মানুষ ভয় পায় কেন?

ডা. হিমেল ঘোষ
ডা. হিমেল ঘোষ ডা. হিমেল ঘোষ , চিকিৎসক
প্রকাশিত: ০১:২৬ পিএম, ১০ আগস্ট ২০২০

কোনো অশুভ বা বিপদের আশঙ্কা অথবা বেদনার অনুভূতি সম্পর্কে অত্যধিক অগ্রীম চিন্তা করে মানসিক যে অস্বস্তিবোধের সৃষ্টি হয়, তা হলো ভয় বা ভীতি। অর্থাৎ শরীরের বাহ্যিক কিংবা অভ্যন্তরীণ পরিবেশে অনাগত বিপদ-বিপত্তির মোকাবেলায় শরীরের নিজস্ব শারীরিক এবং মনস্তাত্ত্বিক যে প্রতিরোধী প্রতিক্রিয়া, তাকেই ভয় বলে। তাহলে এককথায় দাঁড়াচ্ছে যে, ভয় মনের অবচেতন স্তরের একটি নির্দিষ্ট বিশেষ মানসিক অবস্থা। ভয় নামক এ অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত নয়, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। মানুষ তো বটেই, সমগ্র সৃষ্টিজগতের সব প্রাণির অন্তরেই ভয় নামক এ অনুভূতি রয়েছে।

ভয় নামক এ অনুভূতির সাথে শিশুকাল থেকেই আমাদের পরিচিতি ঘটে। একটি শিশুর বয়স যখন প্রায় ৬-৭ মাস, তখন থেকেই সে ভয় পাওয়ার অভিব্যক্তি দেখায়। স্বাভাবিকভাবে বিকাশমান একটি শিশু এ সময় তার মা কিংবা আপনজনকে তার চোখের আড়ালে যেতে দিতে চায় না, তাদের দেখতে না পেলে কান্না-কাটি করে ও বিরক্তিভাব প্রকাশ করে এবং মা বা তার ঘনিষ্ঠজনকে খুঁজতে থাকে। ভয় অনুভূতির সাথে এভাবেই আমাদের প্রথম পরিচয় ঘটে। কোনো অজানা পরিস্থিতিতে কিংবা যখন আমাদের নিরাপত্তাবোধ হুমকির মুখে- এ ধরনের কোনো বিষয় যখন আমাদের চিন্তায় আসে; তখন আমাদের শারীরিক এবং মানসিক কিছু পরিবর্তন ঘটে। বিবর্তনের ধারায় মানুষের শরীরবৃত্তীয় এবং মানসিক এ পরিবর্তনগুলোর একটি নির্দিষ্ট ধারা তৈরি হয়ে আছে। এ পরিবর্তনসমূহের মাধ্যমেই মানুষ পরিস্থিতি সম্পর্কে সতর্ক হয় এবং নিজের নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে পারে।

in

ভয়ের দরুণ শরীরে যে পরিবর্তনগুলো ঘটে, তাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন- শারীরিক এবং মানসিক। শারীরিক পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে- মাথা ব্যথা, মাথার ভেতর হালকা মনে হওয়া, চোখে ঝাপসা দেখা, ঘাড় ব্যথা, মুখ শুকিয়ে আসা বা পিপাসা লাগা, কাঁপুনি হওয়া, হাত-পা ঠান্ডা অথবা অবশ হয়ে আসা, বুক ধড়ফড় করা, হৃৎস্পন্দন দ্রুত হওয়া, শ্বাসকষ্ট, প্রস্রাব আটকে যাওয়া, পাতলা পায়খানা, পেটে ব্যথা, পেটের ভেতর অস্বস্তিভাব, ঘুমের ব্যাঘাত ইত্যাদি। আর মানসিক পরিবর্তনগুলোর মধ্যে রয়েছে- মনোযোগে ব্যাঘাত, সিদ্ধান্তহীনতা, অনিশ্চয়তার আশঙ্কা, মৃত্যুভয়, স্মরণশক্তি হ্রাস, অকারণেই বিরক্ত বোধ করা, শব্দের প্রতি অতিরিক্ত স্পর্শকাতরতা, অস্থিরতাসহ প্রভৃতি নানা উপসর্গ।

আমাদের শরীরের সিমপ্যাথেটিক স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র, হরমোন, বিভিন্ন জৈব রাসায়নিক যৌগের মাধ্যমে এ পরিবর্তনসমূহ পরিলক্ষিত হয়। মস্তিষ্ক থেকে নিঃসৃত এন্ডোরফিন, ডোপামিন, অক্সিটোসিনের মত কিছু হরমোন এবং নিউরো বার্তাবহসহ এড্রেনালিন গ্রন্থি এবং স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র থেকে নিঃসৃত এড্রেনালিন ও নর-এড্রেনালিন জাতীয় রাসায়নিক বার্তাবহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভয়ের দরুণ উদ্ভুত ‘ফ্লাইট’ এবং ‘ফাইট’ রেসপন্সে সাহায্য করে। ফ্লাইট রেসপন্স হচ্ছে ভয়ের বিষয় থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা এবং ফাইট রেসপন্স হচ্ছে ভয় আনয়নকারী ক্ষতিকর বিষয় বা বস্তুকে মোকাবেলা করে তাকে পরাজিত করতে চাওয়ার প্রবণতা। কার্যকর ও সঠিক সমন্বয় সাধনের জন্য ভয় নামক অনুভূতি থেকে উদ্ভুত এ দুই ধরনের প্রতিক্রিয়াই আমাদের জন্য জরুরি।

কিন্তু ভয়ের এ অনুভূতি যখন অতিরিক্ত এবং লাগামছাড়া হয়ে যায়, তখন বিষয়টা আর স্বাভাবিক থাকে না। অবচেতন মনের ভয়ের অনুভূতি যখন নির্দিষ্ট সীমারেখা অতিক্রম করে যায়, তখন উৎপন্ন হয় অস্বাভাবিক ভীতি বা ভয়রোগ বা ফোবিয়া। এটি এক ধরনের উদ্বিগ্নতা তৈরি করে এবং ক্রমে ক্রমে আক্রান্ত ব্যক্তিকে মানসিকভাবে অসুস্থ করে তোলে। অল্প মাত্রার ভয় চারপাশের পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের সজাগ রাখে ও আমাদের কার্যকারিতা বাড়ায়, যেমন- একজন ছাত্র যদি পরের দিন অনুষ্ঠিতব্য পরীক্ষা নিয়ে নিরুদ্বিগ্ন থাকে, তাহলে তখন পরীক্ষার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সে কিন্তু আর নেবে না। সমস্যা হয় তখনই; যখন অকারণে ভয়ের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় অথবা অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখা যায় অথবা দুই রকম ব্যাপারই একই সাথে ঘটে।

in

ফোবিয়া হতে পারে দুই ধরনের, যেমন- সামাজিক ভীতি বা সোশ্যাল ফোবিয়া এবং বিশেষ বিশেষ বস্তু বা বিষয়ের প্রতি ভীতি বা স্পেশাল ফোবিয়া। সোশ্যাল ফোবিয়া হলো নিজেকে সমাজে মেলামেশার অনুপযুক্ত মনে হওয়া। এরূপ আক্রান্ত ব্যক্তির সব সময়ই যেন মনে হয়, পাছে লোকে কিছু ভেবে বসে। কেবলই মনে হয়, সবাই যেন তার আচার-আচরণ খুঁটিয়ে লক্ষ্য করছে বা তার সম্পর্কে খারাপ কিছু ভাবছে। ফলে কথা বলার সময় ওই ব্যক্তি বেশি সচেতন হয়ে পড়ে, অস্বস্তিতে নার্ভাস অনুভব করে এবং লজ্জা পায়। এসবই মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। আর স্পেশাল ফোবিয়া হলো বিশেষ কোনো পরিস্থিতি বা নির্দিষ্ট কোনো জিনিসে অকারণে অতিরিক্ত ভয় পাওয়া। সাধারণত পাঁচ রকমের স্পেশাল ফোবিয়া হয়। যেমন- জীবজন্তু যথা সাপ, কুকুর, মাকড়সা ইত্যাদিতে ভয়; স্থান যথা উঁচু জায়গা, পানি, অন্ধকার ইত্যাদিতে ভয়; বদ্ধাবস্থা যথা লিফট, টানেল ইত্যাদি অবস্থানে ভীতি; রক্ত, আঘাত, অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতিতে ভয় পাওয়া এবং নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যুভয়।

এরকম কিছু অদ্ভুত বিষয় বা বস্তুর প্রতি মাত্রাতিরিক্ত ভীতি নিয়ে আলোচনা করা যাক, যেমন-
১. টেলিফোন ফোবিয়া- ফোন ধরা বা কথা বলার ভয়
২. টেট্রাফোবিয়া- ৪ নম্বর সংখ্যার প্রতি ভয়
৩. থ্যানাটোফোবিয়া- মারা যাওয়ার ভয়
৪. টোকোফোবিয়া- সন্তান জন্মদানের ভয়
৫. ট্রামাটোফোবিয়া- আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার ভয়
৬. ট্রিসকাইডেকাফোবিয়া- ১৩ নম্বর সংখ্যার ভয়
৭. ট্রিপানোফোবিয়া- সূচ বা ইনজেকশনের ভয়
৮. ওয়ার্কপ্লেসফোবিয়া- কর্মক্ষেত্রের ভয়
৯. জেনোফোবিয়া- বিদেশি অথবা অচেনা কোনো কিছু বা লোকের ভয়
১০. হিলোফোবিয়া বা জাইলোফোবিয়া- গাছ বা বন-জঙ্গলের ভয়
১১. গ্লসোফোবিয়া- জনসম্মুখে কথা বলার ভয়

in
১২. ব্যাকটেরিয়াফোবিয়া বা মাইক্রোফোবিয়া- অণুজীব এবং ব্যাকটেরিয়ার ভয়
১৩. সিবোফোবিয়া বা সিটোফোবিয়া- খাবারের প্রতি বিরক্তি বা ভয়
১৪. ক্লসট্রোফোবিয়া- বদ্ধস্থানের ভয়, যেখান থেকে পালানো বা যেখানে আবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা আছে
১৫. ডিসাইডোফোবিয়া- সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভয়
১৬. ডেন্টালফোবিয়া বা ওডোন্টোফোবিয়া বা ডেন্টোফোবিয়া- ডেন্টিস্ট বা দাঁতসম্বন্ধীয় ব্যাপারে ভয়
১৭. ডিসপোসোফোবিয়া- কোনো কিছু হারানো বা মুক্ত হয়ে যাওয়ার ভয়
১৮. ডিসমরফোবিয়া- সত্যিকার অথবা কল্পিত দেহ সমস্যার ভয়
১৯. গেলোটোফোবিয়া- নিজেকে নিয়ে কৌতুক করা বা হাসাহাসি করার ভয়
২০. জিমনোফোবিয়া- নগ্নতার ভয়
২১. হেলিয়োফোবিয়া- সূর্য অথবা সূর্যের আলোর ভয়
২২. এব্লুটোফোবিয়া- স্নান, ধোয়া-মোছা অথবা পরিষ্কার করার ভয়
২৩. একাউসটিকোফোবিয়া- শব্দভীতি
২৪. এক্রোফোবিয়া বা এলটোফোবিয়া- উচ্চতাভীতি
২৫. এগোরাফোবিয়া- উন্মুক্ত স্থানের প্রতি ভীতি
২৬. এলগোফোবিয়া- ব্যথার ভয়
২৭. এজিরোফোবিয়া- রাস্তা পারাপারের ভয়
২৮. এন্ড্রোফোবিয়া- মানুষের প্রতি ভয়
২৮. এনথ্রোপোফোবিয়া- মানুষের সঙ্গী হওয়ার ভয়
২৯. এনথোফোবিয়া- ফুলের ভয়
৩০. একুয়াফোবিয়া- জল বা জল জাতীয় পদার্থ, রাসায়নিক ইত্যাদির ভয়
৩১. এরাকনোফোবিয়া- মাকড়সার ভয়
৩২. এসট্রাফোবিয়া- বিদ্যুৎ চমক বা বাজ পড়ার ভয়
৩৩. এটিচিফোবিয়া- অকৃতকার্য হওয়ার ভয়
৩৪. এভিয়োফোবিয়া বা এভিএটোফোবিয়া- উড্ডয়নের ভয়
৩৫. অটোফোবিয়া- একাকীত্বের ভয়
৩৬. আইচমোফোবিয়া- তীক্ষ্ণ বা ধারালো বস্তুর ভয়
৩৭. আগ্রাফোবিয়া- যৌন নিপীড়নের ভয়
৩৮. ইমেটোফোবিয়া- বমি করার ভয়
৩৯. ইরগোফোবিয়া- কাজের ভয়, যেমন চিকিৎসক সার্জনের অস্ত্রোপচারের ভয়
৪০. ইরোটোফোবিয়া- ভালোবাসা সম্বন্ধীয় প্রশ্নের ভয়।

এ ধরনের বিভিন্ন ফোবিয়া থেকে মুক্তি পেতে সাইকোথেরাপি, কগনেটিভ বিহেভিয়রাল থেরাপি প্রভৃতির শরণাপন্ন হওয়া যায়। তীব্র ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক বিভিন্ন ধরনের ওষুধ সেবনেরও প্রয়োজন পড়তে পারে।

এসইউ/এএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।