মুনীর চৌধুরী সম্মাননা পাচ্ছেন মঞ্চকুসুম শিমূল ইউসুফ
দেশের জনপ্রিয় মঞ্চকর্মী শিমূল ইউসুফ। অনুরাগীরা ভালোবেসে তাকে মঞ্চকুসুম নামে সম্মানিত করে থাকেন। একাধারে তিনি শিল্পী, অভিনেত্রী ও অ্যাকটিভিস্ট। ৪ বছর বয়সে কবি সুফিয়া কামালের কোলে বসে শিমূল প্রথম মঞ্চে গান করেন। ৬৭ বছরের জীবনে শিল্পের সঙ্গেই মিশে আছেন তিনি।
দীর্ঘ এই শিল্পচর্চার জীবনে পেয়েছেন নাটকপ্রিয় মানুষের ভালোবাসা। সাফল্যের মুকুটে যোগ হয়েছে অনেক স্বীকৃতি ও পুরস্কার। সেখানে এবার বাড়ছে আরও একটি গৌরবময় পালক। বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ ও গবেষক শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর নামে প্রচলিত সম্মাননা পেতে যাচ্ছেন শিমূল ইউসুফ। এই প্রাপ্তিকে তিনি শিল্পের চর্চায় বড় একটি স্বীকৃতি বলে মানছেন।
মুনীর চৌধুরীর শততম জন্মদিন আজ। এ উপলক্ষে মুনীর চৌধুরী সম্মাননা এবং মোহাম্মদ জাকারিয়া স্মৃতিপদক প্রাপকদের নাম ঘোষণা করেছে নাট্যদল থিয়েটার। গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এ বছর মুনীর চৌধুরী সম্মাননা পাচ্ছেন অভিনেত্রী ও সংগীতশিল্পী শিমূল ইউসুফ। মোহাম্মদ জাকারিয়া স্মৃতিপদকের জন্য মনোনীত হয়েছেন প্রাচ্যনাটের অভিনেতা জাহাঙ্গীর আলম।
শহীদ মুনীর চৌধুরী স্মরণে ১৯৮৯ সাল থেকে একজন করে প্রবীণ গুণীকে সম্মাননা এবং মোহাম্মদ জাকারিয়া স্মরণে ১৯৯৭ সাল থেকে একজন তরুণ গুণীকে পদক দেওয়া হচ্ছে। এর আগে ১৯৯৯ সালে মোহাম্মদ জাকারিয়া স্মৃতিপদক পেয়েছিলেন শিমূল ইউসুফ। এবার তিনি মুনীর চৌধুরী সম্মাননার জন্য মনোনীত হয়েছেন। মুনীর চৌধুরী সম্মাননার অর্থমূল্য ৫০ হাজার এবং মোহাম্মদ জাকারিয়া পদকের অর্থমূল্য ২৫ হাজার টাকা।
শিমূল ইউসুফ তার অনুভূতি জানিয়ে বলেন, ‘একজন শিল্পী হিসেবে আমি সবসময় চর্চাটাই করে যেতে চেয়েছি। কতোটা পেরেছি সেটা শিল্পের অনুরাগীরাই বিচার করবেন। তবে এই প্রচেষ্টার পথে পথে যেসব প্রাপ্তি ও ভালোবাসা যোগ হয়েছে তা ভিষণ আনন্দের ও প্রেরণা। সেখানে প্রিয় মানুষ শহীদ মুনীর চৌধুরীর স্মরণে প্রদত্ত সম্মাননা প্রাপ্তি বিশেষ প্রেরণার। যারা আমাকে এই সম্মাননার যোগ্য ভেবেছেন তাদের কাছে আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা।’
গত বছর মুনীর চৌধুরী সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন কামালউদ্দিন নীলু এবং মোহাম্মদ জাকারিয়া স্মৃতিপদক পেয়েছিলেন বাকার বকুল। আগামী বছর থেকে প্রতি এক বছর অন্তর এ দুটি সম্মাননা ও পদক দেওয়া হবে বলে জানান থিয়েটারের পরিচালক (সাংগঠনিক) রামেন্দু মজুমদার।
এ পর্যন্ত মুনীর চৌধুরী সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন মোহাম্মদ জাকারিয়া, অমলেন্দু বিশ্বাস, আবদুল্লাহ আল-মামুন, সৈয়দ জামিল আহমেদ, রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার, সৈয়দ শামসুল হক, আতাউর রহমান, মামুনুর রশীদ, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, সেলিম আল দীন, আলী যাকের, নিখিল সেন, আসাদুজ্জামান নূর, সারা যাকের, তারিক আনাম খান, লাকী ইনাম প্রমুখ।
প্রসঙ্গত, ১৯৫৭ সালে ঢাকায় জন্ম শিমূল ইউসুফের। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের সবার ছোট তিনি। তারা সব ভাইবোন গান করতেন। চার বছর বয়সে বাবা হারানো শিমূল ও তার ভাইবোনদের মা বড় করে তোলেন।
কবি সুফিয়া কামালকে খালা বলে ডাকতেন শিমূল ইউসুফ। কবির দুই মেয়ে সুলতানা কামাল ও সাঈদা কামালদের সঙ্গেই কচিকাঁচার মেলা করতেন শিমূলের বড় তিন ভাইবোন। সেখানেই তাঁদের পরিচয় হয় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কবি জসীমউদ্দীন, চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান, ছড়াকার রফিকুজ্জামান দাদাভাই, বেগম সম্পাদক নূরজাহান বেগমসহ আরও অনেকের সঙ্গে। সাংস্কৃতিক পরিবেশ পেতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি শিমূলের।
১৯৬৩ সালে কচিকাঁচার মেলার পক্ষ থেকে বরিশাল গিয়েছিলেন শিমূলরা। সেখানে পরিচয় হয় সুরকার আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে। তারপর শিমূলের বড় বোনের সঙ্গে বিয়ে হয় আলতাফ মাহমুদের। পরিবারে যখন আলতাফ মাহমুদের মতো একজন মানুষ যুক্ত হন, তখন সাংস্কৃতিক পরিবেশে যেন ফাগুনের হাওয়া বয়ে যায়। সুরকার আলতাফ মাহমুদ হয়ে ওঠেন শিমূলের পিতাসম-শিক্ষক-গুরু।
১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর দেশে যাত্রা করল প্রথম টেলিভিশন। প্রথম দিনই সেখানে গান করেছিলেন শিমূল ইউসুফ। প্রথম রেডিওতে তালিকাভুক্ত শিল্পী হয়ে সম্মানী পেয়েছিলেন ১০ টাকা। টেলিভিশনে গিয়ে সেই সম্মানী হয় ১৫ টাকা। কেবল গানই নয়, নাচ ও অভিনয়েও পারদর্শী হয়ে উঠছিলেন শিমূল।
ঢাকা থিয়েটারের যাত্রালগ্নে ১৯৭৪ সালে ‘বিদায় মোনালিসা’ নাটকের সূর্য চরিত্রে অভিনয় করলেন তিনি। এরপর একে একে ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসি’র নার্স, ‘শকুন্তলা’র গৌতমী, ‘কীত্তনখোলা’র ডালিমন, ‘কেরামতমঙ্গলে’র শমলা, ‘হাতহদাই’-এ চুক্কুনি, ‘যৈবতী কন্যার মন’-এ কালিন্দি, ‘চাকা’য় কথক, ‘বনপাংশুল’-এ সুকি, ‘প্রাচ্য’তে আবারও কথক এবং ‘বিনোদিনী’র বিনোদিনী। প্রতিটি চরিত্রে তাঁর ছিল পরম নিষ্ঠা ও মমতা। মঞ্চের এই নিষ্ঠার প্রতিদান হিসেবে ঢাকার মঞ্চ থেকে তাকে ডাকা হয় ‘মঞ্চকুসুম’ নামে।
সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব ও বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফের সঙ্গে দম্পত্য জীবনে তিনি এক কন্যার জননী। তার মেয়ে এষা ইউসুফও শিল্পচর্চায় জড়িয়ে আছেন।
এলএ/এএসএম