বৈশাখে মৃৎশিল্পীদের ব্যস্ততা
আর ক’দিন পরই পহেলা বৈশাখ। বৈশাখ এলেই ব্যস্ত সময় পার করেন মৃৎশিল্পের কারিগররা। যদিও আধুনিকতার ছোঁয়ায় মৃৎশিল্প প্রায় বিলুপ্তির পথে, কিন্তু বংশ পরম্পরায় এবং জীবিকা নির্বাহের তাগিদে অনেকেই এখনো মৃৎশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে মৃৎশিল্প পল্লি ঘুরে এসে লিখেছেন রিফাত কান্তি সেন-
আসছে বৈশাখ। মাঝে মাঝে বৈশাখি ঝড়ের তাণ্ডব জানান দিচ্ছে ক’দিন পরই বৈশাখ মাস শুরু হবে। পহেলা বৈশাখকে ঘিরে বাঙালির আনন্দ-উল্লাসের কমতি নেই। তেমনি এই বৈশাখ এলেই ব্যস্ততার ধুম পড়ে মৃৎশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকদের মাঝেও। তেমনই এক মৃৎশিল্পের পল্লি ফরিদগঞ্জের পাইকপাড়া গ্রামের কুমার বাড়ি। এ বাড়ির বেশিরভাগ মানুষই মাটির তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছে। হাড়ি, পাতিল, খোড়া, বাটিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন মাটির তৈরি সামগ্রী তৈরি করেন তারা।
পাশাপাশি বৈশাখ এলেই খেলনা তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটান তারা। বিশেষ করে মাটির তৈরি পুতুল, ঘোড়া, হাতি, ময়ূর, খেলনা, থালা-বাসন, মাছসহ বিভিন্ন প্রকার মাটির সামগ্রী নিপূণভাবে তৈরি করে থাকেন। মনের মাধুরী মিশিয়ে ফুটিয়ে তোলেন চমৎকার সব নিদর্শন। বৈশাখ এলে তাদের মাটির তৈরি সামগ্রী বানানোর ধুম পড়ে। এসময়টাতে তাদের তৈরি এসব জিনিস বাজারে বেশি বিক্রি হয়।
তবে দিন যত যাচ্ছে; মানুষ ততই বিলাসিতার পথে হাঁটছে। আধুনিকতাকে সঙ্গী করে এখন মাটির বদলে প্লাস্টিকের তৈরি জিনিসপত্রই বেশি ব্যবহার করছে। একসময় যে মাটির তৈরি জিনিসপত্র ছিল একমাত্র অবলম্বন; এখন সেখানে প্লাস্টিকের তৈরি জিনিসপত্রকে স্বাগত জানাচ্ছে। এ অবস্থায় হয়তো ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প একদিন হারাতে বসবো আমরা।
বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ এলেই এখন শুধু কারিগরদের দেখা যায়। এছাড়া তেমন একটা খোঁজ পাওয়া যায় না মৃৎশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজনের। বাপ-দাদার পেশাকে টিকিয়ে রাখতে এখন কেউ কেউ এ পেশার সঙ্গে জড়িত। বেচাকেনা কম বিধায় অনেকেই এ কাজ করতে অনাগ্রহ প্রকাশ করছে। অনেকেই তাদের ছেলে-মেয়েকে এ পেশায় আনতে নিরুৎসাহিত করছে। আর এর মূল কারণ বেচা-বিক্রি কম। মানুষ এখন মাটির তৈরি জিনিসের চেয়ে মেলামাইন, প্লাস্টিককে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে।
নিমাই পাল একজন মৃৎশিল্পের কারিগর। দিন-রাত পরিশ্রম করে তৈরি করছেন মাটির তৈরি বিভিন্ন খেলনা সামগ্রী। বৈশাখি মেলাকে কেন্দ্র করেই তাদের এ ব্যস্ততা। সঙ্গী হয়েছেন স্ত্রী রানী বালা পাল ও ছেলের স্ত্রী মিতা রানী পাল। নিমাই পাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের বাড়ির বেশিরভাগ লোকই মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত। একসময় মাটির তৈরি এসব জিনিসের চাহিদা থাকলেও আধুনিকতার মারপ্যাঁচে মানুষ এখন আর এসবের দিকে ঝুঁকছেন না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন আমরা মৌসুমী কারিগর হয়ে গেছি। বাপ-দাদার ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে মাটির তৈরি এসব বানাচ্ছি। আমাদের পরের প্রজন্ম এ কাজ শেখেনি। হয়তো আমাদের পর এ শিল্প আর টিকে না-ও থাকতে পারে।’
আর্থিক সংকটেও এ কাজ থেকে মুখ ফেরাচ্ছেন অনেকে। তবে সরকারি সুযোগ-সুবিধা আরো বেশি পেলে অনেকেই এ কাজে আগ্রহী হয়ে উঠতেন। বিশেষ করে চৈত্রের শেষেই কাজের ধুম পড়ে। এছাড়া বাকি মাসগুলোতে তেমন একটি বেচাকেনার মুখ দেখেন না। অভাব-অনটনের কারণে তাই তাদের পরবর্তী প্রজন্মও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন এ শিল্প থেকে।
সবশেষে কথা হয় রেনু বালা পালের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে দুর্বিষহ কষ্টে দিনাতিপাত করছি। সবসময় এসব মাটির তৈরি সামগ্রী বিক্রি হয় না বলে কষ্টে চলে সংসার।’ তাই আমরা চাই- সুদিন ফিরে আসুক মৃৎশিল্পের। বেঁচে থাকুক মাটির মানুষ। ঐতিহ্যবাহী এই পেশা টিকে থাকুক যুগের পর যুগ।
এসইউ/জেআইএম