আলোচিত-সমালোচিত ২০২৪
তারকাদের কাঁদিয়েছিল পুড়ে যাওয়া বিটিভি
গণ-আন্দোলনের মুখে সরকার বিদায় নেওয়ার ঘটনা আগেও ঘটেছে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে পথে নেমেছে, ডেকেছে হরতাল, ধর্মঘট। অগ্নিসংযোগ-ভাঙচুরে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে অনেক স্থাপনা ও যানবাহন। সেসব ঘটনায় অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হলেও বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ছিল অক্ষত। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল বিটিভি কখনো আক্রান্ত হয়নি। তবে ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানে সেখানে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি তারকাশিল্পীদের একাংশ। সেটি ছিল ২০২৪ সালের অন্যতম আলোচিত-সমালোচিত এক ঘটনা।
হাসিনা সরকার পতনে ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলকালে চলতি বছরের ১৮ জুলাই রাজধানীর রামপুরাস্থ বিটিভির প্রধান কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। ৩ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আগুন জ্বলছিল। বিটিভির মূল ভবনেও সে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ভেতরে আটকা পড়েছিলেন অনেকে। বিকেল ৫টার পর বিটিভির গেট ভেঙে শত শত আন্দোলনকারী সেখানে প্রবেশ করে রিসিপশন ভবনে আগুন দেয়। অগ্নিসংযোগ করা হয় কয়েক ডজন গাড়িতেও।
ওই দিন বিকেল সাড়ে ৩টার পর বিটিভির গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেন আন্দোলনকারীরা। বিটিভি সেন্টারে প্রবেশের পর স্লোগান দিতে দিতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন। একপর্যায়ে বিটিভির সম্প্রচারকক্ষে আগুন লাগলে টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। বিটিভি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় অবরুদ্ধ কর্মীদেরও জনতার তোপের মুখে পড়তে হয়। দেশের বিভিন্ন ঘটনার প্রকৃত প্রতিফলন রাষ্ট্রীয় এই গণমাধ্যমে না দেখে এর ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন সাধারণ মানুষ। একসময় এই চ্যানেলকে কটাক্ষ করে ‘বাতালি লেবু চ্যানেল’ বলেও ডাকতে শুরু করে মানুষ।
বিটিভিতে আগুন দেওয়ার প্রতিবাদ জানাতে ১ আগস্ট বিটিভি প্রাঙ্গণে হাজির হন সংস্কৃতি অঙ্গনের আওয়ামীপন্থী একঝাঁক তারকা। তাদের হাতে ছিল বিভিন্ন স্লোগান সম্বলিত ব্যানার, ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড। অগ্নিকাণ্ডে বিটিভির ক্ষয়ক্ষতি দেখে তাদের অনেকে অঝোরে কেঁদেছিলেন।
জুলাইয়ের আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন আহত ছাত্রদের অনেকে। আহত ছাত্রদের পাশে না দাঁড়িয়ে বিটিভিতে গিয়ে তারকাদের কান্নাকাটির ঘটনায় সেদিন নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন মহলে এমনকি বিনোদন অঙ্গনেরও নিন্দার ঝড় ওঠে। কেউ কেউ বলেছিলেন মানুষের জীবনের চেয়ে স্থাপনা কখনই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না।
ছাত্রদের সঙ্গে সংহতি শিল্পীদের একাংশের
১ আগস্ট তারকাদের একটি দল যখন বিটিভিতে, তখন ‘দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজ’-এর ব্যানারে ফার্মগেট এলাকায় অবস্থান নেন চলচ্চিত্র, আলোকচিত্র, থিয়েটার, গণমাধ্যমসহ দৃশ্যমাধ্যমের বিভিন্ন শাখার একদল শিল্পী ও কর্মীরা।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা জানিয়েছিলেন তারা।
ওই সমাবেশে বাঁধন বলেন, ‘যে অন্যায়, অবিচার, নিপীড়ন করা হয়েছে বা করা হচ্ছে এখনো, যেভাবে গণগ্রেপ্তার করা হচ্ছে, যেভাবে গুলি করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, একটি গণতান্ত্রিক দেশে সেই দৃশ্য দেখার পর কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ যদি বাড়িতে বসে থাকতে পারে, তাহলে আমার বলার কিছু নেই। কারণ আমার একটি ১২ বছরের সন্তান আছে। আমি নিজে এ দেশের নাগরিক। আমার বিদেশি কোনো পাসপোর্ট নেই। আমি এই দেশেই থাকবো এবং এই দেশটি আমার। এই দেশটি আমরাই সংস্কার করবো।’
চলমান আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘যেদিন থেকে এই ঘটনাগুলো শুরু হয়েছে, যেদিন থেকে গুলি চলেছে, সেদিন থেকে আমি দুই চোখের পাতা এক করতে পারিনি। কারণ ওই শিশুগুলোর মধ্যে আমার সন্তান থাকতে পারতো। ওই মানুষগুলোর মধ্যে আমি, আপনি থাকতে পারতাম।’ কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতার ঘটনার তদন্ত দাবি করে অভিনেত্রী বলেন, ‘এটা কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি হতে পারে না। আমি এসব অন্যায়ের সুষ্ঠু তদন্ত চাই এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিচারের আওতায় আনা হোক। এর প্রকাশ্য-প্রয়োগ আমরা দেখতে চাই।’
ছাত্রদের ওপর সহিংসতার প্রতিবাদ জানিয়ে ওই সময় শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির সঙ্গে সংহতি জানিয়েছেন চলচ্চিত্রকার মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, নূরুল আলম আতিক, আকরাম খান, পিপলু আর খান, অমিতাভ রেজা চৌধুরী, সৈয়দ আহমেদ শাওকি, ওয়াহিদ তারেক, রেদওয়ান রনি, আমিরুল রাজিব, শঙ্খ দাশগুপ্ত, হুমাইরা বিলকিস, তানিম নূর, জাহিন ফারুক আমিন, তানভীর আহসান, ইয়াছির আল হক, নাসিক আমিন, ধ্রুব হাসান, অভিনেতা আজাদ আবুল কালাম, নুসরাত ইমরোজ তিশা, সাবিলা নূর, তাসনিয়া ফারিণ, আলোকচিত্রী মুনেম ওয়াসিফ, তাসলিমা আকতার লিমা, শিল্পী ঋতু সাত্তার, তানজিম ওয়াহাব প্রমুখ। ফার্মগেটের সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন তাদের অনেকে। নায়ক সিয়াম আহমেদ, মোশাররফ করিমরাও সেদিন উপস্থিত ছিলেন ফার্মগেটে।
সেদিন যা ঘটেছিল বিটিভিতে
‘সকল সহিংসতার বিরুদ্ধে আমরা’ স্লোগান সম্বলিত ব্যানার ধারণ করে বিটিভি প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে বিটিভির অগ্নিকাণ্ডকে সহিংসতা হিসেবে অভিহিত করেন শিল্পীরা। এ সময় বিটিভিতে যারা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে তাদের খুঁজে বের করে শাস্তির দাবি জানান তারা। পাশাপাশি ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের প্রতিও সমবেদনা প্রকাশ করেন শিল্পীরা।
সেদিন অভিনেত্রী শমী কায়সার বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন বাঙালির সংস্কৃতির ধারক ও বাহক, বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করেছে। সেই বিটিভিতে এসে এই ধ্বংসযজ্ঞ দেখে মর্মাহত হয়েছি। এখানে আমরা বেড়ে উঠেছি। এই ধ্বংসযজ্ঞের সঙ্গে যারা জড়িত, আমরা তাদের বিচার চাই। বাংলাদেশে এ রকম নৃশংসতা, এমন ধ্বংসযজ্ঞ, এত প্রাণহানি আমরা আর চাই না।’
নায়ক ফেরদৌস আহমেদ বলেছিলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদেরকে ঢাল করে একদল মানুষরূপী পশু জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ছারখার করে দিয়েছে আমাদের দেশকে। দেশটি হয়তো আবার ঠিক করে ফেলব আমরা। কিন্তু যে প্রাণগুলো ঝরে গেল সেগুলো আর কোনোদিন ফিরে পাবো না। যতগুলো প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে, সুপরিকল্পিতভাবে এসব করা হয়েছে। তাদের বিচার চাই। আজ শিল্পীরা এখানে একত্রিত হয়েছি, আমাদের সংহতি প্রকাশ করার জন্য। সকল সহিংসতার বিরুদ্ধে আমরা।’
অভিনেতা আজিজুল হাকিম বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ টেলিভিশনের ওপর যে নৃশংস হামলা হয়েছে, তা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। আমি এই আক্রমণের তীব্র নিন্দা জানাই। সেই সঙ্গে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যে সকল প্রাণ আমরা হারিয়েছি, তাদের বিদেহী আত্মার প্রতি সমবেদনা জানাই, তাদের আত্মার শান্তি কামনা করি। আমরা সুন্দর বাংলাদেশ চাই, সম্প্রতির বাংলাদেশ চাই, স্বস্তির বাংলাদেশ চাই, সন্ত্রাসের বাংলাদেশ চাই না। সবাই মিলে আসুন, দেশটাকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাই। আর সন্ত্রাস আমাদের কাম্য নয়।’
- পড়ুন তখনকার ঘটনার খবর :
- ‘বিস্মিত-লজ্জিত’ হয়ে প্রশংসায় ভাসছেন সাহসী সাদিয়া
- ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে বিটিভিতে ফেরদৌস, রিয়াজ, নিপুণরা
- জয়া আহসান নাকি ‘বিটিভি-ফার্মগেটের মাঝখানে’
- ‘আমার কানে এখনো বাজে, পানি লাগবে’
- ‘ঘরে বসে থাকার অবস্থা নাই’, রাস্তায় নেমে মোশাররফ করিম
সেদিন বিটিভি প্রাঙ্গণে উপস্থিত ছিলেন রিয়াজ, অরুণা বিশ্বাস, সুজাতা, নিপুণ, রোকেয়া প্রাচী, সুইটি, হৃদি হক, জ্যোতিকা জ্যোতি, সাজু খাদেম, সোহানা সাবা, চন্দন রেজা, সংগীতশিল্পী শুভ্র দেব, পরিচালক মুশফিকুর রহমান গুলজার, এস এ হক অলিক, খোরশেদ আলম খসরুসহ নাটক ও চলচ্চিত্র অঙ্গনের তারকারা।
প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অনেকেই
ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন অনেকেই। তাদের অন্যতম সাদিয়া আয়মান। তরুণ এই অভিনেত্রী ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘এক সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা অভিনেত্রীরা বিটিভির প্রাঙ্গণে গিয়ে চোখের পানি ঝরিয়েছেন। অবশ্যই তাদের জীবন ও ক্যারিয়ারের সাথে বিটিভিকেন্দ্রিক স্মৃতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাদের দুঃখ পাওয়াটা হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু এতগুলো ছাত্র-ছাত্রী, শিশু, মা-বোন, সাধারণ মানুষ যে মারা গেল, তা নিয়ে একবারও কিচ্ছু বললেন না! একবারও দুঃখ প্রকাশ করলেন না। একবারও এই মানুষগুলোর হত্যার বিচার চেয়ে কিছু বললেন না। কেন? কারণ যারা এই আন্দোলনে প্রাণ হারিয়েছেন, তারা আপনাদের কেউ না। তাদের বা তাদের পরিবারের দ্বারা আপনাদের কোনো লাভ হবে না, স্বার্থ হাসিল হবে না এবং ক্ষমতাও পাবেন না। তাই কি?’
এমএমএফ/আরএমডি/এএসএম