গ্রামীণ সাংবাদিকতায় আলো ছড়িয়েছেন রফিক মিয়াজী
চাঁদপুর কোর্ট স্টেশন। প্রতিদিন হাজার মানুষ এখানে পা ফেলেন। সকাল-সন্ধ্যা সাংবাদিকরা যোগ দেন দাঁড়ানো আড্ডায়। এখান থেকে কেউ কাজে ফেরেন; কেউ ঘরে। কারো কারো ঘুমানোর আশ্রয়টুকু এ প্লাটফর্ম। মাস দেড়েক আগে চাঁদপুর কোর্ট স্টেশনে সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম মিয়াজী ভাইয়ের সাথে দেখা। সময়টা খাড়া দুপুর। এই বৃষ্টি এই রোদ। কারো জন্য অপেক্ষা করছি বোধ হয়। তাই প্লাটফর্মে পায়চারী করছি। ভাইয়ের মুখে সাদা দাড়ি দেখে চিনে ওঠা কঠিন হলো। একই জেলা শহরে কাজ করি, তবুও দীর্ঘ কয়েকমাস দেখা হয়নি। ভাইকে চিনে উঠতেই কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু মুখের মাস্ক সরিয়ে যখন হাসিমুখে আমার দিকে এগিয়ে আসছিলেন; তখন আমার চোখও ধীরে ধীরে রফিক ভাইয়ের মুখশ্রী আয়ত্ব করে নিচ্ছিল।
কাছে আসতেই রফিক ভাই জানতে চাইলেন, ‘কেমন আছো ভাই?’ জবাবে বলি, ‘অনেক ভালো আছি। আপনার দিন কেমন কাটছে?’ মুখজুড়ে চওড়া হাসি দিয়ে বললেন, ‘ভাইরে চলছে কোনরকম। তোমার শপথ পত্রিকা ভালো হচ্ছে। চালিয়ে যাও। সমাজকে তুমি আরও ভালো কিছু দিতে পারবে।’ বললাম, ‘দোয়া করবেন বড় ভাই।’ পরে চা অফার করলাম। চা না খেয়ে একটা কলা আর পপস নামে এক প্যাকেট বিস্কুট খেলেন। তারপর ‘ভালো থাইকো ভাই’ বলে দ্রুত চলে গেলেন। বুঝতে পেরেছি কোথাও কোনো একটা প্রোগ্রাম আছে। সেখানে নিউজের কাজে দ্রুত যেতে হবে। আমাকে পাশ কাটিয়ে আরেক সহকর্মীর সাথে চলতে শুরু করলেন। এখনো চোখে ভাসছে হাঁটা-চলায় চটপটে মানুষ। হাতে নিজের পত্রিকার একটি ব্যাগ। সে ব্যাগটিকে দোল খাওয়াতে খাওয়াতে হাঁটেন রফিক ভাই। এরপর আর রফিক ভাইয়ের সাথে দেখা হয়নি।
১৫ সেপ্টেম্বর সকালে ফেসবুকে রফিক ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পড়ে স্তব্ধ হলাম। কিছুক্ষণ শব্দহীন আমি। কিন্তু তখনো বুকের ভেতর অসীম শব্দ আঘাত করে যাচ্ছে। মনে পড়ছে, দশ বছর আগে প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিল সেই রফিক ভাইয়ের সাথে। চাঁদপুর ক্লাবের একটি বড়সড় প্রোগ্রামের নিউজ করতে আমি উপস্থিত। রফিক ভাই আসলেন। তখন তিনি দৈনিক চাঁদপুর জমিন পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক (সম্ভবত) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। রফিক ভাইকে নিয়ে অনেক সাংবাদিক বেশ আলোচনা করছেন। কেউ কেউ সমালোচনা। আমি তখনো রফিক ভাইকে ঠিকভাবে চিনি না। তিনি ব্যাগভর্তি দৈনিক চাঁদপুর জমিন পত্রিকা নিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে হাজির। একেকজন চিৎকার দিয়ে উঠলো, ‘রফিক ভাই আসছে।’ কেউ বলছে, ‘রফিক ভাই পালান। আজ আপনার খবর আছে।’ তিনি ভীত হলেন। কিন্তু বুঝতে দিলেন না।
আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, আগের দিন একটি প্রোগ্রামে খাবার নিয়ে গণ্ডগোল হয়েছিল। এমনকি তিনি নিজেও সাংবাদিক হিসেবে খাবার পাননি। তাই পত্রিকায় ‘খাবার বিড়ম্বনা’ শিরোনামে একটি নিউজ করেছিলেন। নিউজের কারণে ওই প্রোগ্রামের বদনাম হয়েছে। এমন কথা শুনে আমি বিস্মিত হলাম। কিন্তু সেদিন আমি রফিক ভাইয়ের সাথে কথা বলতে পারিনি। হঠাৎ করেই তিনি প্রোগ্রাম থেকে উধাও হয়ে গেলেন। তখনই বুঝতে পেরেছি, তিনি ভয় পেয়েছেন। কিন্তু কাউকে বুঝতে দেননি।
এরপর অবশ্য কয়েক দফায় কথা হয়েছে। ছায়াবানী মোড়ে একটি দোকানে চা খেতে খেতে চাঁদপুরের সাংবাদিকতা আর সাংবাদিক নিয়ে বেশ আলোচনা করলেন। জাতীয় পর্যায়ের বড় মাপের একজন সাংবাদিকের উঠে আসার গল্প শোনালেন। জাতীয় পর্যায়ে নিজেকে উঠিয়ে নেওয়ার গল্প বললেন। আমাকে এবং আমার নিউজের প্রশংসা করে বলেছিলেন, ‘ঢাকা চলে যাও। ভালো কিছু করতে পারবে। তোমার নিউজ সেন্স ভালো। এখানে পড়ে থেকে জীবনটা ধ্বংস করো না।’ আমি ভাইয়ের কথায় আপত্তি দেইনি। কিন্তু ঢাকা আমার জন্য যন্ত্রণার শহর। ঢাকায় সাংবাদিকতার সুযোগ পেয়েও যাইনি। কারণ ঢাকা ঢুকলেই আমি অসুস্থ বোধ করি। যা হোক ঢাকায় নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারার আরও অনেক অনুষঙ্গ আছে। সেদিকে যাচ্ছি না।
রফিক ভাইয়ের সাংবাদিকতায় অবদান হয়তো উল্লেখ করার মতো নয়। কিন্তু গ্রামীণ সাংবাদিক হিসেবে নিজের আলো ছড়িয়ে গেছেন। কাজ করেছেন স্থানীয় দৈনিক চাঁদপুর সংবাদ, দৈনিক চাঁদপুর জমিন, দৈনিক চাঁদপুর প্রতিদিন। অবশ্য দৈনিক চাঁদপুর সংবাদ দিয়েই সংবাদিকতা শুরু করেছেন এবং এ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক হিসেবে চির বিদায় নিলেন। অর্জন বলতে গেলে কিছুই নেই। কারণ শেষ সময় পর্যন্ত রফিক ভাইয়ের আর্থিক টানাপোড়েনের কথা শুনেছি। মাঝে নিজ এলাকায় একটি কিন্ডারগার্টেন দিয়েছিলেন। কয়েক বছর গচ্ছা দিতে দিতে ব্যবসা থেকে গুটিয়ে নেন নিজেকে। এরপর কিছুদিন ঢাকার একটি গণমাধ্যমে কাজ করার চেষ্টা করেন। মনে হয়, ভালো কিছু করতে পারেননি অথবা নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেননি। তাই তো আবারও ফিরে আসেন চাঁদপুরে।
ফিরে এসেই গ্রামীণ সাংবাদিকতায় মিশে গেলেন। ছুটে বেড়িয়েছেন পাড়া-মহল্লা, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। অবশ্য অন্যকিছু করার সুযোগ ছিল না। বয়স যা হয়েছে পাশাপাশি বিভিন্ন কাজে আর্থিক মাইর খেয়ে জীবনটাকে দুর্বিষহ করে তুলেছেন নিজেই। সবশেষ পারিবারিক অবস্থা খুব ভালো থাকার কথা নয়। অনুমান করেই বলছি। অথচ সাংবাদিকতা করেছেন নিবেদিত প্রাণ হয়েই। লেখার হাতও অনেক ভালো। চাঁদপুরের অনেক সিনিয়র সাংবাদিককে তার লেখার হাতের প্রশংসাও করতে শুনেছি। কিন্তু মফস্বল শহরের সাংবাদিকতায় তার জন্য বড় কোনো জায়গা তৈরি হয়নি। এ নিয়ে কখনো আপসোসও করতে শুনিনি তার মুখে। শুধু বাংলাদেশ ফটোজার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন চাঁদপুর জেলা শাখার একজন সদস্য হতে পেরেছেন।
আমার দেখামতে, অনেকের নিউজ লিখে দিয়েছেন রফিক ভাই। বিশেষত চাঁদপুর প্রতিদিনে যাওয়ার পর কিছু ভালো নিউজ আমার চোখে পড়েছে। যদিও নিজের মতো করে কাজ করার সুযোগ না পাওয়ায় ছেড়ে আবার চলে আসেন দৈনিক চাঁদপুর সংবাদ পত্রিকায়। এখানে ইচ্ছে করলেই নিজের মতো করে নিউজ ট্রিটমেন্ট দিতে পারেন। তাছাড়া পত্রিকাটির সম্পাদক ও প্রকাশক তাকে খুব পছন্দ করতেন। যে কারণে হয়তো ঘুরে-ফিরে এখানেই আশ্রয় নিয়েছেন। এখানে কাজ করেই হয়তো তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন।
রফিকুল ইসলাম ভাইকে নিয়ে আমার স্মৃতি অতো সমৃদ্ধ নয়। তবে মাঝে মাঝে কিছু সময় মিশেছি। সে সময়টুকুতে ভাইকে একজন নির্মোহ, সহজ-সরল আর প্রাণবন্ত মনে হয়েছে। জীবন কেটেছে কষ্ট আর টানাপোড়েনে। কিন্তু কখনো কাউকে বুঝতে দেননি। অল্পতে সন্তুষ্ট ছিলেন সদ্যপ্রয়াত রফিক ভাই। রফিক ভাইয়ের জন্য মন কাঁদে। দেখা হলে আর বলবেন না ‘ভাই কেমন আছো’। আর উৎসাহ দেবেন না। এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রবল মানসিক শক্তি বাড়ানোর জন্য কার্যকর মানুষ ছিলেন তিনি। আমার মানসিক শক্তি বাড়ানোর অন্যতম একটা উৎস বলা যায় রফিক ভাইকে। তিনি আমার এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা হিসেবে যেটুকু ভূমিকা রেখেছেন, যেটুকু মানসিক শক্তি দিয়েছেন; তা অমূল্য। বিনিময়হীন। তার প্রতি রইলো পরম শ্রদ্ধা।
চাঁদপুরের তথাকথিত মুরুব্বি সাজা বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের চেয়ে রফিক ভাই ঢের ভালো মানুষ। আমার হৃদ মাজারে তার অবস্থান অনেক উপরে। রফিক ভাই মাঝ বয়সে চলে গেলেন পৃথিবীর মায়া ছেড়ে। ইহজগত তো এমনই। প্রয়াত প্রবীণ এ সাংবাদিকের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি। রফিক ভাই ওপারে ভালো থাকুন, এ প্রার্থনা রইল।
লেখক: কথাশিল্পী ও সাংবাদিক।
এসইউ/এএ/এমএস