আসুন ছিন্নমূল মানুষের পাশে দাঁড়াই

আইরিন রুবিনা হক লিয়া
আইরিন রুবিনা হক লিয়া আইরিন রুবিনা হক লিয়া , শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক
প্রকাশিত: ১২:১৪ পিএম, ০৫ এপ্রিল ২০২০

করোনায় আক্রান্ত বিশ্বের এ কঠিন সময়ে ছিন্নমূল মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এখনই তো সময়। দেশব্যাপী চলমান এ স্থবিরতায় কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষগুলো হঠাৎ কেমন অসহায় হয়ে পড়েছে। কিছু মানুষের অবস্থা এমন যে, করোনার চেয়ে ক্ষুধার ভয় এদের বেশি। ক্ষুধার্ত অবস্থায় হাহাকার করা মানুষগুলো যেন না খেয়ে মারা যায় যায় অবস্থা। এই মানুষের সংখ্যা যত, তার চেয়ে স্বচ্ছল মানুষের সংখ্যাও কম নয়। আমরা সবাই মিলে যদি সত্যিকার অর্থেই চাই, তাহলে এই জনগোষ্ঠীকে আজকের এই বিপদ থেকে বাঁচানো সম্ভব। মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য।

প্রশ্ন জাগতে পারে, বাংলাদেশে নিম্ন আয়ের মানুষের পরিমাণ বা সংখ্যা কত? বিশ্ব ব্যাংকের একটি রিপোর্ট দিচ্ছে ভয়ানক চিত্র, যা দেখে আপনি অবাক হতে পারেন। নিম্ন আয়ের মানুষের সংখ্যা এত বেশি যা আমরা আসলেই জানি না। বিশ্বব্যাংকের ‘দারিদ্র্য ও সমৃদ্ধির অংশীদার-২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রায় ২,৪১,০০,০০০ লোক দৈনিক ৬১.৬০ টাকারও কম আয় করতে পারেন। ৮,৬২,০০,০০০ লোক দৈনিক ৩.২০ ডলার বা ২৭০ টাকার চেয়ে কম আয় করেন। (সূত্র : প্রথম আলো, ২০.০১.২০১৯)।

আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিক্স-বিবিএস) জরিপ অনুযায়ী, দেশের ১৬ কোটি ৪৬ লাখ মানুষের মধ্যে প্রায় সোয়া তিন কোটি মানুষ দারিদ্য সীমার নিচে বাস করে। একই প্রতিষ্ঠানের অন্য এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় পৌনে বিশ লাখ এমন পরিবার রয়েছে; যাদের প্রতিমাসের গড় আয় ৭৪৬ টাকা কিংবা তার চেয়েও কম। (সূত্র : প্রথম আলো, ১৭.১০.২০১৯)।

এই চলমান স্থবিরতায় কর্মহীন হয়ে পড়েছে দেশের নিম্ন আয়ের এই বৃহৎ জনগোষ্ঠী। আপনার আমার একার পক্ষে হয়তো এই সবার দায়িত্ব এককভাবে নেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এই ভেবে কেউ যদি এগিয়ে না আসে, তবে তারা কোথায় যাবে? কে দেবে এই অন্নহীনদের মুখে খাবার তুলে? প্রিয় কবি কাজী নজরুলের কবিতার লাইন মনে পড়ছে– ‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে,/তোমার ছেলে উঠলে মাগো রাত পোহাবে তবে।’ কবিতার লাইনটি হৃদয়োত্থিত করলে চক্ষু অশ্রুসজল হয়ে যায়। হৃদয়ে বিপ্লবের ঝান্ডা ওড়ে। মন মানে না কোন বাধা। মনে হয় নেমে পড়ি এইসব দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াতে। কেন পারব না আমরা। আমরা সব পারি। আমরা মাতৃভাষা বাংলা এনেছি, আমরা মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এনেছি।

তবে কেন এই মহাযুদ্ধ জয় করতে পারব না। আমাদের হয়তো অর্থ-বিভব নেই, নেই অত উন্নত কাঠামো। কিন্তু আমাদের রয়েছে আত্মবিশ্বাস, রয়েছে বিশ্বব্যাপী আলোচিত ও প্রশংসিত দেশপ্রেম। আমাদের রয়েছে ভ্রাতৃত্ববোধ। আমরা চাইলে গড়তে পারি ক্ষুদ্র বাংলায় বিশাল এক শান্তির ধরণী। শুধু একটু স্যাক্রিফাইসই তো। এইটুকু আমরা করতে জানি। আমরা আমাদের ভালোবাসার মানুষদের জন্য সব করতে পারি। আমরা অতীতে যেমন পেরেছি, এবারও পারব ইনশাআল্লাহ।

এদেশের অনেক বিত্তবান হয়তো মনে করেন- এদেশে বুঝি গরিব মানুষ নেই। অনেকে মনে করেন- সভ্যতার উৎকর্ষের এ যুগে ক্ষুধার্ত মানুষ বুঝি আর নেই এদেশে। আরে ভাই, এখনো বাংলাদেশে এমন অনেক পরিবার আছে, যাদের ঘরে কূপি-বাতি নিভু নিভু করে। এখনো অনেক পরিবার আছে, যাদের ঘরের উপার্জনশীল ব্যাক্তিটি কাজে না গেলে ওইদিন ঘরের জন্য সামান্য চাল-ডাল কেনার সুযোগ মেলে না। ঘরের উনুনে আগুন জ্বলে না দু’বেলা। আপনি যদি চারপাশের দালান-কোঠা, প্রাসাদ দেখে, ব্যাঙের ছাতার মতো জেগে ওঠা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট আর ফাস্টফুডের দোকান দেখে, স্যুট-টাই পরা মানুষ দেখে সমাজকে মূল্যায়ন করেন এভাবে যে, সমাজে গরিব মানুষ নেই, দেশে কোন অভাবী, অসহায় লোক নেই, নেই কোন ছিন্নমূল ঘরহারা মানুষ, তাহলে তো ভুল করবেন।

পেটে পাথর বেঁধে ক্ষুধার অস্ফুট হাহাকার আর অব্যক্ত যন্ত্রণা নিয়ে দিনের পর দিন পার করেন এমন অনেক অভিমানী দরিদ্র মানুষও সামজে আছে। শুধু একটা রুটি খেয়ে সমগ্র দিন পার করা মানুষগুলোও কোনরকমে জীবন কাটিয়ে দেয় কোন অভিযোগ ছাড়াই, এমন অনেক পরিবার ও কিছু সৎ মানুষ আমাদের দেশে আছে, যার বা যাদের খবর আলোচনায় আসে না। কষ্ট নিয়েও এরা সততার সাথে কাজ করেন, কোন কিছুই নেই অথচ হাত পাতবে না জীবন গেলেও-এমন উচ্চমাত্রার ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষও আছে এই সামজে, চাল নেই, চুলো নেই অথচ পারসোনালিটি আকাশচুম্বী, শেখার মতো, মানুষকে হেল্প করার জন্য এইমানুষগুলোই এগিয়ে আসে সবার আগে, অনেক সময় নিজের জীবন বিপন্ন করেও এরা আমাদের প্রয়োজনে এগিয়ে আসে। অসহায় এই মানুষগুলোকে আমরা বড়ই তাচ্ছিল্যের চোখে দেখি, অথচ এরা না থাকলে আমাদের জীবনে হয়তো কমফোর্ট জোন থাকতো না। আমাদের জীবনে কমফোর্ট এনে দেওয়ার এইসব কুশীলবরা হাসিমুখে স্যাক্রিফাইস করে নিজের জীবনের কমফোর্টকে।

দেশপ্রম আর মানুষের প্রতি ভালোবাসার প্রত্যয়দীপ্ত অঙ্গীকার নিয়ে গোটা দেশের আপামর সাধারণ ও অসাধারণ জনগোষ্ঠীর কাছে আমি একজন অপাঙক্তেয় ও নগণ্য মানুষ হিসাবে বিনম্র চিত্তে সবিনয় মিনতি করছি- আসুন ছিন্নমূল এইসব মানুষের পাশে দাঁড়াই। আমরা সবাই মিলে কাজ করি। যার পক্ষে যতটুকু সম্ভব। যার যার সাধ্যমতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেই। একটা পরিবারের একসপ্তাহের খাবার কিনে দেওয়ার সামর্থ আমার, আপনার অনেকেরই আছে। শুধু দরকার একটু মানসিকতা। একটু সদিচ্ছাই এনে দিতে পারে ভালোবাসাপূর্ণ একটি জাতি গড়ে তুলতে। আপনার-আমার একটু সদিচ্ছাই পারে ক্ষুধার্ত ও অনাহারীমুক্ত একটি স্বচ্ছল ও উচ্ছ্বল বাংলাদেশ গড়তে।

chinnomul-in

এ মহাযুদ্ধে সবচেয়ে বড় বিপাকে পড়েছে ঐসব মানুষ, যারা গরিব অথচ সমাজ কিংবা লোকলজ্জার ভয়ে সাহায্য নিতে যায় না। একসময় স্বচ্ছল ছিল অথচ ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে এখন নিম্ন আয়ের মানুষ, ছোট কাজ করে কিংবা ডেইলি বেসিস কন্ট্রাক্চুয়াল কাজ করে অথচ এখন কাজ নেই, রোজগার নেই, বসে বসে খাবার সামর্থও নেই। আবার লোকলজ্জার ভয়ে সাহায্য নিতে ও যায় না। আমরা যেন এমন লোকজনদের শনাক্ত করে তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাহায্য পৌঁছে দেই।

দুটো ঘটনা থমকে দিয়েছে বিশ্বের মানুষকে। বিশ্ব আজ চোখ মেলে দেখছে পৃথিবীর রেষারেষি, হিংসার কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি, আধিপত্যবাদের লড়াইয়ের দিন হয়তো শেষ হয়ে আসছে। এই ভয়ংকর করোনাভাইরাস বাঘে-মহিষে একঘাটে জল খাওয়াতে শিখিয়েছে এবং এক ছাতার নিচে দাঁড় করিয়েছে গোটা বিশ্বকে। প্রকৃতি শিখিয়েছে কিভাবে মানবতার জয়গান গাইতে হয়। প্রকৃতি দেখিয়ে দিয়েছে এ পৃথিবীর মানুষকে যে, সারা দুনিয়া এক স্রষ্টার সৃষ্টি এবং একটা কন্ট্রোলপ্যানেল থেকেই পরিচালিত।

এক. ইতালির এই ভয়াবহ মহামারীতে মেডিক্যাল মাস্ক সরবরাহ করছে করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল এবং সর্বপ্রথম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ চীন। সেই মাস্কের বাক্সের উপর লেখা একটি রোমান কবিতার চরণ যার বাংলা অনুবাদ হলো- ‘দিন শেষে আমরা তো একই সাগরের ঢেউ’। চিন্তা করলে গা শিউড়ে ওঠে। কী লোমহর্ষক একটি লাইন। এর মর্মার্থ আসলেই বিশ্ববাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে।

দুই.
সর্বপ্রথম চীনে যখন করোনায় আক্রান্ত হয় উহানবাসী, তখন জাপান তাদেরকে সুরক্ষা সরঞ্জামাদি সাহায্য হিসাবে পাঠায়। সেই সাহায্যের বাক্সের উপর চাইনিজ ভাষায় লেখা ছিল এমন একটি লাইন যার বাংলা অনুবাদটি ঠিক এইরকম- ‘নদী আর সাগরের দিক থেকে আমরা হয়তো আলাদা, কিন্তু একই আকাশ, সূর্য, আর চাঁদের আলোর নিচে আমাদের বসবাস।’

উপরের দুটো লাইন একই ইঙ্গিত বহন করে, যা বিশ্ববাসীর জন্য শিক্ষা। এক পৃথিবীর একই আকাশ, বাতাস, চন্দ্র, সূর্যের মোহনায় বাস করা মানুষ আমরা, তবে কেন এত বৈষম্য মানুষে মানুষে?

আসুন আমরা আপাতত আমাদের দেশটা নিয়ে ভাবি, দেশের মানুষকে নিয়ে ভাবি। সাধারণ গরিব মানুষগুলোর কথা একটু ভাবি। আমরা সবাই যদি আমাদের নিকটস্থ, আশেপাশের পরিচিত গরিব, দুঃখী, ছিন্নমূল মানুষগুলোর একটু খোঁজ-খবর রাখি, একটু সাহায্য পাঠাই, হতে পারে এটাই তাদের অন্নহীন মুখে খাবারের জোগান। আনতে পারে ক্লান্ত পেরেশান চোখেমুখে ভুবন ভোলানো হাসি। আশার বাণী এই যে, বাংলাদেশ সরকার তাদের স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে এবং জনপ্রতিনিধিগণের মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক খাদ্যদ্রব্য ও আর্থিক সাহায্য ছিন্নমূল জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাছাড়া সমাজহিতৈষী বিত্তবানরা কাজ করে যাচ্ছেন।

তবে তা সব মানুষের দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছতেছে না। এটা হয়তো তাদের দোষ না। তথ্যের অভাবে অনেক জায়গায় ত্রাণ যাচ্ছে না। যেখান থেকেই খবর আসতেছে, সঙ্গে সঙ্গে ছুটছেন সরকারের জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসনের লোকজনেরা। আমাদের দায়িত্ব হবে তাদের সাথে সমন্বয় সাধন করে প্রান্তিক পর্যায়ের ছিন্নমূল ও অসহায় এইসব জনগোষ্ঠীর সাথে স্থানীয় প্রশাসনের ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করে দেওয়া। সেইসাথে আমাদের অত্যাবশ্যকীয় দায়িত্ব, সরকারের সাহায্যের উপর একক ভাবে নির্ভরশীল না থেকে নিজেরা যার যার সাধ্যমত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া ও অন্যকে এ কাজে উৎসাহিত করা। নিজ উদ্যোগে খোঁজ নিয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, প্রয়োজনীয় সুরক্ষা নিয়ে অসহায় ছিন্নমূল মানুষদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাহায্য ও প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া। যে যতটুকু পারি, যার যা সামর্থ আছে, অন্তত ততটুকু নিয়ে হলেও মানুষের পাশে দাঁড়াই। একটু হলেও তো সাহায্য হবে এই অসহায় জীবনে ও ক্রান্তিলগ্নে।

ভালোবাসার জয় হোক, জয় হোক মানবতার, জয় হোক আমাদের দেশপ্রেমের। স্বপ্নসারথী হয়ে পাশে দাঁড়াই দুঃখী মানুষের। হৃদয়ের ঐকতানে গাঢ় অগ্নিশিখা ও ম্রীয়মান হতে থাকে। ভালোবাসার মানুষগুলোর মুখে হাসি ফুটানোর কী যে আনন্দ তা কেবলই অনুমেয়। প্রকাশে অক্ষম কিছু অনুভুতি বুঝি এমনই হয়! আমাদের হৃদ্যতায় এমন দিন আসুক, যেদিন বিজয়ের করতালি দেবে অসংখ্য দূতপরী। ইথারে আর ভেসে আসবে না কান্নার মিহি সুর। রোজ ভোরে আর মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে শুনব না একটি শোক সংবাদ, একটি মৃত্যু সংবাদ। রোজ সকালে জেগে উঠে যেন অনুভব করি, ভুবন ডাঙ্গার উদাসী শিহরণ। ভোরের আলোয় উদ্ভাসিত হোক নবযৌবনে ফিরে পাওয়া জীবনের জয়গান গাওয়া মানুষের কলতান। সংগ্রামী জীবনের অণুবচন হোক আরও বেশি অনুজ্ঞাময়। মহাশ্মশানে রূপান্তরিত এ ধরিত্রিতে বেজে উঠুক ফের তৃপ্তি ও স্বস্তির অনুনাদ।

জীবন যুদ্ধে পরাজিত ফসিলগুলো পুনর্জীবন ফিরে পাক মহাকালের অনন্ত যাত্রায় মহিমান্বিত মানব রূপে। হিংসা আর বৈষম্য নিপাত যাক। ভালোবাসা জিন্দাবাদ।

এসইউ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।