গাই নয়া মানুষের গান, বয়াতির নতুন জীবন!
সিনেপ্লেক্সে দেখলাম তরুণ নির্মাতা সোহেল রানা বয়াতির ডেব্যু চলচ্চিত্র ‘নয়া মানুষ’। ‘নয়া মানুষ’ মূলত মেঘনার চরে তুফানে ভেসে আসা এক নতুন মানুষের গল্প। বানভাসী এই মানুষের নাম ময়েজ। চরের স্বাভাবিক জীবনের মধ্যে বানভাসী নতুন মানুষ ময়েজের আগমনকে কেন্দ্র করেই ‘নয়া মানুষ’ চলচ্চিত্রের কাহিনি। আ. মা. ম. হাসানুজ্জামানের ‘বেদনার বালুচর’ গল্প অবলম্বনে এবং মাসুম রেজার চিত্রনাট্য ও সংলাপে নির্মিত ‘নয়া মানুষ’ চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ নির্মাতা সোহেল রানা বয়াতি।
‘নয়া মানুষ’ সিনেমার গল্পটি এককথায় অসাধারণ। চরে ভেসে আসা বানভাসী নতুন মানুষ ময়েজ, চরের গরিব বিধবা সুজলা ও তার একমাত্র কিশোরী কন্যা শৈবলিনীকে নিয়ে ঘটনা পরম্পরায় এক জটিলতা তৈরি হয়। যার নাটেরগুরু মোহন। মোহনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হাউস মণ্ডল সেই চরের মাতবর। মাতবর হাউস মণ্ডল আর মোহনের দর কষাকষির রাজনীতিতে সহজ কথায় বলি হয় সুজলা ও ময়েজ। আর শেষ পর্যন্ত তা গড়ায় ধর্মীয় রাজনীতিতে। হিন্দু-মুসলিম ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও রাজনীতিকে ঘিরে সিনেমার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে ইমাম সাহেবের বিচক্ষণতায়।
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করে চরাঞ্চলের মানুষের মধ্যে একদিকে যেমন চরম দারিদ্র্য, অন্যদিকে সেখানে রয়েছে নানান কিসিমের কুশিক্ষা ও ধর্মীয় গোঁড়ামি। আর সেখানে বসবাসরত জনমানুষের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম অমায়িক সম্প্রীতি ও সহাবস্থান থাকলেও মোহনের মতো গুটিকয় মানুষের কারণে সেখানে সৃষ্টি হয় এক নতুন সংকট। সেই সংকটের শুরু বানভাসী ময়েজের আগমনকে ঘিরে হলেও, ক্ষুদ্র সেই সংকটকে বৃহত্তর এক ধর্মীয় রাজনীতির দিকে টেনে নিয়ে যায় মোহনের কূটকৌশল। সিনেমায় আদতে মোহন এখানে খলনায়ক।
তরুণ পরিশ্রমী নির্মাতা সোহেল রানা বয়াতি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে মোহনের সেই কূটকৌশলকে স্বয়ং চরের ইমাম সাহেবের মাধ্যমে একটা সম্ভাব্য হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি বিনষ্টের হাত থেকে দারুণ মুন্সিয়ানায় সমাধান বের করেন। আমার মতে এখানেই ‘নয়া মানুষ’ সিনেমাটি শিল্পগুণ ও ন্যায্যতার বিচারে এক চরম উৎকর্ষতা লাভ করেছে। সিনেমার শেষ দৃশ্যে তাই দর্শক শিল্পকে স্যালুট জানাতে বাধ্য।
প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে তরুণ নির্মাতা সোহেল রানা বয়াতি আদতে নিজের সাথে নিজেই একটা অসম্ভব সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন। ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে সোহেল চলচ্চিত্রটির চিত্রধারণ শুরু করেন। কিন্তু সুপার সাইক্লোন সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে সোহেলের শুটিং সেট চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার পরিণতিতে সিনেমার শুটিং একসময় বন্ধ হয়ে যায়। পরে সেই বিপর্যয় সামাল দিয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে নতুনভাবে সেট তৈরি করে চলতি বছর অবশিষ্ট শুটিং শেষ করেন সোহেল।
সিনেমাটির পোস্ট-প্রোডাকশনের কাজ শেষ হতে নভেম্বর মাস চলে যায়। আর ৬ ডিসেম্বর সিনেমাটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। কিন্তু তরুণ নির্মাতার যুদ্ধ আদতে এখনো শেষ হয়নি!
আ. মা. ম. হাসানুজ্জামানের ‘বেদনার বালুচর’ গল্পটি যেমন চমৎকার তেমনি হাউস মণ্ডলের চরিত্রে তিনি দারুণ অভিনয়ও করেছেন। আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে কিশোরী শৈব্যলিনীর অভিনয়। কিশোরী শৈবলীনী বা শৈব্য চরিত্রে ইন্দ্রায়ুধ ঊষশী অসাধারণ অভিনয় করেছেন। শৈবর মা সুজলা চরিত্রে মৌসুমী হামিদের অভিনয়ও বেশ সাবলীল ছিল। বানভাসী নতুন মানুষ ময়েজের চরিত্রে রওনক হাসান দারুণ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। মোহন চরিত্রে আশিষ খন্দকার দারুণ দারুণ সব ভেলকি দেখান। কিন্তু কোথাও কোথাও একটু ওভার অ্যাক্টিং হয়েছে ঠিক তার সাগরেদ আশুর (সরন সাহা) মতো। ইমাম চরিত্রে ঝুনা চৌধুরী ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান। ডাক্তারের চরিত্রে বদরুদ্দোজা এবং তার স্ত্রীর চরিত্রে মেহরান সানজানার অভিনয় ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। অন্যান্যদের মধ্যে হাউস মণ্ডলের বউ চরিত্রে শিখা কর্মকার, সুজলার জামাই চরিত্রে মাহিন রহমান, ময়েজের বউ চরিত্রে নিলুফার ওয়াহিদ ও নারী বাউল শিল্পীর চরিত্রে পারভীন পারু সুন্দর অভিনয় করেছেন।
আরও পড়ুন:
‘নয়া মানুষ’ সিনেমার সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো এর লোকেশান। অসাধারণ লোকেশানে চিত্রধারণেও দারুণ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তরুণ চিত্রগ্রাহক কমল চন্দ্র দাস। সূর্যাস্ত বা সূর্যোদয়ের দৃশ্যগুলো সত্যি সত্যিই অসাধারণ। আমার কাছে সে তুলনায় সম্পাদক জুনায়েদ হালিমের কাছে আরেকটু বেশি প্রত্যাশা ছিল। কারণ সম্পাদক হিসেবে জুনায়েদ হালিমের নামটি আমাদের কাছে অধিক পরিচিত। ‘নয়া মানুষ’ চলচ্চিত্রের চলমান ছবিকে যদি আমরা দেহ ধরি, তাহলে এ ছবির সত্যিকারের প্রাণ হলো ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক এবং গানগুলো।
কবি নির্মলেন্দু গুণের কথায় ‘মরণের নামে জাগো’ গানটির দুর্দান্ত সংগীত পরিচালনা করেছেন বেলাল খান। শোভন রায়ের সংগীত আয়োজনে বেলাল খান দারুণ মুন্সিয়ানায় গানটি গেয়েছেন। গানটি যখন পর্দায় চলছিল, আমার তখন আনন্দে অশ্রু ঝরেছে। এখানেই তরুণ নির্মাতা সোহেল রানা বয়াতি, কবি নির্মলেন্দু গুণ, বেলাল খান ও শোভন রায়ের যৌথ প্রয়াস অত্যন্ত স্বার্থক। অসাধারণ এই গানটি শোনার জন্য দর্শক বারবার হলে যাবে বলেই আমি বিশ্বাস করি।
সিনেমার ‘চাঁদের বাড়ি’ গানটি লিখেছেন সুজন হাজং। সুজনের ‘চাঁদের বাড়ি’ গানটির কথা এতই মিষ্টি আর এটাকে ইমন চৌধুরী এত যত্ন নিয়ে তৈরি করেছেন যে, বিশ্বের যে কোনো দেশের শ্রোতার মনোরঞ্জন করতে এটি বাধ্য। গানটি গেয়েছেন অনিমেষ রায় ও মাশা ইসলাম। ইমন চৌধুরী গানটিতে যে হৃদয়স্পর্শী সুর সৃষ্টি করেছেন আর তার সাথে অনিমেষ ও মাশা যে ঢঙে গেয়েছেন, এককথায় অসাধারণ।
সিনেমায় শহীদুল্লাহ ফরায়জীর লেখা ‘জীবন’ গানটিতে মুশফিক লিটু সংগীত পরিচালনায় যেমন দারুণ মুন্সিয়ানার ছাপ রেখেছেন। তেমনি খায়রুল ওয়াসীর সুর ও কণ্ঠ ছিল দারুণ হৃদয়স্পর্শী। সিনেমার ‘নয়া মানুষ’ গানটি লিখেছেন রনক ইকরাম। মুশফিক লিটুর সংগীত পরিচালনায় এবং প্লাবন কোরেশীর সুরে গানটি পরিবেশন করেছেন শিল্পী শফি মণ্ডল ও চন্দনা মজুমদার। সব মিলিয়ে ‘নয়া মানুষ’ সিনেমার গানগুলো মানুষের হৃদয়ে দীর্ঘদিন স্থান করে নেবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
মাসুম রেজার চিত্রনাট্য ও সংলাপ ছিল দৃষ্টিকাড়ার মতো। রিপন নাথের সাউন্ড, প্রত্যয় খানের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক এবং এইচএম সোহেলের কালার নিয়ে পরবর্তীতে কোনো সময়ে বলতে পারব। কারণ সিনেপ্লেক্সের যে পর্দায় সিনেমাটি দেখার আমার সৌভাগ্য হয়েছে, সেই পর্দাটি রঙ এবং সাউন্ডের জন্য সঠিক ছিল বলে আমার মনে হয়নি। পাশাপাশি এত দারুণ একটি গল্প এবং এত সুন্দর যত্নে নির্মিত একটি সিনেমার জন্য নির্মাতা সোহেল রানা বয়াতি যথেষ্ঠ পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি বলেই আমার মনে হয়েছে। সিনেমাটির আরও প্রচার ও দর্শকের কানে সিনেমার খবরটি পৌঁছানোর জন্য কোথাও একটি সমন্বয়হীনতার ছাপ আমার কাছে সুস্পষ্ট হয়েছে।
দারুণ একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য দুর্ভাগা পরিশ্রমী তরুণ নির্মাতা সোহেল রানা বয়াতিকে আমার সুতীব্র উষ্ণ আলিঙ্গন ও অভিনন্দন। ‘নয়া মানুষ’ টিমের জন্য আমার শুভ কামনা। জয়তু বাংলা সিনেমা। জয়তু ‘নয়া মানুষ’।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা
এমএমএফ/জেআইএম