জন্মদিন
গুম হয়েছিলেন তিনিও, অংশ নিয়েছিলেন গণ-অভ্যুত্থানে
ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন তিনি। উপস্থিত ছিলেন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক আমতলা সমাবেশে। তিনি ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেন। তারপর এল ১৯৭১, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে চলে যান কলকাতায়। সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। এই চলচ্চিত্রকারের নাম জহির রায়হান। আজ তার ৮৯তম জন্মদিন।
ভাষা আন্দোলন গভীর প্রভাব ফেলেছিল জহির রায়হানের ওপর। সেটার ছাপ পাওয়া যায় তার বানানো বিখ্যাত সিনেমা ‘জীবন থেকে নেয়া’য়। ছবিতে রূপক অর্থে নারী-স্বৈরাচার দেখিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭০ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি আজও ভীষণ জনপ্রিয়। ১৯৭১ সালে কলকাতায় তার এই ছবির বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয়। ছবিটি দেখে খ্যাতিমান নির্মাতা সত্যজিত রায়, মৃণাল সেন, তপন সিংহ এবং ঋত্বিক ঘটকরা দারুণ প্রশংসা করেছিলেন। সময়টা বড্ড অর্থকষ্টে কাটছিল তার। তবু সিনেমার প্রদর্শনী থেকে পাওয়া টাকাগুলো তিনি মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দান করেছিলেন।
গত জুলাই মাসে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিলেন জহির রায়হান। তরুণ কণ্ঠে, দেয়াল লিখনে, ব্যানারে, পোস্টারে জহির রায়হান হাজির হয়েছিলেন তার উপন্যাসের সংলাপ হয়ে, ‘আসছে ফাল্গুনে আমরা দ্বিগুন হবো’। জীবন থেকে নেয়া সিনেমায় তার ব্যবহার করা নজরুলের গান ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ও তরুণদের জন্য হয়ে উঠেছিল অনুপ্রেরণা।
জহির রায়হানের পুরো নাম আবু আবদার মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ। ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট ফেনী জেলার মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এ তিনি। ষাটের দশকের মাঝামাঝি তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। এ সময় কমরেড মণি সিংহ তার নাম দেন ‘রায়হান’। সেই থেকে তিনি হয়ে যান জহির রায়হান। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনৈতিক নানা অস্থিরতা জহিরকে নাড়া দিত। রাজনৈতিক কারণে ছাত্রজীবনে একাধিকবার জেলেও গেছেন তিনি। ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এই চলচ্চিত্রকার।
জহির রায়হানের লেখা কালজয়ী উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে’। পরে এ উপন্যাসকে উপজীব্য করে সিনেমা বানিয়েছিলেন তার সহধর্মিণী অভিনেত্রী কোহিনূর আকতার সুচন্দা। জহির রায়হানের প্রথম স্ত্রী অভিনেত্রী সুমিতা দেবী। প্রয়াত এই অভিনেত্রীর দুই ছেলে বিপুল রায়হান ও অনল রায়হান। তারা দুজনও নির্মাতা। স্ত্রী সুচন্দার ছেলে তপু রায়হান অভিনেতা।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগৎ ও জীবনমুখীসাহিত্য ধারায় জহির রায়হানের অবদান অনবদ্য। তার খ্যাতি চলচ্চিত্রের জন্য হলেও শুরুতে তিনি ছিলেন কথাসাহিত্যিক। চলচ্চিত্রে তিনি পা রাখেন ১৯৫৭ সালে। তার বানানো প্রথম সিনেমা ‘কখনো আসেনি’। পরে তার ‘বাহানা’, ‘বেহুলা’, ‘আনোয়ারা’, ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিগুলো আলোচিত ও প্রশংসিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত ২০ মিনিটের প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ বাংলাদেশের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
শুরুতে জানা যায়, গুম হয়েছেন জহির রায়হান। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ৩ দিন আগে ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর আলবদর সদস্যরা ধরে নিয়ে যায় কথাসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সারকে। ১৯৭২ সালে ৩০ জানুয়ারি সকালে জহিরের কায়েতটুলির বাসায় ফোন করে জানানো হয়, তার ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে মিরপুর আটকে রাখা হয়েছে। তারপর ভাইকে খুঁজতে গিয়ে জহির রায়হান আর ফিরে আসেননি।
১৯৯৯ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর দৈনিক ভোরের কাগজে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মিরপুরে বিহারীদের হামলায় প্রাণ হারিয়েছিলেন জহির। ওই প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি মিরপুরে ১২ নম্বর সেকশনে অস্ত্র উদ্ধারে গিয়েছিল সেনাবাহিনী ও পুলিশের যৌথ একটি দল। শহীদুল্লাহ কায়সারের খোঁজ পেতে তাদের সঙ্গ নেন ছোট ভাই জহির রায়হান। ওই অপারেশনে অংশ নেওয়া সেনা সদস্য মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আমীর হোসেনের বর্ণনা থেকে জানা যায়, ওই অপারেশনে সেদিন বেলা ১১টায় পজিশন নেওয়ার আগেই তাদের ওপর হামলা চালায় বিহারিরা। এ সময় অবাঙালি বিহারিদের ছোঁড়া গুলিতে ঝাঁজরা হয় জহির রায়হানের বুক। মাটিতে লুটিয়ে পড়ার পর গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত জহিরকে অজ্ঞাতস্থানে নিয়ে যায় বিহারীরা। তার মরদেহের সন্ধান আর মেলেনি।
জহির রায়হানের সাংবাদিকজীবন শুরু হয় ১৯৫০ সালে, ‘যুগের আলো’ পত্রিকায়। পরে তিনি খাপছাড়া, যান্ত্রিক, সিনেমা ইত্যাদি পত্রিকায় কাজ করেছেন। ১৯৫৬ সালে তিনি সম্পাদক হিসেবে ‘প্রবাহ’ নামে একটি পত্রিকায় যোগ দেন। তার প্রথম গল্প ‘সূর্যগ্রহণ’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে। এ ছাড়া তার উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’, ‘আরেক ফাল্গুন’, ‘বরফ গলা নদী’, ‘আর কতদিন’, ‘তৃষ্ণা’ ইত্যাদি। তার ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসটি ১৯৬৪ সালে ‘আদমজী পুরস্কার’ পায়। তিনি ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৭৭ সালে মরণোত্তর একুশে পদক এবং ১৯৯২ সালে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন।
এলএ/আরএমডি/এএসএম