ৩ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৯৮৩ জনে। আর মোট শনাক্ত হয়েছে ৪ লাখ ১২ হাজার ৬৪৭ জন।
তবে করোনার প্রথম ঢেউ মোকাবিলায় আমাদের কিছুটা স্বস্তি দিলেও শীতের মৌসুমে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের তাণ্ডব কতটা স্বস্তি দেবে, সেটা দেখার বিষয়। প্রসঙ্গত, আমি রাজধানীর বাসাবোর রাজারবাগ এলাকায় থাকি। আমার বাসা থেকে প্রধান সড়কে যেতে প্রায় দু’মিনিট হাঁটতে হয়। আর এ সময়ে আমি প্রায় দিন আমার আশেপাশের মানুষের দিকে নজর রাখি। তারা করোনা নিয়ে কতটুকু সচেতন, সেটা খেয়াল করি। কিন্তু তাদের সচেতনতা দেখে সব সময় হতাশ হয়েছি। প্রতি দশ জনের দু’জনকেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে দেখি না।
আমার বাসার গলির সামনে কয়েকটা চায়ের টং দোকান আছে। এখানেও সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলে আড্ডা। কারও মুখেই কোনো মাস্ক নেই। আর শারীরিক দূরত্বের কথা বাদই দিলাম! এখানে আমার চারপাশের বাস্তব চিত্র তুলে ধরলাম। আপনার চারপাশের চিত্রও দেখুন। মিলিয়ে নিন। চিন্তা করুন। এ উদাসীনতা কোথায় নিতে পারে দ্বিতীয় ঢেউয়ের করোনা তাণ্ডব? তবে এবারের শীত কি কাল হয়েই দাঁড়াবে আমাদের জন্য? না কি আমরা মোকাবিলা করতে পারব? কিভাবে পারব? এমন প্রশ্নে জর্জরিত আমি।
তবে চলুন জেনে নেই বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত সংক্রমণ মোকাবিলায়। শীত মৌসুমে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কায় সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য দফতরগুলো মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানতে বিশেষ জোর দিয়ে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। সবার মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ৩ নভেম্বর সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছে। সবার মুখে মাস্ক পরাটা বাধ্যতামূলক করতে শিগগিরই পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ও তাদের অধীনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে নির্দেশনা দেবেন।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ নির্দেশনায় জানিয়েছে, আসন্ন শীত মৌসুমে দেশে করোনা সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। করোনা সংক্রমণের সম্ভাব্য এ সেকেন্ড ওয়েভ মোকাবিলায় মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দফতর, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান এবং মাঠ পর্যায়ের সবার মাস্ক পরিধান নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সরকারের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি উদ্যোগই পারে শীতে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা করতে। দেশের মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করতে। আক্রান্তের সংখ্যা কমাতে। তাই আসুন, আমরা সচেতন হই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি। নিজে বাঁচি, পরিবারকে বাঁচাই।
লেখক: শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী।
এসইউ/পিআর