স্বাধীনতার ৫৫ বছর: এক সংগ্রামী অভিযাত্রা

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:৩৬ পিএম, ২৬ মার্চ ২০২৫
ছবি: সংগৃহীত

সানজানা রহমান যুথী
২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় বাঙালির মুক্তির লড়াই, যা ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জন করে। ৫৫ বছর পেরিয়ে আজ আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণযুগে প্রবেশ করেছি। তবে এ অর্জন একদিনে আসেনি; এর পেছনে রয়েছে শত শত বছরের প্রতিরোধ, আন্দোলন এবং আত্মত্যাগের দীর্ঘ ইতিহাস।

স্বাধীনতার শিকড়: ইতিহাসের পাতায় ফিরে দেখা
বাংলার স্বাধীনতার সূচনা বহু পুরোনো। ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতার প্রদীপ নিভে গিয়েছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের যাঁতাকলে পড়ে বাঙালি জাতি দীর্ঘ ১৯০ বছর ধরে শোষিত হয়েছে। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের বিভক্তির পর ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয়েছিল পাকিস্তান, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ শিগগিরই বুঝতে পারে যে তারা নতুন এক পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

পশ্চিম পাকিস্তানিদের দমননীতি, অর্থনৈতিক শোষণ এবং সাংস্কৃতিক নিপীড়ন বাঙালিদের মধ্যে বিক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। বিশেষত ভাষার অধিকারের প্রশ্নে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন স্বাধীনতার বীজ বপন করে। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জোরালো করে তোলে।

স্বাধীনতার যুদ্ধের সূচনা
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান হঠাৎ করেই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে পূর্ব বাংলার মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) তার বিখ্যাত ভাষণ দেন, যেখানে তিনি পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার ডাক দেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী নির্মম ‘অপারেশন সার্চলাইট’ পরিচালনা করে, যেখানে হাজার হাজার নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করা হয়।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা আসে, যা বাঙালিদের আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত করে। শহীদ রাষ্ট্রপতি মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এরপর শুরু হয় এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, যা দীর্ঘ ৯ মাস স্থায়ী হয়।

মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস: রক্তে লেখা ইতিহাস
বাংলার মাটি রঞ্জিত হয়েছিল লাখো মুক্তিকামীর রক্তে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্বিচারে গণহত্যা চালায়, লক্ষাধিক নারী নির্যাতনের শিকার হন, লাখ লাখ পরিবার দেশ ছেড়ে ভারতে শরণার্থী হতে বাধ্য হয়। মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা কৌশলে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ভারতের সহায়তায় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে, আর আমরা অর্জন করি কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।

স্বাধীনতার ৫৫ বছর: অর্জন ও চ্যালেঞ্জ
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ নানা সংকট মোকাবিলা করলেও আজ উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে চলেছে। একসময়ের দারিদ্র্যপীড়িত দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, তৈরি পোশাক শিল্পে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় রপ্তানিকারক এবং ডিজিটাল প্রযুক্তিতে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো মেগা প্রকল্প আমাদের অগ্রগতির প্রতীক। তবে চ্যালেঞ্জও কম নয়। দুর্নীতি, বৈষম্য, পরিবেশদূষণ, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো সমস্যাগুলো এখনো স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল থেকে আমাদের দূরে রাখছে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

স্বাধীনতা দিবসের উদযাপন ও তাৎপর্য
এদিন ভোরবেলা ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে স্বাধীনতা দিবসের সূচনা হয়। ঢাকা ও সারাদেশে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়, আলোকসজ্জা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে, ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন আলোচনা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক চলচ্চিত্র প্রদর্শন এবং খেলাধুলার আয়োজন করে। স্বাধীনতা দিবস কেবল উদযাপনের জন্য নয়; এটি আমাদের আত্মপরিচয়, আত্মমর্যাদা এবং আত্মউন্নয়নের শপথ গ্রহণের দিন।

স্বাধীনতা রক্ষা: আমাদের দায়িত্ব
স্বাধীনতা কোনো রাষ্ট্রের একার নয়; এটি জনগণের, প্রতিটি নাগরিকের। ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে আমরা স্বাধীনতাকে সার্থক করতে পারি।

বাঙালির লড়াই কেবল ১৯৭১ সালেই শেষ হয়ে যায়নি, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। আজ আমাদের দায়িত্ব হলো সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সাম্য ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, এবং জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো। তাহলেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের আত্মত্যাগের প্রকৃত মর্যাদা দিতে পারব।

বিজ্ঞাপন

৫৫ বছরের স্বাধীন বাংলাদেশ এখন এক পরিণত জাতি। আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ও সংগ্রামের গৌরবময় স্মৃতিকে বুকে ধরে আমরা এগিয়ে যাব আরও সমৃদ্ধ, আরও উন্নত ভবিষ্যতের দিকে। আমরা যদি সত্যিকারের স্বাধীনতা রক্ষা করতে চাই, তবে দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এক হয়ে জাতির উন্নয়নে কাজ করতে হবে। তাহলেই স্বাধীনতার ৫৫ বছর উদযাপন কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং একটি নতুন শপথ হয়ে উঠবে-একটি উন্নত, সমৃদ্ধ এবং মানবিক বাংলাদেশের জন্য।

কেএসকে/এএসএম

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।