বাবা, আমাদের সফলতা দেখে যেতে পারলে না!
ফাত্তাহ তানভীর রানা
বাবাকে নিয়ে আমার তেমন কোনো স্মৃতি নেই, তবে অনুভূতি রয়েছে। বাবাকে ধন্যবাদ দিতে পারিনি বা সরিও বলতে পারিনি। কারণ ভালো-মন্দ কিছু বোঝার বয়স হওয়ার আগেই (আমার সাত বছর বয়সে) বাবা হার্ট অ্যাটাক করে চলে যান না ফেরার দেশে।
বাবা আমার দাদার বড় ছেলে ছিলেন; তাই ছোট ভাইদের মানুষ করার দায়িত্ব তিনি কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। আমার একজন কাকা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন, অন্যজন প্যারামেডিক্স চিকিৎসকের চাকরি পেলেন, আরেকজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হলেন। আবার একজন ফুফু গ্রাজুয়েটও হলেন।
আমার চাচা-ফুফুরা সবাই আমাদের বাসায় থাকতেন। তবে এর মাঝে আমাদের বাসায় থেকেও এসএসসি পাস করার পর লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত হলেন আমার মা! আমার বাবা নাটোর গুরুদাসপুরের বিলচলন শহীদ সামসুজ্জোহা কলেজের বোটানি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। সঙ্গত কারণেই তাঁর অগণিত ছাত্র-ছাত্রী ও গুণগ্রাহী ছিল।
আমাদের বাসা ছিল উপজেলা সদরে; সেই সূত্র ধরে আমাদের বাসায় অনেক এসএসসি পরীক্ষার্থী থাকত। আমার বাবা মোহাম্মদ আলী বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথেও যুক্ত ছিলেন। এসব ভালোবাসার মানুষ, পরিবার-পরিজন ছেড়ে আমার বাবা ১৯৯০ সালের জুন মাসে কোনো এক বিকেলে চলে গেলেন নক্ষত্রের ওপারে।
আমরা যখন বড় হচ্ছিলাম, আমাদের বাবার কাছে যখন আমাদের প্রয়োজন শুরু হলো; তখন বাবা পাশে নেই। বাবার শাসন, বাবার আদর, বাবার আর্থিক সাপোর্ট, বাবার বটগাছের মত ছায়া-সবই প্রয়োজন ছিল। বাবার উপস্থিতিসহ সব কিছু থেকে আমরা বঞ্চিত হলাম। হঠাৎ করে কোথা থেকে কী যেন হয়ে গেল!
ছেলের শোকে আমার দাদার শরীরের একাংশ অবশ হয়ে গেল। আমার অসুস্থ দাদিও বিছানায় পড়ে গেলেন। কাকারা নিজ নিজ পরিবার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বাবার বেতন বন্ধ; তাঁর কোনো সঞ্চয় ছিল না, আর সঞ্চয় থাকে কিভাবে? বেসরকারি চাকরি। শুধু নিজের বাড়িখানা ছিল। আর ছিল কয়েক বিঘা পৈতৃক কৃষি জমি।
তখন আমার মায়ের সংগ্রাম শুরু হলো। দিন থেমে থাকেনি; আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে এখন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার। আমার বড় এক বোন চিকিৎসক, তিনি প্রবাসী। আরেক বোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে এখন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক।
আমার মা আমাদের কষ্ট করে মানুষের মত মানুষ করার জন্য সরকারি স্বীকৃতি পেলেন। আমার মা নার্গিস সুলতানাকে মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের ‘জয়িতা অন্বেষণ কার্যক্রম’র আওতায় ২০১৭ সালে রাজশাহী বিভাগের ‘সেরা জয়িতা’ নির্বাচিত করা হয়।
বাবা তুমি ছিলে মানুষ গড়ার কারিগর; তোমার হাতে মানুষ হয়েছেন আমাদের উপজেলার অনেক ছাত্র-ছাত্রী। বাবা তুমি ছিলে আদর্শবান শিক্ষক; আমরা তোমার আদর্শকে বুকে ধারণ করে এগিয়ে চলেছি সামনের পথে। কখনো পিছপা হইনি, কখনো হাল ছাড়িনি, কখনো আশাহত হইনি; তুমিই ছিলে আমাদের অনুপ্রেরণা।
দুঃখ একটাই, তুমি আমাদের এই সফলতা দেখে যেতে পারলে না। এ বছরের ১৮ জুন তোমার মৃত্যুর ত্রিশ বছর পূর্ণ হলো! বাবা, তোমাকে অনেক কথা বলার ছিল; বলা হলো না। বাবা, তোমাকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল; পূরণ হলো না।
লেখক: প্রিন্সিপাল অফিসার, ল’ ডিভিশন, প্রধান কার্যালয়, অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড।
এসইউ/এএ/পিআর