২০০ বছরের পুরোনো কাইকারটেক হাট

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৮:১৯ এএম, ০১ আগস্ট ২০২০

বেনজীর আহমেদ সিদ্দিকী

হাটবারের দিন গ্রামের গৃহস্থ খুব সকাল সকাল গোসল সেরে গরম ধোঁয়া ওঠা বা পান্তা ভাত খেয়ে তার আবাদ করা ফসল বা তৈরি করা জিনিসপত্র নিয়ে নৌকা বেয়ে, মেঠো পথ ধরে রওনা হন। উদ্দেশ্য এসব জিনিসপত্র হাটে বিক্রি করে কিছু আয় করে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করা। চিরায়ত গ্রামবাংলার হাটকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এমন একটি ছবি কল্পনায় নিয়েই যাত্রা শুরু হয়েছিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার মোগরাপাড়া ইউনিয়নে। প্রায় ২০০ বছর ধরে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যকে ধারণ করা বিশাল কাইকারটেক হাট। যদিও ২০০ বছরের কোনো লিখিত প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায়নি। তবে কাইকারটেক হাট নিয়ে লোকমুখে প্রচলিত রয়েছে, একসময় এই হাটে হাতি-ঘোড়াও নাকি বেচাকেনা হতো! ছিল রাজা-বাদশাহদের আনাগোনাও।

jagonews24

ব্রহ্মপুত্র নদের তীর ঘেঁষে প্রাকৃতিক পরিবেশের মাঝে গড়ে উঠেছে কাইকারটেকের হাট। যা প্রাচীন ঐতিহ্য গৌরবের সাথে বুকে লালন করে চলেছে। হাটের প্রাচীন নিদর্শন ও পাতা ঝরা কড়ই এবং হিজল গাছগুলো যেন হাটের বয়সকালের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাট থেকে সামনে এগোলেই কাইকারটেক ব্রিজ। ব্রিজ থেকে সামনে তাকালেই চোখে পড়বে অবারিত সবুজ আর ব্রহ্মপুত্র নদের টলটলে পরিষ্কার পানি এবং নদকে ঘিরে প্রাকৃতিক জীবনযাত্রা।

বাংলাদেশের সব হাট একটি প্রথাগত সময় মেনে চলে। তারই ধারাবাহিকতায় সপ্তাহে প্রতি রোববার হাটটি সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নরসিংদী, কুমিল্লাসহ আশপাশের নানা জেলা থেকে হাটবারে অনেকেই চলে আসেন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে।

jagonews24

কী নেই এই হাটে! জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় নানা কিছুর পসরা সাজিয়ে বসে এই হাট। আপনি গেলেই দেখতে পাবেন সবাই বেশ উৎসবমুখর পরিবেশে মাছ ধরার বিভিন্ন সামগ্রী, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, কবুতর, খাল ও নদীর মাছ, কাস্তে, দা, বটি, কুড়াল, জামা-কাপড়, কলমের গাছসহ নিত্য ব্যবহার্য নানা কিছু বেচাকেনায় ব্যস্ত। মৌসুমী নানা ফল, যেমন- আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল ও খাবার জিনিস থেকে শুরু করে ঘরে বানানোর আসবাবপত্র সবই ওঠে এখানে।

jagonews24

ঐতিহ্যবাহী কাইকারটেক হাটের নৌকার কেনাবেচার ইতিহাস বহু বছরের পুরোনো। এ হাটের নৌকার খ্যাতি এলাকা ছাড়িয়ে আশপাশের বিভিন্ন জেলায় পৌঁছে গেছে। আর তাই বছরজুড়ে হাট বসলেও শুধু আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র ও আশ্বিন এই চার মাস কম দামে ভালো মানের নৌকা কেনার জন্য বিভিন্ন জেলা থেকে শত শত ক্রেতার আগমন ঘটে। বছরের মধ্যে বিশেষ করে এ ৪ মাস কাইকারটেক হাট প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর হয়ে ওঠে।

jagonews24

হাটে বিক্রি হওয়া মজার মজার খাবারের স্বাদ মুগ্ধ করে আগন্তুকদের। ঐতিহ্যবাহী এই কাইকারটেক হাট ইতিহাস-ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত হলেও এ হাটের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হলো বিশেষ একধরনের মিষ্টি। ওজন আর পরিমাপে অন্যান্য মিষ্টির তুলনায় এই মিষ্টি চার থেকে পাঁচগুণ বড়। এর ওজন এক থেকে দুই কেজি হয়ে থাকে। অনেকটা শিলপুতার মতো দেখতে এই মিষ্টির নাম দেওয়া হয়েছে ‘পুতা মিষ্টি’। এ হাটের মতোই পুতা মিষ্টির ঐতিহ্যও অনেক পুরোনো। রোববারের এই হাটে অনেকে শুধু এ মিষ্টির স্বাদ নেওয়ার জন্য দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসেন অনেক মিষ্টিপ্রেমী। তবে এ মিষ্টি কবে, কে, কিভাবে তৈরি শুরু করে এ ব্যাপারে তেমন কোনো তথ্য দিতে পারেনি এখানকার মিষ্টি তৈরির কারিগর ও ব্যবসায়ীরা। ১২০-১৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় পুতা মিষ্টি।

jagonews24

পুতা মিষ্টির বাইরে তালের রসা, কালোজাম, রসগোল্লা, জিলাপি, মোহনভোগ, লালভোগ, বালুশাহ্সহ নানা পদের মিষ্টি থেকে শুরু করে দই, পরোটা-ভাজি, ডালসহ নানা পদ এখানে পাওয়া যায়। শুধু মিষ্টি নয়, এখানে বিক্রি হয় টক দই ও আখের গুড় দিয়ে বানানো লাচ্ছি, বিশেষ ঝালমুড়ি, মুরালি, বুট, পেঁয়াজু, নিমকি, চানাচুর, মোয়াসহ নানা ধরনের লোকজ খাবার। এ ছাড়াও অনেক পদের মাছের শুঁটকিও এখানে খুব নামকরা। অনেকেই চ্যাপা ও ইলিশ শুঁটকি কিনতে এ হাটে আসেন।

jagonews24

হাটের মজার মজার খাবারগুলোর স্বাদ, নানা লোকজ ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য এবং সহজ-সরল গ্রামীণ জীবনযাপনের মুগ্ধতা নিতে চাইলে আপনাকে যেতে হবে সোনারগাঁওয়ের কাছে মোগরাপাড়া চৌরাস্তায়। সেখান থেকে ডানের কিছুটা পথ এগোলেই পেয়ে যাবেন কাইকারটেক হাট। ঢাকার গুলিস্তান থেকে বাসে সোনারগাঁওয়ের মোগরাপাড়া চৌরাস্তায় নামলে কাইকারটেক হাট যাওয়ার সিএনজি পাবেন। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ জেলা শহরের চাষাড়া থেকে নবীগঞ্জ ঘাট পার হয়েও কাইকারটেক হাট যাওয়া যায়। আর মুন্সিগঞ্জ থেকে নৌরুটে ট্রলার বা বোট ভাড়া করে সরাসরি পৌঁছাতে পারবেন ঐতিহ্যবাহী এ হাটে।

লেখক: ফার্মাসিস্ট ও সমাজকর্মী।

এসইউ/এএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।