ঈদ সালামি থেকে ঈদী: সংস্কৃতির বিবর্তন

ঈদ মানেই খুশি, নতুন পোশাক, মজার খাবার আর সবচেয়ে মজার বিষয় সালামি। ঈদের দিনে বড়রা ছোটদের হাতে যে উপহার বা নগদ টাকা দেন, সেটাই ঈদ সালামি নামে পরিচিত। এই প্রথার শেকড় ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের মাঝে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে আমরা যেটা ‘ঈদ সালামি’ বলি, সেটাই মূলত মধ্যপ্রাচ্যে ‘ঈদিয়া’ বা ‘ঈদী’ নামে পরিচিত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশেও এই ‘ঈদী’ শব্দটা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
ঈদ উৎসব ইসলামি ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রাচীন আরব সমাজে ঈদের দিনে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের মাঝে উপহার দেওয়া হতো। সময়ের সাথে এই প্রথা আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায়, উপহার দেওয়ার পরিবর্তে নগদ টাকা দেওয়ার রীতি চালু হয়, যা পরে ‘সালামি’ নামে পরিচিতি পায়।
বাংলাদেশে ঈদ সালামী সম্ভবত মুঘল আমলে জনপ্রিয়তা পায়। তখন সম্রাটরা প্রজাদের মাঝে দান-খয়রাত করতেন এবং ছোটদের জন্য উপহার বরাদ্দ রাখতেন। ব্রিটিশ শাসনামল ও পরবর্তী সময়ে এটি আরও ব্যক্তিগত রূপ নেয়, যেখানে পরিবার-পরিজন এবং প্রতিবেশীরা ছোটদের আনন্দ দিতে সালামি দিতেন।
‘ঈদ সালামি’ শব্দটি মূলত আমাদের উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী প্রচলন। সালামী শব্দটি এসেছে আরবি ‘সালাম’ থেকে, যার অর্থ হলো শান্তি বা শুভেচ্ছা। বড়রা ছোটদের টাকা বা উপহার দিয়ে শুভকামনা জানান তাই একে সালামী বলা হয়।
অন্যদিকে, ‘ঈদী’ শব্দটি এসেছে আরবি ভাষা থেকে, যার অর্থ ‘ঈদের উপহার’। মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতারসহ অনেক দেশেই এই ‘ঈদী’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। প্রবাসীদের মাধ্যমে এই শব্দটি বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের সংস্কৃতিতেও ধীরে ধীরে ঢুকে পড়েছে।
আজকাল আমাদের তরুণ প্রজন্মও ‘সালামি’র বদলে ‘ঈদী’ শব্দটি বেশি ব্যবহার করতে শুরু করেছে। ‘ঈদী’ শব্দটি জনপ্রিয়তা পাওয়ার অন্যতম কারণ প্রবাসী সংস্কৃতির প্রভাব, সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকা, নতুন প্রজন্মের ট্রেন্ড আর বৈশ্বিক শব্দ।
মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করা প্রবাসীরা দেশে ফেরার সময় তাদের ছোটদের ‘ঈদী’ বলে উপহার দিতে শুরু করেন। ‘ঈদ সালামী’ শব্দটিকে অনেক তরুণ একটু সেকেলে ভাবছেন, তাই ‘ঈদী’ শব্দটিকে আধুনিক ও স্টাইলিশ মনে করে ব্যবহার করছেন। ‘ঈদী’ শব্দটি শুধু উপমহাদেশ নয়, অনেক দেশের মুসলিম সংস্কৃতির অংশ। বৈশ্বিক পরিসরে ব্যবহারের দরুন এই শব্দের ব্যবহার দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। পাশাপাশি ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ‘ঈদী’ শব্দের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে, তরুণ প্রজন্ম এটিকে বেশি গ্রহণ করছে।
সালামি কিংবা ঈদী, দিনশেষে উদ্দেশ্য কিন্তু এক, আনন্দ ভাগ করে নেওয়া। বড়রা ছোটদের ভালোবাসা, আশীর্বাদ ও খুশির অংশীদার করতে উপহার দেন। যে নামেই ডাকি না কেন, এই উপহারের চেতনা কখনও বদলায় না। ছোটদের জন্য নতুন জামার মতোই ঈদী পাওয়া এক আলাদা আনন্দ। ঈদ সালামী বড়দের ভালোবাসা, স্নেহ আর ছোটদের আনন্দের উৎস। সময়ের পরিবর্তনে এর রূপ বদলালেও, এর আসল উদ্দেশ্য ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেওয়া সেটাই রয়ে গেছে। ঈদ সালামি সব সময়ই ছোটদের মুখে হাসি ফোটানোর সবচেয়ে প্রিয় উপায় হয়ে থাকবে। সালামি বড়দের দেওয়া এক অমূল্য স্মৃতি হয়ে থাকে। ‘ঈদ সালামি’ বা ‘ঈদী’ নামটা বদলালেও আমাদের সংস্কৃতির আনন্দ-উচ্ছ্বাসে কোনো কমতি নেই।
লেখক: তানজিদ শুভ্র (শিক্ষার্থী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়)
জেএস/জেআইএম