আব্বা আসবেন, তাহলেই না ঈদ!
রাতে ঘুম হয় না, কখন সকাল হবে?
সকাল পর্যন্ত তর সয় না, ফজরের আজানের আগেই দুই ভাই উঠে যাই। গুটিগুটি পায়ে দাদির কাঁথার ভেতর ঢুকে যাই। তারপর ফিসফিস করে বলি, ‘ও বু, উঠবেন না? লঞ্চ তো আইয়া পড়ব?’
বু ঘুম জড়ানো গলায় বলেন, ‘লঞ্চ আইতে এখনও দেরি আছে, অক্ষণ ঘুমা।’
আমরা দুই ভাই ঘুমাই না। বু’র কাঁথার ভেতর ক্রমাগত ঘ্যানঘ্যান করতে থাকি। একসময় বু ওঠেন, অজু করেন, নামাজ পড়েন, আমাদের দুই ভাইকে চাদর দিয়ে মুড়িয়ে নেন। তারপর দুই নাতির হাত ধরে আলো না ফোঁটা সেই ভোরের শিশির ভেজা পথ মাড়িয়ে লঞ্চঘাটের দিকে হাঁটেন। আমরাও হাঁটি। লঞ্চে আব্বা আসবেন, তাহলেই না আজ ঈদ!
কী আনবেন আব্বা?
একটার পর একটা লঞ্চ ভেড়ে ঘাটে, সারিসারি যাত্রীরা পিঁপড়ের মতন ভিড় করে নামে। কিন্তু আব্বা কই? ওই যে, ওই? না, না তাহলে ওই? উঁহু না। তাহলে? আব্বা কি আসবেন না?
আমরা অপেক্ষায় থাকি। নানারকম খেলা খেলি। বাজির খেলা। খানিক দূরে মাটিতে একটা দাগ কেটে লাফ দেই, যদি একলাফে পৌঁছাতে পারি, তাহলে আব্বা আসবেন, না হলে আসবেন না। কিংবা এক থেকে একশ অবধি গোনা পর্যন্ত যদি একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি, তাহলে আব্বা আসবেন, না হলে আসবেন না...
একটা ছোট্ট রেইনট্রি গাছ লঞ্চঘাটে, ঠিক মসজিদের গা ঘেঁষে। সেই গাছ দুই ভাইয়ের মধ্যে কে আগে ছুঁতে পারলে আব্বা আসবেন, আর কে ছুঁতে পারলে আব্বা আসবেন না, আমরা তা ভাবতে থাকি। আর অপেক্ষায় থাকি, আব্বা আসুন। আজ, এক্ষুণি আসুন। এক্ষুণি...
পৃথিবীটা অদ্ভুত এক চক্র। এই চক্রের বৃত্তে জীবনের গল্পগুলো উল্টে পাল্টে একই হয়ে আসে। ঘুরে ফিরে আবার একই সমতলে এসে দাঁড়ায়। কেবল কুশীলব পাল্টে যায়... দীর্ঘ বিরতির পর প্রতিবছর ঈদে বাড়ি যাই। কিন্তু সেই দাদি আর নেই... সেই সেখানে দাদির হাত ধরে অপেক্ষায় থাকা আমরা ছোট ছোট দুটি ভাইও আর সেই লঞ্চঘাটে নেই, অপেক্ষায় নেই... সেই ছোট রেইনট্রি গাছটা কবেই বড় হয়ে গেছে, কেটেকুটে নিয়ে কেউ হয়তো চুলার জ্বালানি কিংবা আস্ত পালঙ্ক বানিয়ে ফেলেছে।
কিছুই আর আগের মত নেই। আসলেই কি নেই?
না, আছে। কেবল সেই অপেক্ষারা আছে। ঠিক সেই অপেক্ষারাই। মানুষগুলোই শুধু বদলে গেছে, কিন্তু অপেক্ষারা বদলায়নি। অপেক্ষারা বদলায় না। ঠিক সেই অপেক্ষার মত করেই এখনো অপেক্ষায় থাকেন অন্য দু’জন মানুষ, অন্য দু’জোড়া চোখ, কী তীব্র তৃষ্ণা নিয়ে, কী ভীষণ অপেক্ষা, ‘তাদের ছেলেরা কখন আসবে? কখন?’
কিন্তু সেই অপেক্ষা আর কাটে না। এক অদ্ভুত দুঃসহ সময় হঠাৎ থমকে দেয় জীবন। দীর্ঘশ্বাসের ভেতর থেকে সেই মানুষগুলো হয়তো অপেক্ষায় থাকেন অন্য কোনো দিনের। এই ধূসর, ক্লান্ত, বিবর্ণ দিন শেষে আলো ঝলমলে দিনের। সেই দিন আসুক। সব ক’টা জানালা খুলে ভোরের আলোর মতো সেইসব দিন আবার আসুক।
আর আলোয় ভাসুক মানুষের মন, ধূসর জীবন, ক্লান্ত ভুবন...
এসইউ/এমএস