আত্মবিশ্বাস বাড়াতে যা প্রয়োজন

সাদাত হোসাইন
সাদাত হোসাইন সাদাত হোসাইন , লেখক, উপস্থাপক ও নির্মাতা
প্রকাশিত: ০৭:১২ এএম, ১৭ অক্টোবর ২০১৭

‘আমিই সেরা’- ভাবনাটি কেন দরকার? আত্মবিশ্বাস বাড়াতে? কে জানে? অনেকেই বলেন, আত্মবিশ্বাস বাড়াতে ‘আমিই সেরা’ ভাবনাটি না কি খুব দরকার! টেলিভিশনে এমন অনেক বিজ্ঞাপনেও দেখেছি, সেখানে কী সুন্দর গমগমে আকর্ষণীয় গলায় বলা হচ্ছে, ‘ভাবো, তুমিই সেরা, তাহলে একদিন দেখবে, তুমিই সেরা!’

কিন্তু আমার কেন যেন মনে হয়, ‘আমিই সেরা’ ভাবনাটি মাথায় ঢোকা মানেই আমার ভেতরে যদি কোন ‘সেরা আমি’ থেকেও থাকি, সেই ‘সেরা আমি’কে বরং শেষ করে দেওয়া! সেটি যেকোন পরিসরেই হোক, সেটা ক্ষুদ্র হোক বা বৃহৎই হোক, নিজেকে সেরা ভাবছেন তো গেছেন! গেছেন মানে পুরোপুরি গেছেন।

sadat

একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করি- ৭৬ বছর বয়সী কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদীর ইন্টারভিউ করছি। সেই ইন্টারভিউয়ের একটি অংশে তিনি তাঁর জীবনের গল্প বললেন। সেই গল্পের এক জায়গায় বললেন, ১৯৫৮ সালে উপমহাদেশের বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী তালাত মাহমুদের সামনে তাকে গান গাইতে বলা হয়েছে, শুনে তিনি হকচকিয়ে গেলেন। কম্পিত এবং বিনয়ী গলায় বললেন, ‘স্যার, আমি তো গানের কিছুই জানি না। কিছুই না। আমি কী করে গান গাইব! তা-ও আপনার সামনে!’

তখন তার বয়স কত? আঠারো বা উনিশ? এর প্রায় ৫৮ বছর পর ৭৬ বছর বয়সের সৈয়দ আব্দুল হাদীকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যার, এই যে এত বছর ধরে এত গান গেয়েছেন, কী মনে হচ্ছে? এই এত এত অর্জন, এত এত প্রাপ্তি, কিন্তু জীবনে কি গান নিয়ে কোন আক্ষেপ রয়েছে?’
তিনি বললেন, হু, আছে।
আমি অবাক গলায় বললাম, কি?
তিনি বললেন, এখনও গানটাই ঠিকমতো গাইতে পারলাম না। এখনও গানের কিছুই জানা হলো না। জীবনভর এত চেষ্টা করেছি, গানটা শেখার, জানার, বোঝার, কিন্তু এখনও সেই গানের কিছুই জানি না। কিছুই জানা হলো না! এই আক্ষেপ বড় পোড়ায়!
আমি অনেকক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসেছিলাম, কী বলছেন তিনি! কী বলছেন!

sadat

আজকাল আমরা একটি জনপ্রিয় গান গেয়ে, নাটক বানিয়ে, বই লিখে, ইভেন স্কুল ম্যাগাজিনে ছড়া লিখে, ইউটিউবে দু-চারখানা ভিডিও বানিয়ে, ফেসবুকে ক’লাইন স্ট্যাটাস লিখেই, শ’খানেক লাইক কমেন্ট পেয়েই ভাবতে শুরু করি, ‘আহা, আমি কী মহান প্রতিভাবান! আহা আমিই সেরা! এ-ও-সে কী বোঝে?’

আমি, আমি, আমিই সেরা! এর কারণ কী? এর কারণ, আমাদের কাছে ‘সেরা’র মানদণ্ড ওই পর্যন্তই। শ্রেষ্ঠত্বের সর্বোচ্চ স্তর ওইটুকুই! কিন্তু সেরা আসলে কি? সত্যিকারের সেরা?

সত্যিকারের সেরা হলেন ওই সৈয়দ আব্দুল হাদীরা, যাদের বুকের ভেতরে অফুরন্ত ক্ষুধা। সেই ক্ষুধা উদ্ধত হওয়ার ক্ষুধা নয়, আমিত্বের ক্ষুধা নয়। ‘আমি সেরা’, ‘আমিই শ্রেষ্ঠ’- এ ভাবনায় তৃপ্তির ঢেকুর গেলা নয়, আমি ছাড়া বাকি সব নস্যি বলার, ভাবার ঔদ্ধত্য নয়। বরং সেখানে ক্ষুধা, সেই ক্ষুধা আরও জানার, শেখার, বিনয়ী হওয়ার, নত হওয়ার, নিজেকে আরও সমর্পিত করে দেওয়ার।

sadat

কিন্তু আমরা ভুলে যাই, যেই মুহূর্তে ওই ‘আমিই সেরা’র ভাবনাটা মাথায় এলো, ঠিক সেই মুহূর্তেই ওই ক্ষুধাটা শেষ হয়ে গেল। ওই মুহূর্তেই সৃষ্টির ক্ষুধার চেয়ে বড় হয়ে গেল, আমিত্ব ভাবনার ক্ষুধা। কে আমাকে নিয়ে কী ভাবছে! কাকে নিয়ে আমি কী ভাবব! কে আমার সাথে কী আচরণ করল! বড় ভাবল না ছোট ভাবল! কাকে আমি কতটুকু বড়-ছোট ভেবে কী ধরনের আচরণ করব! এসব সমীকরণের আনাগোনা শুরু হলো। এ ভাবনারা আসলে ঘূণপোকা হয়ে যায়। অমিত সম্ভাবনাময় একটি মানুষকে মুহূর্তেই করে ফেলে নিঃশেষ। একটি বিশাল সম্ভাবনাময় বটবৃক্ষকে করে ফেলে ঘরের কোণে সাজিয়ে রাখা ছোট্ট বনসাই!

sadat

এজন্যই ‘আমি সেরা না’, বরং প্রবল বিনয় আর ক্ষুধা বুকের ভেতর পুষে রেখে, আমি একদিন ‘সেরা হব’ ভাবনাটিই হয়তো কোন একদিন তাকে সত্যি সত্যি বিশাল বিস্তৃত ছায়াদায়ী বৃক্ষের মতন করে ছড়িয়ে দেবে আকাশে আকাশে। আমি একদিন ‘সেরা হব’র ভেতর যা থাকে তার নাম প্রতিজ্ঞা, ইচ্ছে, সংকল্প, স্বপ্ন। আর এই স্বপ্নের কোন শেষ নেই, কারণ সেরার কোন শেষ নেই। সুতরাং আরও ভালো করার ক্ষুধা রয়ে যাবে জীবনের শেষদিন অবধি। আমি ‘সেরা’র চেয়ে তাই আমি একদিন ‘সেরা হব’ ভাবনাটি অনেক বেশি জরুরি। অনেক বেশি। তবে যদি সেই ভাবনাকে আগলে রাখতে পারে বিনয়, প্রবল বিনয়।

কারণ, জগতে সৃষ্টিতে বিনয়ের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কিছু নেই।

এসইউ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।