চৈত্র সংক্রান্তিতে যেসব উৎসব পালিত হয়
বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিন ‘চৈত্র সংক্রান্তি’। যেহেতু বৈশাখকে আমরা বছর শুরুর মাস গুনি; সেহেতু চৈত্র সংক্রান্তি বা চৈত্র মাসের শেষ দিন অতিক্রান্ত হলে একটি বঙ্গাব্দের সমাপ্তি ঘটবে। এই চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে বাংলাদেশে প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে নানা অনুষ্ঠান-পূজা-পার্বণ-মেলা। এটি একটি লোক উৎসব।
চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেসব অনুষ্ঠান সম্পর্কে জানাতেই আজকের আয়োজন। আসুন জেনে নেই দেশজুড়ে চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে কী কী উৎসব পালিত হয়।
চড়ক পূজা: চৈত্র সংক্রান্তির পূর্ণ লগ্নে শিব ও কালীর মিলন হয় বলে বৃহত্তর আঙ্গিকে পূজার আয়োজনে ব্যস্ত থাকে ভক্তবৃন্দ। দম্পতির সন্তান প্রাপ্তি, দূরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি লাভ ও মনের বাসনা পূরণের আশায় প্রতি বছর খুলনায় চড়ক পূজা অনুষ্ঠিত হয়। শিবের এক নাম মঙ্গলেশ্বর। তাই বলা হয় ‘যত্র জীব তত্র শিব’ অর্থাৎ যেখানে জীব সেখানে শিব। এ পৃথিবী ক্ষেত্র বা প্রকৃতি রূপে কালী আর ক্ষেত্রের অধিপতি শিব। চড়ক পূজা হচ্ছে শিব ও কালীর প্রতীক। দেশের অনেক জায়গায় খুলনার মতো উদযাপিত হয় এ উৎসব।
> আরও পড়ুন- ঘরে বসে তৈরি করুন দোলের রং
খেজুর ভাঙ্গা: খুলনায় চড়ক পূজার সাথে সাথে খেজুর ভাঙ্গা উৎসবও পালিত হয়। সেদিন সন্ন্যাসীরা মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিব-গৌরী নিত্যগীতি সহকারে মাগন করে। চড়ক পূজা পর্যন্ত তারা পবিত্রতার সাথে সন্ন্যাস ব্রত পালন করে এবং নিরামিষ খাদ্য ভক্ষণ করে। পূজার লগ্নে সারাদিন উপবাস পালন করে। পরে সন্ন্যাসিরা কাটাযুক্ত খেজুর গাছ থেকে খেজুর ভেঙে ভক্তদের মাঝে বিলাতে থাকেন। যে খেজুর খেয়ে উপোস ভঙ্গ করেন ভক্তরা।
শরবত: ঢাকায় নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা, আড্ডা এবং শস্য প্রবর্তনার আয়োজনে এবার থাকছে সকাল থেকে ছাতু, চিড়া, দই, মুড়ি, খই, তিল ও নারিকেলের নাড়ু ইত্যাদি এবং নানান ধরনের শরবত। দুপুরের খাবারে চৌদ্দ রকমের শাক, ডাল, সবজি ও লাল-সাদা চালের ভাত। এই দিন কোন মাছ-মাংস রান্না হবে না।
শাকান্ন: টাঙ্গাইলে নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকরা তাদের গ্রাম থেকে শাক কুড়িয়ে আনবেন এবং রিদয়পুর বিদ্যাঘরে সব্জি, ডাল ইত্যাদি নানা রকম রান্না করবেন। তার পাশাপাশি তারা গ্রামে প্রাণবৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা ও নিরাপদ খাদ্য নিয়ে আলোচনা করবেন। নবপ্রাণ আন্দোলনের শিল্পীরা দেশের বিভিন্ন সাধকদের গান, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, লালন সাঁইয়ের গান পরিবেশন করবেন। সাথে থাকবে নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকদের গান।
> আরও পড়ুন- গ্রামীণ খেলাধুলায় মেতেছিল যাদুখালী
শাক কুড়ানো: বাংলার কৃষক নারী চৈত্র সংক্রান্তিতে ঘরের পাশে মাঠের আনাচে-কানাচে শাক কুড়াতে বের হয়। নিয়ম আছে, তাকে চৌদ্দ রকম শাক কুড়াতে হবে। আবাদী নয় কিন্তু, অনাবাদী; অর্থাৎ রাস্তার ধারে, ক্ষেতের আইলে, চকে আপনজালা শাক তুলতে হয়।
নীল উৎসব: লাল কাপড় অথবা পাগড়ি বাঁধা মাথায়। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে ত্রিশূল। সঙ্গে ঢাক-ঢোল, করতাল ও কাসার বাদ্য। বাহারি সাজে শিব-পার্বতী ওহনু (পাগল সাধু)। নীলকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে বাড়িতে ছুটবে দলপতি (বালা)। হিন্দু বাড়ির উঠানে আল্পনা দিয়ে কেউ বা উঠান লেপন করে তাতে বসাচ্ছে নীলকে। এরপর শুরু নীল নাচ ও শিবের গাজন (গান)। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় এভাবেই নীল উৎসব পালিত হয়।
নীল পূজা: ‘নীল পূজা’ বা নীলষষ্ঠী হলো বাংলার হিন্দুসমাজের এক লৌকিক উৎসব, যা মূলত শিব-দুর্গার বিবাহ বা শিবের বিয়ে নামে পরিচিত। সাধারণত চৈত্র সংক্রান্তি চড়ক উৎসবের আগের দিন এ নীলপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এ ঐতিহ্যবাহী উৎসব পালনের পর অনুষ্ঠিত হয় চৈত্র সংক্রান্তি মেলা। তবে উৎসবটি বিলুপ্ত হতে চলেছে।
> আরও পড়ুন- বসন্তের রঙে ভালোবাসা
বিজু বা বৈসাবি উৎসব: চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে বাংলাদেশের বিভিন্ন আদিবাসীর মাঝে প্রচলিত রয়েছে নানা উৎসব ও অনুষ্ঠান। পার্বত্য চট্টগ্রামে বছরের শেষ দিন তারা বিজু বা বৈসাবি উৎসব পালন করে। তখন প্রতিটি বাড়িতেই নানা স্বাদের খাবার তৈরি হয়। তাদের ধারণা, সবরকম খাবার খেয়ে বিলিয়ে বর্ষ বিদায় করা পূণ্যের কাজ। এদিন তরুণ-তরুণীরা নদী থেকে জল এনে বাড়ির বয়স্কদের স্নান করিয়ে দেয়, আশীর্বাদ গ্রহণ করে। সদ্য বিবাহিত বর-কনেরা বেড়াতে যায় বাপের বাড়ি। কিংবা শ্বশুরবাড়ি। নতুন বছরকে সুন্দর করে বরণ করার জন্য সব বাড়ি মেরামত করে। জুম চাষের প্রস্তুতি হিসেবেই এ উৎসব। চৈত্রের শেষ দিনে ধর্ম অনুষ্ঠানে মিলিত হয় সবাই। নাচে, গানে ও নানা অনুষ্ঠানে মেতে ওঠে।
গম্ভীরা পূজা: চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে উত্তরাঞ্চলের অনেক স্থানে, বিশেষ করে রাজশাহী অঞ্চলে গম্ভীরাপূজা বা শিবের গাজন অনুষ্ঠিত হয়। এ উপলক্ষে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে। দিনাজপুর জেলার বিরামপুরে তিনশ’ বছরের বেশি সময় ধরে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এ মেলায় বাঁশ, বেত, কাঠ, মাটি ও ধাতুর তৈরি বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র ও খেলনা, বিভিন্ন রকমের ফল-ফলাদি ও মিষ্টি-মিষ্টান্ন ক্রয়-বিক্রয় হয়। এছাড়া যাত্রা, সার্কাস, বায়োস্কোপ, পুতুলনাচ, ঘুড়ি ওড়ানো ইত্যাদি চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা থাকে।
এসইউ/জেআইএম