রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে প্রতিদিন ডিম!

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০:৩৬ এএম, ০৫ অক্টোবর ২০২০

শেখ আনোয়ার

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস নিয়ে বিশ্বজুড়ে চলছে আতঙ্ক। ছোঁয়াচে করোনার ছোবলে পড়লেই জীবন শেষ। কোনো ওষুধ নেই। ভাইরাস ঘটিত রোগ বসন্ত, হাম দেখা দিলে প্রচলিত ধারণায় অনেকেই ডিম খাওয়া বন্ধ করে দেন। করোনাভাইরাসের আতঙ্কের কারণে এবার অনেকেই ডিম খাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। অথচ এ সময়ে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে, শরীরে হার্ড ইমিউনিটি তৈরির কাজে বাড়তি পুষ্টির জন্য ডিম অবশ্যই খাওয়া উচিত।

এমনিতেই একটি বয়সের পর ডিম খাওয়া ভালো না খারাপ? এ নিয়ে প্রচলিত রয়েছে বিতর্ক বা চিরন্তন ডিবেট। হাই স্ট্রেসড সোশ্যাল লাইফে যারা চল্লিশের কোঠায় পা রেখেছেন, তাদের অনেকেই এখন রোজ ডিম খেতে গেলে দু’বার ভাবেন। বয়স্কদের ক্ষেত্রে তো কথাই নেই। ডিমের দিকে তাকানোও যেন অপরাধ! ফল যা হওয়ার তাই। বয়স বাড়তেই খাদ্যতালিকা থেকে ডিমকে ডিভোর্স। হার্টের সমস্যা, উচ্চমাত্রায় কোলেস্টেরল, আর্থারাইটিস- এসব ক্ষেত্রে পুষ্টিবিজ্ঞানীরা ডিম এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেন। বয়সের সঙ্গে যেহেতু এসব সমস্যা এসেই যায়, তাই অটোমেটিক্যালি ডিমেও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়ে যায়।

কেন নয় ডিম: সাম্প্রতিক গবেষণা কিন্তু বলছে অন্য কথা। বয়স্কদের জন্য ডিমকে আর নিছক ভিলেন হিসেবে দেখতে রাজি নন পুষ্টিবিজ্ঞানীরা।

একষট্টি বছর বয়স। এমন ১২শ জনকে নিয়ে সমীক্ষা করেছিলেন কানাডার কয়েকজন গবেষক। তাতে দেখা গেছে, যারা সপ্তাহে দু’টো করে ডিম খান, তাদের শরীরে ক্যারোটিড প্লেক তৈরি হওয়ার প্রবণতা বেশি। ক্যারোটিড প্লেক মোমের মতো একধরনের পদার্থ। যা ধমনীতে বসে গিয়ে রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে।

কানাডার আরেক গবেষক, ব্রিটিশ ডায়েটিক অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হেলেন বন্ড বলছেন অন্য কথা। তিরিশ বছর গবেষণার পর তিনি দাবি করেছেন, কোলেস্টেরলের মাত্রার ওপর ডিমের কোনো প্রভাব সে অর্থে নেই। বয়স হলেও ডিম খাওয়া চালিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু কোন যুক্তিতে এত বড় অভয় দিচ্ছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা?

আমেরিকান জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশন এবং ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টার গবেষকরা বলেছেন, ‘একটি বড় ডিমে ৭০-১০০ ক্যালোরি থাকে। ডিমের হাই কোয়ালিটি প্রোটিন ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ করে। বয়সজনিত কারণে অনেক সময় মাংসপেশী শিথিল হয়ে যায়, ডিমের কুসুমে যে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট থাকে তা মাংসপেশীকে সুস্থ রাখে। হার্টের অসুখ, স্ট্রোক, ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে এবং ছানি প্রতিরোধ করে।

এ ছাড়াও সেল ড্যামেজ প্রতিরোধ করে। ডিমের এত গুণ বিচার করে গবেষকরা বলেছেন, বয়স হলেই এমন খাদ্যকে ছেড়ে দেবেন না। ডিম খেতে হবে তবে পরিমাণ মেনে।

ভোজন রসিক তো বটেই, এবার ডিমপ্রিয়দের জন্যও সুখবর দিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ডক্টর ফ্রাংক। তার গবেষণালব্ধ চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে, ‘ডিমের খাদ্য উপাদান মাত্রারিক্ত কোলেস্টেরল থাকা সত্ত্বেও একজন স্বাভাবিক স্বাস্থ্যবান লোক প্রতিদিন একটি করে ডিম খেলে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি নেই। তবে ডায়াবেটিস রোগীরা বেশি ডিম খেলে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকিতে পড়তে পারেন।’

তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘এর মানে এই নয় যে, পশ্চিমা ধাঁচের প্রাতঃরাশে উৎসাহিত করা হচ্ছে।’ সকালের নাস্তা হিসেবে দু’টো ডিম, লবণে ভেজানো মাংস মাখন ও টোস্ট খাওয়া পশ্চিমাদের বহুল প্রচলিত অভ্যাস। তিনি এ ধরনের খাবারের অভ্যস্থতাকে অস্বাস্থ্যকর বলে বর্ণনা করেছেন।

হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথের রোগতত্ত্ববিদ হোনালের মতে, ‘ডিমের মধ্যে অতিরিক্ত পরিমাণ কোলেস্টেরল থাকার কারণে ডিম খেতে মানুষ ভয় পেলেও আমি মনে করি না ডিমের ক্ষেত্রে এমন দুর্নাম থাকাটা সমিচীন।’

ডিমে কী আছে: সম্প্রতি আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের জার্নালে ডিম নিয়ে গবেষণালব্ধ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, একটি বড় ডিমের মধ্যে প্রায় ২১৫ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল থাকে। যা একই পরিমাণ ক্যালোরি মাপের অন্য খাদ্য অপেক্ষা খুব বেশি বিপজ্জনক নয়। ডিমের সাদা অংশে রয়েছে উঁচু মানের প্রোটিন যা সহজপাচ্য। আমাদের শরীর গঠনের জন্য প্রোটিনের অন্যতম উপাদান যে নয়টি এসেন্সিয়াল, অ্যামাইনো এসিড দরকার তার সবকটিই থাকে ডিমের সাদা অংশে। সেজন্য ডিম খেলে সম্পূর্ণ প্রোটিনের চাহিদা পূরণ হয়ে যায়।

ডিমের প্রোটিন সহজেই হজম হয় বলে রোগীদের খাদ্যতালিকায় ডিম আবশ্যিক রাখা হয়। ডিমের কুসুমে রয়েছে অনেকগুলো ভিটামিন। যেমন- এ, ডি, ই, কে, বি এবং রয়েছে মিনারেলস। ডিমে থাকে না শুধু ভিটামিন সি। ১০০ গ্রাম খাদ্যোপযোগী মুরগির ডিমের পুষ্টি উপাদানে রয়েছে- প্রোটিন ১৩.৩০ গ্রাম, ফ্যাট ১৩.৩ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৬০ মি.গ্রাম, আয়রন ২.১ মি.গ্রাম, ক্যারোটিন ৬০০ মি.গ্রাম, ভিটামিন বি ১, ০.১০ মি.গ্রাম। ভিটামিন বি২, ০.৪০ মি.গ্রাম, অন্যান্য খনিজ ১ গ্রাম, জলীয় অংশ ৭.৩ গ্রাম, খাদ্যশক্তি ১৭৩ কিলোক্যালোরি।

হাঁস না কি মুরগির ডিম: হাঁসের ডিমের পুষ্টিমান মুরগির ডিমের প্রায় সমান। তবে হাঁসের ডিমে অতিরিক্ত থাকে অল্প পরিমাণ শর্করা যা মুরগির ডিমে থাকে না। বিভিন্নভাবেই ডিম রান্না করে খাওয়া যায়। তবে অতিরিক্ত সিদ্ধ করে খাওয়া ঠিক নয়। এতে ডিমের কুসুম কালচে আকার ধারণ করে, যা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। আবার কাঁচা ডিমও খাওয়া উচিত নয়। এতে হজমের অসুবিধা হতে পারে। বাচ্চারা দৈনিক ১টি করে ডিম খেলে ভালো। প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি সপ্তাহে ৩টি ডিম সহজেই খেতে পারেন। তবে চল্লিশোর্ধ্ব বয়সে বাড়তি কোলেস্টেরলের ভয়ে ডিমের কুসুম খাওয়া কমিয়ে দেওয়া উচিত। তবে সাদা অংশ নির্দ্বিধায় খাওয়া যাবে। এটি শুধুই প্রোটিন, যা দেহের জন্য অত্যন্ত দরকারি।

ডিম চিনবেন কীভাবে: তীব্র আলোর সামনে ধরে খুব সহজেই ডিমের ভেতর কুসুম পর্যবেক্ষণ করে নষ্ট ডিম বাছাই করা যায়। নষ্ট ডিমের খোসা পুরাতন এবং বায়ু কোষও বড় দেখায়। ডিমের ভেতর রক্তের চিহ্ন, ছত্রাক, এমনকি ভ্রুণের আভাসও লক্ষ্য করা যায়। নষ্ট ডিম নাড়লে কুসুম এদিক-সেদিক নড়তে দেখা যায়। টাটকা ডিম ভেঙে প্লেটে রাখলে কুসুম ও সাদা অংশ একসঙ্গে থাকে। ডিম পুরোনো হলে সাদা অংশ স্থিরভাবে থাকে না। এদিক-সেদিক সরে যায়।

কোন ডিমে পুষ্টি বেশি: ডিমে লৌহ ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, খনিজ পদার্থ, ভিটামিন-এ, থায়ামিন, রাইবোফ্রাডিন এবং সামান্য পরিমাণে ভিটামিন-ডি পাওয়া গেলেও তা নির্ভর করে হাঁস-মুরগির রোদে থাকার ওপর। কথাটা খুব আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, যেসব হাঁস-মুরগি রোদে বেশি থাকে; যেসব হাঁস-মুরগির ডিমে ভিটামিন-এ ও ডি বেশি থাকে। বাংলাদেশের গৃহস্থালীর হাঁস-মুরগিতে প্রচুর ভিটামিন এ ও ডি থাকে। ফলে এসব হাঁস-মুরগির কুসুমের রং ও বেশ গাঢ় হয়।

পোলট্রি ফার্মের মুরগিগুলো আলো-বাতাস এবং ঘাস-পাতা কম পায় বলে এসব মুরগির ডিমের রং খুব হাল্কা হয়। ফার্মের মুরগির খাদ্যে ভিটামিন এ ও ডি যোগ করা সত্ত্বেও কুসুমের রং হালকা থাকে। তবে ওইসব ডিম থেকে ভিটামিন এ ও ডি ঠিকই পাওয়া যায়। অনেক সময় ক্যারোটিনের অভাবেও কুসুমের রং হালকা হয়। ডিমে উচ্চ জৈবমূল্যের প্রোটিন বিদ্যমান। ডিমে অত্যাবশ্যকীয় সব অ্যামাইনো এসিড পাওয়া যায়। যার ১০০ ভাগই দেহে শোষিত হয়।

মুরগির আহারের ওপর ডিমের স্বাদ ও পুষ্টিমূল্য নির্ভর করে। রান্নার ফলে সব আকারেরই খাদ্য উপাদান একটু হলেও নষ্ট হয়ে যায়। তবে ডিমের খাদ্য উপাদান বিশেষ নষ্ট হয় না। রান্নার ফলে ডিমে বিদ্যমান থায়ামিন এবং রাইবোফ্রাডিনের সামান্য অংশ নষ্ট হয়। রান্নার সময় খেয়াল রাখতে হবে ডিমের সাদা অংশ এবং কুসুম যেন জমাট বাঁধে কিন্তু শক্ত হয়ে না যায়।

অনেকেই শখ করে, বাজি ধরে, কাঁচা ডিমে ভিটামিন বেশি মনে করে কাঁচা ডিম খেয়ে ফেলে। এটা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। কারণ এতে স্যালমোনেলা নামক ব্যাক্টেরিয়া থাকে। যা ডিমকে দূষিত করে। এরূপ দূষিত ডিম খেলে ডায়রিয়া, পেটের অসুখ দেখা দিতে পারে। তাই সাবধান।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এসইউ/এএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।