সভ্য জাতিতে পরিণত হতে বইপড়ার বিকল্প নেই: জাকিয়া রায়হানা

আনিসুল ইসলাম নাঈম
আনিসুল ইসলাম নাঈম আনিসুল ইসলাম নাঈম , ফিচার লেখক
প্রকাশিত: ১২:১৩ পিএম, ২৩ মার্চ ২০২৫

ব্যস্ততাকে ছুটি দিয়ে ধানমন্ডির লেকে অনেকে অবসর সময় কাটাতে যান। মেইন রোড থেকে লেকে ঢুকলে পাখির বাসার মতো কতগুলো বাক্স দেখা যায়। দূর থেকে বাক্স মনে হলেও আদতে এগুলো পাখির বাসা নয়। কারণ ভেতরে পাখির দেখা মেলে না! সবগুলোতেই বইয়ের স্তূপ। এগুলো মাইক্রো বুককেস। ব্যতিক্রমী উদ্যোগটি নিয়েছেন ধানমন্ডি নিবাসী জাকিয়া রায়হানা রূপা। তার মাইক্রো বুককেসের আদ্যোপান্ত ও ব্যক্তিগত ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম

জাগো নিউজ: আপনার শৈশব ও বেড়ে ওঠা সম্পর্কে শুনতে চাই।
জাকিয়া রায়হানা রূপা: আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা পুরান ঢাকার দাদা বাড়িতে। ক্লাস ফোর পর্যন্ত সেখানেই বেড়ে ওঠা। এরপর বাবা ডগাইর নতুন পাড়া, ডেমরাতে বাড়ি করেন। বিয়ের আগ পর্যন্ত সেখানেই কেটেছে। বাবা ছিলেন বাস চালক এবং মা স্কুল শিক্ষক। আমার শিক্ষা-দীক্ষা, আচার–আচরণ, বেড়ে ওঠা-সব কিছু মায়ের কাছ থেকেই শেখা। মা ভীষণ বই পড়তেন। মাকে দেখে বই পড়ুয়া হয়েছি। সেসময় অন্য মায়েদের এভাবে বই পড়তে দেখিনি। আমার খেলাধুলা ও ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগতো। আমি প্রচুর ঘুরে বেড়িয়েছি। বাংলাদেশ প্রায় পুরোটা ভ্রমণ করা শেষ। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই আমার ঘুরাঘুরির জীবন শুরু হয়। তখন প্রতি বর্ষাতেই দুই-তিনটা ট্যুর দেওয়া হতো। দলবেঁধে সবাইকে নিয়ে যেতাম। একটা সোলো/একা ভ্রমণ করেছি, এক মাসের মতো। আমার একটা শখ হচ্ছে, অনেক উচুঁ কোনো জায়গায় পা ঝুলিয়ে বসে থাকা। এটা আমার খুব ভালো লাগে। অ্যাডভেঞ্জারও আমার পছন্দের তালিকায় রয়েছে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলা বিভাগ থেকে অনার্স পাস করেছি। বর্তমানে ধানমন্ডিতে থাকছি।

বিজ্ঞাপন

জাগো নিউজ: কোন ধারণা থেকে ধানমন্ডির লেকে মাইক্রো বুক কেস বসানোর ভাবনা মাথায় আসলো?
জাকিয়া রায়হানা রূপা: কিছুদিন আগে ফেসবুকে একজনের ভ্লগে দেখতে পেলাম, জার্মানির বিভিন্ন পার্কে বড় বড় বুকসেলফ রাখা। সেখান থেকে অনেকেই বই পড়েন, আবার অনেকে বই ডোনেটও করেন। ভাবলাম, জার্মানিতে সম্ভব হলে বাংলাদেশে কেন হবে না? তাই প্রথমে একটি বাক্স বসাই ধানমন্ডি লেকে। যেহেতু এখানে আমার নিয়মিতই আসা হয়। আমি ছোট বাক্স বাছাই করেছি, কারণ বড় সেলফ হলে দূরে দূরে বসাতে হবে। ছোট হওয়ায় অনেক জায়গায় এই বইয়ের ব্যবস্থা করা যাবে। তখন যে কেউ তার কাছ থেকেই বই নিয়ে পড়তে পারবেন। মূলত অবসর সময়টাতে যারা পার্কে একটু বিশ্রাম নেন, তাদের হাতের নাগালে বই পৌঁছে দিতেই এই উদ্যোগ।

সভ্য জাতিতে পরিণত হতে বই পড়ার বিকল্প নেই: জাকিয়া রায়হানা

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

জাগো নিউজ: তারপর বুককেস বসানোর কাজ কীভাবে করলেন?
জাকিয়া রায়হানা রূপা: প্রথম বুককেসের ৫টি বই আমার টাকায় কেনা। এরপর ফেসবুকে পোস্টের মাধ্যমে জানানোর পর অনেকে সাড়া দিয়েছেন। অনেকে বিকাশে টাকা পাঠিয়েছেন, অনেকে বই পাঠিয়েছেন। বই কেনার জন্য নগদ টাকা দিয়েছেন। তাদের টাকা দিয়ে বুককেস বানানো হয়েছে এবং বই কেনা হয়েছে। কাছাকাছি যারা থাকেন, তারা বই নিজ হাতে দিয়ে গেছেন।

জাগো নিউজ: মাইক্রো বুককেসে কোন ধরনের বইগুলো জায়গা করে নিয়েছে?
জাকিয়া রায়হানা রূপা: বর্তমানে ২৪টি মাইক্রো বুককেস রয়েছে। সেখানে এমন বই রাখার চেষ্টা করি, যেসব বই পড়লে মানুষের চিন্তার জগত একটু হলেও নাড়া দিবে। মানুষ কিছু শিখতে পারবে। ম্যাচিউরড হতে পারবে। সমাজ, দেশ সম্পর্কে জানবে। নিজের ব্যক্তিত্বের উন্নতি ঘটবে-এই ধরনের বিষয় সম্পর্কে সচেতন হবে। তবে শুধু আমার পছন্দের বই নয়। কারণ অনেকে আমাকে বই দিয়ে যাচ্ছেন এবং নিজের হাতে বুককেসে বই রেখে যাচ্ছেন। সেখানে তাদের পছন্দের বইও থাকছে। তাই বলা যায়, সব মিলিয়ে সবার পছন্দের বই রয়েছে।

জাগো নিউজ: পাঠকদের কেমন সাড়া পাচ্ছেন। কোন বয়সী মানুষজন বেশি বই পড়ছেন?
জাকিয়া রায়হানা রূপা: এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগে ব্যাপক সাড়া মিলেছে। দুই শ্রেণির মানুষকে বই বেশি পড়তে দেখে যায়। সকালের দিকে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা বই পড়েন। পাশাপাশি বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানকে স্কুলে রেখে এখানে এসে বই পড়েন। বিকাল বা রাতে, বয়স্ক শ্রেণির মানুষরা লেকে হাঁটতে আসেন। তারা লম্বা একটা সময় বসে বই পড়েন। এছাড়া আরও অনেকে বই পড়েন।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

সভ্য জাতিতে পরিণত হতে বই পড়ার বিকল্প নেই: জাকিয়া রায়হানা

জাগো নিউজ: এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগের কারণ কী? বই পড়ানোর মাধ্যমে সমাজে কোনো বার্তা দিতে চান কি না?
জাকিয়া রায়হানা রূপা: এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগের একটাই এবং একমাত্র কারণ। আমি চাই দেশের মানুষ বই পড়ুক। যত বেশি বই পড়বে তত বেশি আমরা শিক্ষিত হব। বই পড়লেই মানুষ জানবে এবং শিখবে। অসভ্য থেকে আমরা সভ্য হব। দেশে বর্বরতা কমবে। ভদ্র হব আমরা। যত বেশি শিক্ষিত হয়, তত বেশি ম্যাচুরিটি বাড়বে। বই মানুষকে ধৈর্য্যশীল ও সহনশীল হতে শেখায়। সবকিছু মিলিয়ে একটা সভ্য জাতিতে পরিণত হতে গেলে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। ছোট থেকে শিখে এসেছি, শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। যে কোনো সময়ের জন্য এই কথাটা একশ ভাগ গ্রহণযোগ্য।

জাগো নিউজ: মাইক্রো বুককেস নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে কী?
জাকিয়া রায়হানা রূপা: এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়নি। পুরো কাজটা সহজভাবে করতে পেরেছি। সবাই আমাকে টাকা এবং বই পাঠিয়ে সহযোগিতা করেছেন। তবে সম্পূর্ণ কাজটা আমার হাতে করা। দেখাশোনার কাজটা আমারই করতে হয়। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম বুক কেস স্থাপন করা হয়। এখন অনেকগুলো বুককেস রয়েছে। প্রতি সপ্তাহে একবার বা দুইবার দেখে আসি। বইগুলো চেক করে আসি। কোনো কেসে বই লাগলে দিয়ে আসি। এই যত্নটা করার চেষ্টা করা প্রয়োজন। এজন্য ধানমন্ডি লেকের বাইরে বই স্থাপন নিয়ে কাজ করিনি। সবাইকে বলছি যার যার জায়গা থেকে এরকম উদ্যোগ নিন এবং বইয়ের যত্ন নিন। সরকার এয়ারপোর্ট, রাস্তা-ঘাট, স্টেশন, টার্মিনালে বড় আকারে বুককেস বসাতে পারে। সেই আহ্বান রইলো। এছাড়া আরও যত জায়গায় বসাতে চায়।

বিজ্ঞাপন

জাগো নিউজ: আপনি মেন্টাল হেলথ, যৌন শিক্ষা এবং প্যারেন্টিং-এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করেন। এ সম্পর্কে বলবেন?
জাকিয়া রায়হানা রূপা: মানুষ গতানুগতিক যেসব কাজ করেন, আমি চেষ্টা করি ভিন্ন কিছু করার। যা মানুষ সহজে করেন না। এটার প্রতি আমার একটা আকর্ষণ আছে। মেন্টাল হেলথ, যৌন শিক্ষা এবং প্যারেন্টিং-এই বিষয়গুলো নিয়ে কেউ তেমন কথা বলেন না। কিন্তু এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলাটা জরুরি। সেই চিন্তা থেকে ৫/৬ বছর আগে কাজ শুরু করি। তখন যৌন শিক্ষা নিয়ে তেমন কথা হত না। তবে এখন টুকটাক কথা হচ্ছে। এই বিষয়গুলো নিয়ে অনলাইন এবং অফলাইনে কাজ করছি।

জাগো নিউজ: আপনি মরণোত্তর চোখ ও দেহ দান করেছেন? কোন ভাবনা থেকে এই সিদ্ধান্তটি নিলেন?
জাকিয়া রায়হানা রূপা: মানুষের জন্য কিছু করতে পারলে ভালো লাগে। এছাড়া আমি সেবামূলক কিছু কাজ করছি। আগে এভাবে সক্রিয় ছিলাম না। তবে খেয়াল করে দেখলাম কারো জন্য কিছু করতে পারলে খুব ভালো লাগে। যেমন- কাউকে কোনো সহযোগিতা বা কাজে হেল্প করতে পারাটা আমার জন্য আনন্দদায়ক। সবসময় মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করি। সেই ভাবনা থেকে, মানুষের মৃত্যুর পরই তার শরীরটুকু শেষ সম্পদ। সেই সম্পদটুকু আমি মানুষের জন্য দিয়ে যেতে চাই। সেই চিন্তা থেকেই মৃত্যু পরবর্তী দেহদান করেছি। চোখ দান করেছি সন্ধানীতে।

জাগো নিউজ: মাইক্রো বুককেস নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
জাকিয়া রায়হানা রূপা: আমার করা মাইক্রো বুককেসগুলো মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দেখভাল করতে চাই। ভবিষ্যতে এই উদ্যোগ পুরো বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিতে চাই। সবাই সবার মত উদ্যোগটা এগিয়ে নিক। সামনের দিনে দেশের জনগণ ও সরকার এই উদ্যোগে সাড়া দিবে, সেই স্বপ্ন দেখছি।

বিজ্ঞাপন

কেএসকে/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।