চলচ্চিত্রে অনুদান: কেউ চান সংস্কার, কেউ চান বিলুপ্তি
সরকারের কাছ থেকে অনুদান নিয়ে বানানো সিনেমা এক সময় হয়ে উঠতো কালজয়ী। কালের বিবর্তনে সে রকমটি আর দেখা যায় না। এখন সরকারি অনুদানে বানানো সিনেমা হারিয়ে যায় কালের গর্ভে। খতিয়ে দেখা গেছে স্বজনপ্রীতি, অপ্রতুল অঙ্কের বরাদ্দ, অযোগ্য ব্যক্তিকে অনুদান দেওয়ার কারণেই অনুদানের সিনেমাগুলো দর্শকমনে ছাপ ফেলতে ব্যর্থ হয়। অংশীজনরা মনে করেন, এ ব্যবস্থায় জনগণের টাকারও অপচয় হচ্ছে। তাদের কেউ চান এর সংস্কার, কেউ চান বিলুপ্ত হোক এই ব্যবস্থা।
অর্থের অভাবে ছবি বানাতে পারছেন না, এ রকম প্রতিভাবান তরুণ নির্মাতাদের অনুপ্রেরণা দিতেই ১৯৭৬ সাল থেকে অনুদান ব্যবস্থা চালু করে সরকার। সরকারি অনুদানে নির্মিত হয়েছিল ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’, ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’, ‘দীপু নাম্বার টু’র মতো কালজয়ী সিনেমা। মাঝে কয়েক বছর বন্ধ রাখার পর ২০০৭-০৮ অর্থবছর থেকে আবারও প্রতি বছর সিনেমা বানানো জন্য অনুদান দিচ্ছে সরকার। তবে সেই অনুদান নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই।
চলতি বছর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২০টি সিনেমাকে অনুদান দেওয়া হয়েছে। ছবিগুলোর মধ্যে ১৬টি ছবির প্রত্যেক প্রযোজককে দেওয়া হয়েছে ৭৫ লাখ টাকা করে এবং ৪টি ছবির প্রত্যেক প্রযোজক পেয়েছেন ৫০ লাখ টাকা করে। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী তারা কি শেষ করতে পারবেন ছবিগুলো?
নিয়ম বলে, অনুদানের চেক পাওয়ার ৯ মাসের মধ্যে সিনেমা জমা দিতে হয় তথ্য মন্ত্রণালয়ে। নির্মাতার যদি সেটা বানাতে কোনো কারণে দেরি হয়, যুক্তিসংগত কারণ দেখিয়ে মেয়াদ বাড়িয়ে নেওয়া যাবে। শুধু এই কারণটি দেখিয়েই ছবি না বানিয়ে বছরের পর বছর ফেলে রাখেন নির্মাতাদের অনেকে। সেই তালিকায় এরই মধ্যে নাম তুলেছেন বহু পরিচালক ও প্রযোজক।আবার যারা ছবি বানিয়ে জমা দেন, মুক্তি দেন, সেসব ছবি তেমন আলোড়ন তো দূরের কথা, দেখতেও যান না দর্শক। সেসব ছবির তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন অপু বিশ্বাস নির্মিত ‘লাল শাড়ি’, অরুণা বিশ্বাসের ‘অসম্ভব’, রোজিনার ‘ফিরে দেখা’। লেখা যাবে আরও একগুচ্ছ নাম। এ কারণে অনেকে তো প্রশ্ন তুলেছেন, এসব ছবি কীভাবে অনুদান পায়?
অনেকে মনে করেন, অনুদানের টাকার অঙ্কে সিনেমা হয় না। প্রযোজক জসিম উদ্দিনের পাওয়া অনুদানের টাকায় ছবি নির্মাণ করা জ্যেষ্ঠ নির্মাতা বদিউল আলম খোকন। অনুদান হিসেবে বরাদ্দ দেওয়া অর্থে ছবি নির্মাণ বিষয়ে জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘অনুদান নিয়ে সম্প্রতি আমি “দায়মুক্তি” নামে একটা সিনেমা নির্মাণ করেছি। যে পরিমাণ টাকা দরকার ছিল, অনুদানের টাকায় সেটা হয়নি।’
বদিউল আলম খোকন মনে করেন অনুদানের জন্য সিনেমার গল্পটাকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। তিনি বলেন, ‘অনুদানের ক্ষেত্রে সিনেমার গল্পটা কী নিয়ে, সেটা দেখা দরকার। কেননা মুক্তিযুদ্ধের নামে যেসব সিনেমাকে অনুদান দেওয়া হচ্ছিল, সেসব কিছু হয়েছে? তা ছাড়া যে বাজেটে ছবি বানানো হচ্ছে, তা দিয়ে ছবিটা বানানো সম্ভবও নয়। দরকার কয়েক গুণ টাকা। বিগত দিনগুলোতে এসব কেউ ভাবেনি।’
চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চলচ্চিত্র অধ্যয়নের শিক্ষক মতিন রহমান বলেন, ‘অনুদানের নীতিমালা নির্দিষ্ট কিছু উদ্দেশ্য ও ভাবনা মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছিল। অনুদান কমিটিতে যারা থাকেন, তারা নিবার্চন করেন কে অনুদান পাবেন। সাধারণত কমপিটিশন করে একটা গল্প অনুদান পেয়ে থাকে। আমি যদি বলি, এই পদ্ধতিটা ঠিক নয়। তবে ‘ঠিক’টা কী, সেটাও আমাকে বলতে হবে। যেটা এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। এটা সংসদীয় কমিটি থেকে পাশ হওয়ার বিষয়। ফলে এ মুহূর্তে এ নিয়ে আলোচনা বৃথা। এখন আলোচনা হতে পারে যারা অনুদান পেয়েছেন, তারা কীভাবে সিনেমা নির্মাণ করবেন। বিশাল অংকের টাকা আমরা নির্মাতাদের দিয়েছি, অথচ তারা সিনেমা করবেন কি করবেন না, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। এখন এই বিষয়গুলোর সমাধান করা দরকার।’
অনুদান ব্যবস্থায় সংস্কারের কথা বলেছেন অনেকে। কী কী সংস্কার আনা প্রয়োজন, জানতে চাইলে বদিউল আলম খোকন বলেন, ‘গল্প দেখে অনুদান দেওয়া উচিত। বিশেষ করে সমসাময়িক ও সচেতনতামূলক বিষয়ের গল্পকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। যে সিনেমাগুলো সাধারণ মানুষকে বিনোদন দেয়, অনুদানের ক্ষেত্রে সেগুলোকেও গুরুত্ব দিতে হবে। বাণিজ্যিক ঘরানার সিনেমাকে মোট অনুদানের ৭০ শতাংশ আর আর্ট ঘরানার সিনেমাকে ৩০ শতাংশ অনুদান দিলে ভালো হয়।’
অনুদান নিয়ে ক্ষোভের শেষ নেই। অনেক তরুণ মেধাবী নির্মাতা অনুদানের জন্য আবেদন করেও সাড়া পাননি। তাদের অন্যতম রিয়াজুল রিজু। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘আমার প্রথম সিনেমা তৈরি করেছি নিজের টাকায়। ছবিটা ভালো চলেছে, আলোচনা হয়েছিল সেটা নিয়ে। পরে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছিল। কিন্তু পরে ছবি বানানোর টাকা ছিল না বলে সরকারি অনুদানের জন্য আবেদন করি, কিন্তু পাইনি। একবার দুবার না, সাতবার তিনটা গল্প জমা দিয়েছিলাম। কেন পাইনি জানি না।’
চলচ্চিত্রের উন্নয়নে জাতীয় পরামর্শক কমিটির সদস্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আ আল মামুন মনে করেন, অনুদানে একটি বড় পরির্বতন আনা প্রয়োজন। এতে অনেক নতুন চিন্তার সন্নিবেশ ঘটাতে হবে। মোট কথা, ব্যবস্থাটিকে আর আগের মতো রাখা যাবে না। অনুদানের ক্ষেত্রে একটা সম্পূর্ণ নতুন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন, ‘সিনেমায় অনুদানের ক্ষেত্রে আগে স্বজনপ্রীতির কথা শোনা যেত। অনেকে সিনেমার জন্য টাকা নিয়ে সিনেমা নির্মাণও করতেন না। অনুদানটা আসলে নতুন নির্মাতাদের একটা জায়গা হওয়ার কথা ছিল। জুলাই অভ্যুত্থানের পর এ নিয়ে অনেকে কথা বলছেন। আমরা একে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করছি।’
অনুদান ব্যবস্থার সংস্কার প্রসঙ্গে তরুণ নির্মাতা যুবরাজ শামীম বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের চলচ্চিত্রে অনুদান ব্যবস্থা অনেকটা অনাথকে এককালীন অর্থ দান করার মতো। এভাবে টাকা দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলার বদলে সরকারের উচিত ওই ছবিটির প্রযোজক হওয়া। ছবিটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সেটার দেখভাল করা। ছবিটি বিক্রি করে কীভাবে টাকা তুলে আনা যায় সেসব ব্যবস্থা করা উচিত।’
তবে অনুদান ব্যবস্থা নিয়ে ব্যতিক্রম চিন্তার কথা বলেছেন বাংলাদেশ পরিচালক সমিতির সভাপতি কাজী হায়াত। তিনি মনে করেন এই ব্যবস্থা তুলে দেওয়া উচিত। সেন্সর সার্টিফিকেশন বোর্ড কমিটির সদস্য জ্যেষ্ঠ এই নির্মাতা জাগো নিউজকে বলেন, ‘সরকারি অনুদানে যেসব সিনেমা নির্মাণ করা হয়েছে, এসব মানুষ দেখে না। এসব সিনেমার সংখ্যা বাড়িয়ে লাভ নেই। শুধু শুধু জনগণের টাকার অপচয় হচ্ছে। অনুদান প্রথা তুলে দেওয়া দরকার। যদিও এই সরকার তা করতে পারবে না। তবে সামনে যে সরকার আসবে, তাদের প্রতি আমার আহ্বান থাকবে, অনুদান ব্যবস্থা যেন তারা বন্ধ করে দেয়।’
তরুণ নির্মাতা রিয়াজুল রিজু মনে করেন, অনুদান দেওয়ার বিষয়টিকে পরীক্ষার নম্বর পদ্ধতিরে মতো করা যেতে পারে। তাতে তরুণ নির্মাতারা বুঝতে পারবেন যে তার গল্পটি কত নম্বর পেয়েছে, কেনই বা অনুদান পেল না। অনুদানের টাকা সিনেমা নির্মাণে ঠিকমতো ব্যবহার হচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে আরও দক্ষ করে তুলতে হবে।
এমআই/আরএমডি/এএসএম