এক পরিবারের ৬ জন করোনামুক্ত হওয়ার গল্প

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫:৫৪ পিএম, ২৭ জুন ২০২০

শেখ মহিউদ্দিন রাসেল

আলহামদুলিল্লাহ, পরম করুণাময় রাব্বুল আলামিনের কাছে শুকরিয়া। যার দয়া ও করুণায় আমি ও আমার ৪ সন্তানসহ পরিবারের ৬ জন আজ করোনামুক্ত। নিজেদের করোনা যুদ্ধজয়ী বলবো না, আল্লাহর দয়ায়ই কঠিন এ ভাইরাস থেকে মুক্ত হয়েছি। সব জয়ের মালিক তিনি এবং সব প্রশংসা তাঁরই। আল্লাহ নামক একজন আছেন বলেই তার প্রমাণ এখানে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা পজিটিভ খুঁজি কিন্তু করোনার ক্ষেত্রে নেগেটিভই সফলতা। করোনা পজিটিভ থেকে করোনা নেগেটিভ। এ এক কঠিন বাস্তবতা। এ বাস্তবতাকে সঙ্গী করে অতিক্রম করতে পেরেছি শুধু ইবাদত আর দৃঢ় মনোবলের কারণেই। আমি বলবো, কোন ওষুধ উপাত্ত নয়, স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা এ কঠিন সময়টিতে আমাদের প্রতি সদয় হয়েছেন। তা না হলে একই সাথে সবাই করোনা পজিটিভ আবার একই সাথে ৬ জনই নেগেটিভ। এ এক কাকতালীয় আশ্চর্যজনক ঘটনা।

আমরা দু’জন স্বামী-স্ত্রী সরকারি চাকরিজীবী। সঙ্গত কারণেই সরকারের নির্দেশনা পালনে ব্রত। তারই অংশ হিসেবে জেলা পরিষদ জেলার বিভিন্ন শ্রেণিপেশার জনগণের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করে। যাতে আমিও অংশ নেই। আমার স্ত্রীও তার স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের উপবৃত্তির তালিকা প্রণয়নেও আক্কাছ আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেতে হয়েছে। দু’জনেরই গন্তব্য ছিল আবার একই নীড়মুখী। সব উপকরণ পরেও সতর্কতার মধ্যে চলেও ভাইরাস যে কখন নিজেদের দেহে বাসা বেঁধেছে, তা জানা ছিল না। শরীর একটু খারাপ লাগায় ছুটি নিয়ে আসি। ১৪ মে আমার ও স্ত্রী রোজিনা হাবিবের জ্বর, সর্দি, শরীর ব্যথা দেখা দেয়। ভাবলাম মৌসুমের ভাইরাস জ্বর। বুঝে উঠতে না উঠতেই বড় ছেলে শেখ আরিফ মহিউদ্দিন (১৫), শেখ আসিফ মহিউদ্দিন (১৩), শেখ আবিদ মহিউদ্দিন (৯) ও আমেনা বিনতে মহিউদ্দিন (৩ বছর ৩মাস) সবারই জ্বর, সর্দি, বমি ও ক’জনের পেট খারাপ দেখা দেয়। সিভিল সার্জন ডা. সাখাওয়াত উল্লাহর সাথে আলাপ করি এবং তিনি হাসপাতালে যেতে বলেন। তিনি বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে আমলে নেন। মুহূর্তের মধ্যে সন্তানদের সবাইকে দূরত্ব বজায় রেখে অবস্থান করার জন্য বলি। সবার গ্লাস, বাটি, প্লেট ইত্যাদি আলাদা করে দেই। কেউ কাউকে স্পর্শ না করার জন্য তাদের বলি। ছোট ছেলে ও মেয়েটা ঘুরেফিরে আমাদের কাছে। শুধুই কান্নাকাটি করে। এক ছাদের নিচে দুটি বেড ও ড্রইং রুম মেঝে মিলিয়ে ৫টি বেডে আলাদাভাবে ৬ জনের থাকার ব্যবস্থা করি। ছোট মেয়েটাকে তার মা থেকে একটু দূরে রাখি এবং নিজেদের মনোবল শক্ত রেখে আমরা দু’জনই নিজেদের ক্লান্ত দেহ নিয়ে তাদের মাথায় পানি দেই।

লেবু, দারচিনি, এলাচ, লং, আদা, কালিজিরা, তেজপাতা মিশ্রিত জাল দেওয়া পানি তোয়ালে, গামছা মাথার উপর দিয়ে নাক ও মুখে ভাপ নেই দিনে অন্তত ৪ বার। ওরা নিতে চাইতো না, তারপরও চেষ্টা বিফলে যায়নি। কান্নাকাটি করলেও ছোট মেয়েটার মাথা ধরে বাটি মুখের সামনে দিতাম। ভাপ নেওয়া এ টক, তিতো পানি আমরা ৫জন পান করি আর বড় ছেলের গলা হালকা ব্যথার কারণে লবণ দিয়ে ওই পানি গড়গড়া করাতাম। আবার ঝমঝম কূপের পানি পান করি। ছোট মেয়েটাকে হালকা গরম পানি পান করাই। নমুনার রেজাল্ট যা-ই হোক, পজিটিভ ভেবেই যথারীতি চিকিৎসা শুরু করে দিয়েছি। স্ত্রীর নাকে গন্ধ থাকার কারণে সে-ও লবণ মিশ্রিত পানি দিয়ে গড়গড়া করতো। পেট খারাপ থাকার কারণে ওদের দু’একজনকে গরম পানি দেইনি কয়েকদিন। তবে এসএমসির ওরস্যালাইন দেওয়া হতো। রং চা, গরুর গরম দুধ পান করেছি। স্ত্রী রোজি বলতো, ফ্রিজ খুললে ঠান্ডা বাষ্প গায়ে ও মুখে লাগলে খুব খারাপ লাগে। পরে অবশ্য মুখে মাস্ক পরে দূর থেকে ফ্রিজ খোলা হতো। মাল্টা, শাক-সবজি ভালোভাবে সিদ্ধ করা হতো। সকলের আলাদা পোশাক, বিছানাপত্র দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিনই তা রৌদে দেওয়া হতো জীবাণু ধ্বংসের জন্য। এরই মধ্যে বাসার মেঝে ব্লিচিং পাউডার দিয়ে নিজেই ধুয়ে নেই। করোনার কথা জেনে কাজের মহিলাও সটকে পড়ে। নিজেরাই ডাক্তার, নার্স ও রোগী, আবার কাজের মানুষের ভূমিকায়। সকলেই প্রতিনিয়ত সাবান এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করি। তার মধ্যে ওষুধ হিসেবে নাপা ৫০০ মিগ্রা, বমির জন্য অমিডন ১০ মিগ্রা, শ্বাসকষ্টের জন্য মোনাস ১০ মিগ্রা সেবন করি। তবে কারো শ্বাসকষ্ট ছিল না। গলাব্যথাও তেমন ছিল না। সদর হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. সৈয়দ আহমেদ কাজলের পরামর্শ নেই। তিনি তার সাথে ফেক্সো ১২০ মিগ্রা যোগ করার জন্য বলেন। প্রতিদিন রাতে ১টা বড়দের বেলায়। পাশাপাশি আমার জন্য ডায়াবেটিক ডায়াট্রল ৮০ মিগ্রা ও ডি-লিনা ৫ মিগ্রা, গ্যাস্টিকের প্যানটোনিক্স ২০-২০ মিগ্রা চলবে জানান। ছোট বাচ্চার জন্য সিরাপ প্রজমা। সিভিল সার্জনের কথামতে ডা. সাজেদা পলিন ম্যাডামের সাথে কথা বলি। ১৭ জুন সকালে সদর হাসপাতাল থেকে জনৈক ডা. আমাকে কল করেন এবং একেক করে ৬ জনের নাম, জন্মতারিখ, পেশা, মোবাইল নম্বর, ঠিকানা নেন। ওইদিন দুপুর ২টায় দুই জন স্বাস্থ্য সহকারী বাসায় এসে আমাদের সবার নমুনা সংগ্রহ করেন। নমুনা সংগ্রহের সময় তাদের পিপিই ড্রেস পরা দেখে ছোট বাচ্চারা ভয়ে কেঁদে ওঠে এবং নমুনা দিতে নারাজ। স্বাস্থ্য সহকারীরা গলা থেকে লালা সংগ্রহ করেন। তখন অধিকাংশই বমি করে। এতে কয়েকটি রোজা রাখা সম্ভব হয়নি।

এবার রিপোর্টের অপেক্ষার পালা। প্রহর গুনছি রিপোর্টের জন্য আর ওদের, নিজেদের সেবা ওভাবেই চালাচ্ছি। এখন বাচ্চারা বুঝেছে তাদের কঠিন অসুখ হয়েছে। ছোট মেয়েটাও এবার গামছা দিয়েই ভাপ নেয় দুষ্টুমির ছলে। কোন ঠান্ডা পানি নয়, কুসুম গরম করে সবাই পানি পান করি। তখন আমার ইচ্ছা ছিল অসুখ আমার হোক, ওদের কারো যেন না হয়। আমি একা আলাদা সরে থাকতে পারবো আর ওর মায়ের হলে সন্তানদের সেবা করতে পারবে না। বিভিন্ন ধরনের শঙ্কা নিয়েই রিপোর্টের জন্য দিন গুনছি আর ইবাদত করছি। খারাপ লাগতো তখন; যখন ফজরের নামাজ পড়ে ওদের দিকে তাকাতাম। বাসাটা যেন একটা মিনি হাসপাতাল। যে যার জায়গায় পড়ে আছে। ছোট মেয়েটা তার মায়ের সাথে, আবার আমার কোলে। শুধুই যন্ত্রণা কান্না-কাটি। এরই মধ্যে আমার জ্বর ভালো হয়ে গেছে; মনে হয়েছে সুস্থ বোধ করছি। স্ত্রী চরম অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাচ্চাদের কারো জ্বর কিছুটা কমলেও আবার কারো পেটখারাপ থাকে, আবার বমি করে। একটা না একটা উপসর্গ থাকেই। প্রতিটা রাতের বেশি সময় আমরা দুজনেই সজাগ ছিলাম। কপাল ধরে ওদের অবস্থা, শ্বাসপ্রশ্বাস সঞ্চালন লক্ষ্য করতাম। তখন আমি বিষয়গুলো কঠিনভাবে সামলাই। এর মধ্যে অনেক আত্মীয়-স্বজন জেনে যায়, আমাদের নমুনা নেওয়া হয়েছে। তাদের সাথে কথা বলা, নিজেদের সেবা, রান্না-বান্না সব মিলিয়ে এক কঠিন বাস্তবতায় আমরা।

স্ত্রী রোজী বলে, খবর নিতে বল তো রিপোর্ট এসেছে কি-না। আমি নিবো কি-না আবার পিছিয়ে যাই ভয়ে। যদি না খারাপ রিপোর্ট আসে। ২০ মে দুপুর অনুমান ২টা। ডা. সাজেদা পলিন বলছি, আপনাদের ৬ জনেরই করোনা রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। আমি অপ্রস্তুত ছিলাম। মুহূর্তের মধ্যে যেন মাথায় বাজ পড়লো। এ কথাটাই মনে হয়েছে আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন বার্তা। বিষয়টি স্ত্রীকে জানালাম। সে আমাকে সান্ত্বনা দিলো, আল্লাহ যা করেন ভালোই করেন। ওদের জানতে দেইনি। দুজনেই সিদ্ধান্ত নিলাম। আল্লাহ ভরসা। আমরা মনোবল এভাবে শক্ত রাখলাম যে, আমাদের কিছুই হয়নি। আমরা যদি শারীরিকভাবে ভেঙে পড়ি তাহলে সন্তানদের বাঁচাতে পারবো না। এই ভেবে নিজেদের সংযত করলাম। এরই মধ্যে সিভিল সার্জন ও ডা. পলিন জানালেন, আমাদের এ সময়টা কিভাবে চলতে হবে। তিনি আমার মেসেঞ্জারে দিকনির্দেশনা ও ভিটামিন জাতীয় ওষুধের নাম দেন teb-zorate 60, Ten e cap 200mg, teb- araitovo6t b। বাচ্চাদের জন্য জিংক সিরাপ বা zinc b teb আর যা খাচ্ছি ওষুধ তা চলবে জানান। মুহূর্তেই চারিদিকে বিষয়টি চাউর হয়ে যায়। ফেসবুক, অনলাইন মিডিয়াসহ সর্বত্রই যেন ভাইরাল হয়ে পড়ে। এদিকে দুজনের মোবাইলে অনবরত কল আসতেই থাকে। তারা সবাই পরামর্শ ও সান্ত্বনা দেন। এরপর থেকেই আমাদের ও ওদের চিকিৎসা সেবাযত্ন আরও বাড়িয়ে দেই। ভাগ্যিস আমরা রিপোর্ট পজিটিভ আসার আগেই চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে আসছি। এটা ছিল আমাদের সুস্থতার টার্নিংপয়েন্ট। এর কারণে আমি ও আমার স্ত্রী এখন অনেকটা সুস্থবোধ করছি। পজিটিভ রিপোর্টের পর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার বিরামহীন ফোন আসছে। ঢাকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ঢাকা শিশু হাসপাতাল, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন, জেলা পরিষদ, এসপি অফিস, গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস, সদর মডেল থানা, সিভিল সার্জন অফিস, উপজেলা স্বাস্থ্য ক্লিনিক, সদর হাসপাতালসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে বিভিন্ন তথ্য নাম, জন্মতারিখ, পেশা, মোবাইল নম্বর, ঠিকানা, নমুনা ও পজিটিভ হওয়ার তারিখ, শারীরিক অবস্থা ইত্যাদি তথ্য নেন। দুজনে আমরা সরকারি চাকরি করাতে হয়তো অতিরিক্ত কিছু সংস্থা তথ্য নিয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সরকারি ও বেসরকারি কোন সংস্থা সরেজমিনে আসেননি এবং খোঁজ-খবরও নেননি। যা করেছেন ফোনে, ব্যক্তিপর্যায়ে। ছয় জন লোক আক্রান্ত অথচ সংশ্লিষ্টরা বাসাটিকে পর্যন্ত লকডাউন করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি। নিজেরাই নিজেদের লকডাউন করে রেখেছি।

পজিটিভ রিপোর্টের প্রথম দিন বিকেলে এলাকার সোহেল রানা নামে এক সন্ত্রাসী আওয়াজ তুলে আমার বাসাকে দেখিয়ে ‘করোনা হয়েছে রে- করোনা হয়েছে রেসহ আরও অনেক বাজে কথা বলে উপহাস করতে থাকে। তখন বিষয়টি আমার নজরে আসে। এতে বুঝতে পারি, আমাদের বিষয়টি এলাকায় জানাজানি হয়ে গেছে। এতে খুব কষ্ট পেয়ে নিজের মধ্যে বিষয়টি চেপে রাখি। আমার সাথে দীর্ঘদিন অভিমান করে থাকা বড়ভাই শেখ মহসিন ওষুধ ও খাবার দেওয়ার জন্য পাগলের মতো ছুটে আসে বাসা প্রাঙ্গণে। বাসায় তা দেওয়ার সময় মরার ওপর খাড়ার ঘা’য়ের মতো এলাকার সোহেল রানা নামে ওই যুবক প্রচণ্ডভাবে বাঁধা দেয়। তা নিয়ে হতাশ ভাই আমার, কথা কাটাকাটি ও বাঁধা উপেক্ষা করে আমাকে খাদ্যসামগ্রী দিয়ে যায়। তখন তার দরদ উজার করা আবেগ দু’ভাইয়ের মধ্যে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সোহেল রানার বিষয়টি আমি ৯৯৯ নম্বরে জানালে আবার এ ধরনের আচরণ করলে তাৎক্ষণিক তাদের জানাতে বলেন। জানাই চাঁদপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাসির উদ্দিনকে। তিনি জানান, করোনা আক্রান্ত বাড়িতে পুলিশ যেতে ও আপনার সাথে কথা বলতে পারবে না। আমি বলেছি, পাশের বাড়ি সন্ত্রাসীর। তিনি আমার কাছে তার টেলিফোন নম্বর চান। থানার করোনা সংশ্লিষ্ট কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার এসআই আওলাদকে জানালে তিনি সোহেল রানাকে টেলিফোনে সতর্ক করে দেন। এডিশনাল এসপির স্টেনো আমার চাচাতো ভাই মোসলেউদ্দিনকেও বিষয়টি জানাই। সে-ও ওসিকে (তদন্ত) জানায়। কিন্তু পুলিশ আসার কোন দৃশ্যই আজও চোখে পড়েনি। হতবাক ও স্তম্ভিত আমি। নিজের পরিবারের এ অবস্থা, তা নিয়েই ছিল মাথাব্যথা। এহেন পরিস্থিতিতে আর বাড়াবাড়ি না করাটাই সঠিক মনে করেছি। একসময় সাংবাদিকতা করেছি। তাই হয়তো মিডিয়াগুলো আমাকে ভালোভাবেই চিনতো ও জানতো। তারা বেশ আন্তরিকতা দেখিয়েছে আমার ছবি ও অনেকে নাম এড়িয়ে গিয়ে। এরই মধ্যে আমার ডান পা ফুলে ফোঁড়ার মত সৃষ্টি হয়। যার ছবি তুলে ডাক্তারকে পাঠাই। তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং দ্রুত ডায়াবেটিক মাপার জন্য বলেন। ডা. সাজেদা পলিন জানান, অবস্থা খারাপ হলে সদর হাসপাতালে আমাকে ভর্তি হওয়ার জন্য। তবে ডাক্তার এন্টিবায়োটিক, মালিশ এবং ডায়াবেটিক ওষুধ বাড়িয়ে দিয়েছেন। এরই মধ্যে শেখ আরিফ, আমেনার জ্বর ভালো হয়ে যায়। তবে কাশি ও সর্দি লেগেই আছে সকলের। শেখ আসিফ ও শেখ আবিদের হালকা জ্বর ও পেটখারাপ, বমির বেগ ছিল। তাদের দিনের মাঝে রোদে ছাদে নিয়ে যেতাম কিছুক্ষণের জন্য। তবে জ্বর কখনও মেপে দেখিনি। কপালে হাত দিয়েই অনুমান করি। প্রতিদিন নাক দিয়ে লম্বা নিশ্বাস নিয়ে তা আটকে আবার মুখ দিয়ে দম ছেড়েছি অন্তত দশ বার। ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে করোনা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য যা পেয়েছি, তা-ই করেছি।

সিভিল সার্জন জানালেন, সরকারি সিদ্ধান্ত হলো এখন ১৪ দিন পর দ্বিতীয় নমুনা নেওয়া। তাকে জানালাম, বাচ্চারা আলাদাভাবে থাকছে। দ্বিতীয় নমুনা নেওয়া হলে তাদের একত্রে রাখা যেতো। ৩১ মে হয় চৌদ্দ দিন। ১ জুন নমুনা নিবে বলে জানায়। অবশেষে ওইদিন দুপুরে নমুনা নেন। ভাগ্য কি সহায় বলতে হবে। পরদিন ২ জুন থেকে বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করা বন্ধ হয়ে যায় সংগ্রহকারীগণ অসুস্থ হওয়ার কারণে। এবার দ্বিতীয় রিপোর্টের অপেক্ষায়। রুটিনমাফিক হালকা কুসুম গরম পানি খাওয়া, নিয়মিত গরম ভাপ নেওয়া, লবণ আবার ভিনেগার মিশ্রিত পানি দিয়ে গড়গড়া করা, প্রচুর পানি পান করা, রং চা, গ্রিন টি পান করা, শরীরের দুর্বলতা কাটানোর জন্য ওরস্যালাইন খাওয়া, ভিটামিন সি ও ডি যুক্ত খাবার, ফল, শাক-সবজি খাওয়া, বাচ্চাদের সিভিট ট্যাবলেট খাওয়া, কসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করা, জ্বরের কারণে মাথায় ঠান্ডা পানি ও গা মুছিয়ে দেওয়া ইত্যাদি রুটিনমাফিক চলছিল। এর জন্য আমার স্ত্রী রোজির অবদানের কথা আমি কখনও অস্বীকার করতে পারবো না। নিজের চিন্তা না করে আমাদের পাঁচ জনের পেছনে গাঁধাখাটুনি খেটেছে। আল্লাহ সহায় থাকাতে তার উছিলায়ই আমাদের আজকের সুস্থতা। তার মনোবল অটল থাকাতে ঘর নামক মিনি হাসপাতালটা আজ এক সুখী বসতঘরে ফিরে এসেছে। আল্লাহ তাকে নেক হায়াত দান করুক। সন্তানদের সকলকে নিয়েই নামাজের জামাত আর ইবাদত করেছি। নামাজে তাদের মায়ের আহাজারি আল্লাহ শুনেছেন। পর্যায়ক্রমে সকলেই সুস্থ হয়ে উঠি।

পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আবদুল্লাহ আল মাহমুদ জামান স্যারের পাঠানো ফল-ফলাদি, শ্বশুরবাড়ি থেকে পাঠানো ঈদের বাজার দিয়ে সেরেছি ঈদ আয়োজন। এডিসি মাহমুদ জামান স্যার সব সময় খোঁজ নিতেন এবং সব ধরনের সহযোগিতা করার বারবার ইচ্ছা পোষণ করেন। প্রতিবেশীরা খোঁজ-খবর না নিলেও আমার বাসার দিকে তাদের চাহনি ছিল বেশ লক্ষ্যণীয়। মনে হয়েছে, নিজেরা বুঝি অনেক অপরাধ করে ফেলেছি। ঘটনা জানার পর থেকে চারিদিকের বাসার জানালাও খোলেনি অনেকে এখন পর্যন্তও। আবার এলাকার কেউ আমাকে দূর থেকে বাসায় দেখামাত্রই খোঁজ নিয়েছেন। আবার অনেকের বাঁকা চোখের চাহনি আমাকে করেছে হতবাক। আমার বাসাটি মানুষের কাছে দূর থেকে দেখার যেন একটি দুর্লভ বস্তুতে পরিণত হয়েছে।

৪ জুন বিকেলে ডা. সাজেদা পলিন আপা জানান, আপনাদের সকলের রিপোর্ট এসেছে। তিনি রিপোর্টের কপি আমার মোবাইল মেসেঞ্জারে পাঠান এবং আরও এক সপ্তাহ বিশ্রামে থাকার জন্য বলেন। মনটা ভরে গেলো আর মনে হলো এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের বার্তা। নিজের অজান্তে চোখে জল এসে যায়, এ হলো আনন্দ, আনন্দের ফোঁটা। তা আমি মুহূর্তের মধ্যে সবাইকে জানাই এবং তা ফেসবুকে দেই। তো ওই আগের মতই শুরু হলো মানুষের প্রাণঢালা ভালোবাসার প্রতিফলন মোবাইল কলে এবং ফেসবুকে। সকলে জেনেছে, দ্বিতীয় রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। তারপরও অনেকে আমাদের প্রতি স্বাভাবিক হচ্ছেন না। বহু দূরত্ব রেখেই কথা বলছেন। আমাকে দেখামাত্র মনে হচ্ছে এক আতঙ্ক। জেলা প্রশাসন থেকে করোনামুক্তিতে ফুলেল শুভেচ্ছা জানাতে আমন্ত্রণ জানানো হয় আমাকে আর অন্যদিকে দূর দূর করে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। যেন ধীক্কার, তিরস্কার। এ ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীনও হতে হয়েছে আমাকে। সমাজে অনেক ভদ্রবেশী আছেন, যারা নিজেদের সমাজসেবক হিসেবে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে জাহির করছে। আজ তারাই করোনা থেকে মুক্ত হওয়াদের তিরস্কার করছে এবং দূরে সরিয়ে রাখছে যেন আমি এক আতঙ্ক, আমি এক সমাজ ছাড়া মানব। অথচ সরকার কোটি কোটি টাকা করোনার জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। ডান পায়ের ফোঁড়া শুকিয়ে যাচ্ছে, অদ্যাবধি আর মাপা হলো না ডায়াবেটিস। যা নিয়ে আমি তখন খুবই চিন্তিত ছিলাম। এখন অবশ্য চিন্তামুক্ত।

পরিশেষে বলতে চাই, করোনাকে ভয় করো না। এটি একটি ঠান্ডাজনিত ভাইরাস। ডাক্তারদের মতে, আক্রান্তের প্রথম ২৪-৪৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি এটিকে মোকাবেলা করা যায়, তা হলেই বিপদ কেটে যাবে। তবে এ ক্ষেত্রে পরীক্ষা নমুনার জন্য অপেক্ষা না করে জ্বর, সর্দি ইত্যাদি দেখা দিলেই উল্লেখিত ব্যবস্থাগুলো অত্যন্ত দ্রুত গ্রহণ করা উচিত। এর জন্য প্রথম শর্ত হলো, আল্লাহকে ডাকা আর নিজের মনোবল শক্ত রাখা। করোনা মানেই মৃত্যু নয়, করোনা মানেই সচেতনতা ও মনোবল শক্ত রাখা। আর সকল জ্বর, সর্দিই করোনা উপসর্গ নয়। সবাই ভালো থাকুন ও সুস্থ থাকুন। আল্লাহ সকলের সহায় হোন।

লেখক: প্রশাসনিক কর্মকর্তা, জেলা পরিষদ, চাঁদপুর।

এসইউ/এএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।