কবরে শোয়ানোর দিন পর্যন্ত আমি ওর সঙ্গে ছিলাম

মিজানুর রহমান মিথুন
মিজানুর রহমান মিথুন মিজানুর রহমান মিথুন , লেখক ও সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৮:৫৮ এএম, ২৯ অক্টোবর ২০২৪
মিল্টন খন্দকার। ছবি: মিল্টন খন্দকারের সৌজন্যে

খ্যাতিমান গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক মিল্টন খন্দকার। তার গান গেয়ে খ্যাতি পেয়েছেন মনির খান, মনি কিশোরের মতো শিল্পীরা। সদ্যপ্রয়াত কণ্ঠশিল্পী মনি কিশোর ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মনি কিশোরের স্মৃতিচারণসহ সমসাময়িক নানান প্রসঙ্গে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন মিল্টন খন্দকার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান মিথুন

জাগো নিউজ: কেমন আছেন?
মিল্টন খন্দকার: এই মুহূর্তে শারীরিক অবস্থা তেমন একটা ভালো নেই। কয়েকদিন ধরে জ্বর ছিল। এখন একটু কমেছে। কয়েকদিন আগে আমার প্রিয় বন্ধু কণ্ঠশিল্পী মনি কিশোরের অপ্রত্যাশিত চলে যাওয়া মনটাকে ভীষণ ভার করে রেখেছে।

জাগো নিউজ: গান করছেন না?
মিল্টন খন্দকার: ভালো-মন্দ যেভাবেই থাকি, গান নিয়ে থাকি। কারণ গান ছাড়া তো আর কিছু পারি না। জীবনে আর কিছু শিখিনি। হাতে বেশ কিছু গানের কাজ আছে। শরীর খারাপ, অন্য কিছু কাজে ব্যস্ততার কারণে গানগুলো শেষ করতে পারিনি। নতুন কিছু গানের ব্যাপারে বেশ কয়েকজন যোগাযোগ করেছেন। তাদের সময় দিতে পারছি না। একটু সুস্থ হলেই কাজগুলো শেষ করে ফেলব।

কবরে শোয়ানোর দিন পর্যন্ত আমি ওর সঙ্গে ছিলামপ্রয়াত কণ্ঠশিল্পী মনি কিশোর ও গীতিকবি মিল্টন খন্দকার। ছবি: সংগৃহী 

জাগো নিউজ: সদ্যপ্রয়াত কণ্ঠশিল্পী মনি কিশোর আপনার বন্ধু ছিলেন। তার অনেক শ্রোতাপ্রিয় গান আপনি করেছেন। তার সঙ্গে কীভাবে পরিচয় হয়েছিল?
মিল্টন খন্দকার: যতদূর মনে পড়ে মনি কিশোরের সঙ্গে ১৯৮৮ সালে স্টেডিয়াম মার্কেটে বেতার জগত নামের একটি দোকানে প্রথম কথা হয়েছিল। সেখানে মনি কয়েকটি গান নিয়ে এসেছিল ক্যাসেট করবে বলে। দেখলাম ছেলেটা অনেক ভালো গায়, কণ্ঠটা দারুণ। সেই থেকে যখন যেখানে সুযোগ পেয়েছি, ওকে কাজে লাগিয়েছি। পরিচয়ের দিন থেকে কবরে শোয়ানোর দিন পর্যন্ত আমি ওর সঙ্গে ছিলাম।

জাগো নিউজ: মনি কিশোরের অনেক জনপ্রিয় গান আপনি করেছেন। আপনার করা তার গাওয়া কয়েকটি গানের কথা বলবেন?
মিল্টন খন্দকার: সংগীতজীবনে আমি সবচেয়ে বেশি করেছি মনি কিশোরের অ্যালবাম। ওর প্রায় ১৪টি অ্যালবাম করেছি অামি। মনি কিশোরের হিট গানের মধ্যে বেশির ভাগই আমার করা। এই তো কিছুক্ষণ ধরে ‘তুমি শুধু আমারই জন্য’, ‘মুখে বল ভালোবাসি’, ‘ঘরের খোঁজে ঘর হারাইলাম’ গানগুলো শুনছিলাম, এর মধ্যে আপনার ফোন পেলাম।

জাগো নিউজ: মৃত্যুর পর তার ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়টি সামনে আসে। বিষয়টি নিশ্চয়ই আপনি আগেই জানতেন?
মিল্টন খন্দকার: জানতাম। মনি কিশোর ১৯৯৪ সালে একজন মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করার সময় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। সেসময় তার নাম রাখা হয়েছিল ‘মনি মহম্মদ’। সেই মনি মহম্মদ নাম ধারণ করেই সে এতকাল বেঁচে ছিল। মনি কিশোর ছিল তার পোশাকি নাম। এই নামে সে শ্রোতাদের কাছে পরিচিতি পেয়েছিল। তাই এই নামেই সে সবার কাছে পরিচিত ছিল। এ নিয়ে কেউ কখনও কোনো প্রশ্ন করেনি।

কবরে শোয়ানোর দিন পর্যন্ত আমি ওর সঙ্গে ছিলাম

জাগো নিউজ: তার দাফন নিয়ে তো বেশ জটিলতা হলো।
মিল্টন খন্দকার: জটিলতা নয়, আমি বলবো ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। মনির পরিবারের সবাই মনে করেছিল, যেহেতু ও মুসলান হয়েছে, সেহেতু তার মুসলিম রীতিতেই দাফন হবে। মনির ভাইয়ের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তাহলে আপনারা তাকে কীভাবে দাফন করবেন? তখন তিনি বললেন, আমরা মুসলিম রীতিতে দাফন করে অভ্যস্ত নই, আপনারা যেভাবে বলবেন সেভাবেই হবে। এ আলোচনার মধ্যে মনি কিশোরের ভাইকে হয়তো কেউ একজন বলেছিলেন, তাহলে আপনারা আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে দিয়ে দেন। এ প্রস্তাবে মনির ভাই রাজিও হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না যে, আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম হচ্ছে বেওয়ারিশ লাশ দাফন করে। এটা জানার পর তার তার ভাই বললেন না, তাহলে তো হবে না। আমরা স্বজনরা তো আছি। কিন্তু এর মাঝেই গণমাধ্যমে দাফন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হতে শুরু করে। ফলে দাফন নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। তখন এ নিয়ে নেতিবাচক কথা উঠতে পারে মনে করে প্রশাসন চাইলো একটা সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে। তারপর তার দাফন হবে। এরপর মনি কিশোরের মেয়ে নিন্তি চৌধুরী আমেরিকা থেকে সব কাগজপত্র পাঠিয়েছে। তারপর দুই পক্ষের কাছ থেকে অনাপত্তিপত্র নিয়েছে প্রশাসন, এরপর রামপুরা থানার ওসি আতাউর সাহেবের ঐকান্তিক সহযোগিতায় মনি কিশোরের মরদেহ আমরা দ্রুত পেয়েছি। যার ফলে আমরা দাফনের কাজটি দ্রুত করতে পেরেছি। এ জন্য ওসি আতাউর সাহেবকে ধন্যবাদ জানাই। আমাদের সবার চেষ্টা ছিল দাফনের পর এ নিয়ে যেন কোনো অভিযোগ না ওঠে। কেউ যেন কোনো প্রশ্ন না তুলতে পারে। সেই কারণে যথাযথ কাজগপত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে দাফন করতে একটু সময় লেগেছে।

জাগো নিউজ: আপনি তার বিয়ের সময় উপস্থিত ছিলেন?
মিল্টন খন্দকার: না, ওর বিয়ের সময় আমি কলকাতায় এক শিল্পীর গানের রেকর্ডিংয়ে ছিলাম। মনির ধর্মান্তরিত হওয়ার খবরটি সেসময় দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। আমি সেই পত্রিকাটি সংগ্রহ করেছিলাম। আমার কাছে সেটি এখনো সংরক্ষিত আছে।

জাগো নিউজ: আপনি দায়িত্ব নিয়ে মনি কিশোরের জানাজা ও দাফনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলেন। কীভাবে কী করলেন?
মিল্টন খন্দকার: যেহেতু মনি কিশোর হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ছিল এবং সে মুসলিম হয়েছে, বিষয়টি সবাই জানে। ফলে মনি কিশোরের আত্মীয়-স্বজন, ভাই-বোনদের এ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। সে ক্ষেত্রে মুসলিম কায়দায় কীভাবে দাফন-কাফন হবে তা তার ভাই-বোনদের জানা নেই। ফলে বিষয়টি নিয়ে তারা এগোতে পারছিল না। কারণ দাফনের বিষয়টি নিয়ে কীভাবে কী করবে, কোথায় ভুল হবে, কোথায় দোষ হবে… মোটকথা তারা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল। এরপর যখন আমি পত্রিকায় দেখলাম মনি কিশোরের লাশ আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে দেওয়া হবে এবং তারা দাফন করবে, তখন আমি খুব কষ্ট পেলাম। ভাবলাম আমার বন্ধু! আমি বেঁচে থাকতে আমার বন্ধুর লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হবে! তখন আমি নিজ উদ্যোগে মনি কিশোরের স্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। মনি কিশোরের ভাইদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। দুই পক্ষের মধ্যস্থতা করে আমি দাফন-কাফনের কাজটি সম্পন্ন করেছি। কেউ আসলে দাফন-কাফনের কাজের ব্যাপারে এগুচ্ছিল না। আমি একটু সাহস করে এগিয়েছি। আমি চেয়েছি আমার বন্ধুর যথাযথ মর্যাদায় শেষ বিদায়টা হোক। দাফন হোক। সেই তাগিদ থেকেই আমি সেখানে গিয়েছি।

কবরে শোয়ানোর দিন পর্যন্ত আমি ওর সঙ্গে ছিলাম

জাগো নিউজ: আমাদের অনেক খ্যাতিমান মানুষের সন্তানেরা দেশের বাইরে। দেখা যাচ্ছে শেষ বিদায়ের সময় তাদের পাশে কেউ থাকছে না। এই বাস্তবতা আপনার কাছে কেমন?
মিল্টন খন্দকার: আমার নিজেরও দুই সন্তান ফ্রান্সে থাকে। এটা আমাদের এক ধরনের বাস্তবতা। আমরা কিন্তু সবাই ভেতরে ভেতরে চাই আমাদের সন্তানরা যেন একটু ভালো থাকে, একটু সুস্থ থাকে, সুন্দর থাকে। সেকারণে আমরা উচ্চশিক্ষার জন্য তাদের বিদেশে পাঠাতে চেষ্টা করি। এটা বাস্তবতা। যদি মনি কিশোরের কথা বলি, এটি একদম ব্যতিক্রম ঘটনা। মনির একটি মাত্র মেয়ে। সে আমেরিকায় পাড়াশোনা করছে। ওর পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষার কারণে ও আসতে পারেনি। বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে ও সবসময় আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে। বাবার দাফনের ব্যাপারে সব ধরনের সহযোগিতা করেছে। দাফনের জন্য আমার নামে সম্মতিপত্র দিয়েছে। মনির মেয়ে যদি কাগজপত্র সঠিক সময়ে না পাঠাতো, তাহলে আমরা দ্রুত পুিলশের কাছ থেকে মরদেহ আনতে পারতাম না। দ্রুত দাফনও দিতে পারতাম না।

জাগো নিউজ: মনি কিশোর জীবনের শেষ দিকে একা হয়ে পড়েছিলেন। আপনি কি জানতেন সেটা?
মিল্টন খন্দকার: জীবনের শেষ দিকে নয়, বিবাহবিচ্ছেদের পর থেকে মনি কিশোর ১৮ বছর একাকী জীবনযাপন করেছে। একা বাসা ভাড়া নিয়ে থেকেছে। আমার সঙ্গে তার সবসময়ই যোগাযোগ ছিল। বিভিন্ন গানের অনুষ্ঠানে আমাদের দেখা হতো।

জাগো নিউজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মিল্টন খন্দকার: আপনাকেও ধন্যবাদ।

এমএমএফ/আরএমডি/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।